বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তারাকান্দর: গণহত্যার এক নির্মম স্বাক্ষর

  • দীপংকর গৌতম   
  • ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৩:৩১

ভিয়েতনামের মাই লাই বা চেকের বধ্যভূমি ও গণহত্যার চেয়ে তারাকান্দ কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত জগদীশ বৈদ্যরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। কোনো শহীদের নাম কেউ রাখেনি মনে। তাদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। এমনকি তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা অনেকে জানেও না। আজ পর্যন্ত এ শহীদদের নামে কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জন্ম জড়ুল। হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে অর্জন করতে এক সাগর রক্ত দিতে হয়েছে। গণশিল্পী আবদুল লতিফের গানে ধ্বনিত হয় তাই- ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’... আসলে কত দামে কেনা এই স্বাধীনতা তা বলে শেষ করা যাবে না। নয় মাসের আতঙ্কবেষ্টিত রাত আর কি অন্তহীন দুর্ভোগ এবং বিভীষিকাময় সেই দিনগুলো বর্ণনা করার মতো নয়।

একাত্তরের ২৫ মার্চ গভীর রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নয় মাসের যুদ্ধে দেশটাকে এক বধ্যভূমিতে পরিণত করে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস মিলে। এ সময় থেকেই তারা নির্মম গণহত্যায় মেতে ওঠে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন ভয়াবহ গণহত্যা দুনিয়ার আর কোথাও সংঘটিত হয়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাম্প স্থাপন করে এরা চালাত হত্যাযজ্ঞ এবং অত্যাচার-নির্যাতন। তাদের সহযোগী ছিল স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস। তারা পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করার জন্য শুধু হুকুমের অপেক্ষা করত। আস্থাভাজন দালাল হওয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার তখন রাজাকার আল বদর আল শামস ছাড়ও ছিল স্থানীয় প্রভাবশালী একটা গোষ্ঠী যারা সাধারণ মানুষকে দিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর লুট করাত। আর জলের দামে সেগুলো কিনত।

গোপালগঞ্জ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) রাজনৈতিকভাবে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা সবার জানা ছিল, তাছাড়া এ অঞ্চলের মুক্তিসেনারাও ছিল দুর্দমনীয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি বলে এই এলাকা এবং এলাকার মানুষ পাকিস্তানিদের বড় টার্গেট ছিল।

এখানে যুদ্ধের নৃশংসতা যেমন বীভৎস ছিল, তেমনি প্রতিরোধও ছিল ইতিহাসখ্যাত। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন এ অঞ্চলে পাশবিকতার যেকোনো মাত্রাকেই হার মানিয়েছিল। মুক্তিসেনারা তাদের নাস্তানাবুদও করে সেভাবেই। স্বভাবতই পাকিস্তানি বাহিনী গোপালগঞ্জের ওপর ছিল বেশি ক্ষিপ্ত। এ কারণে সেখানে ভয়ংকর একেকটি ছোবল হেনে অজস্র বধ্যভূমি তৈরি করিই ছিল তাদের টার্গেট। এক একটি জনপদকে তারা পরিণত করেছিল সেভাবেই পরিকল্পনামাফিক।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর গণহত্যা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত মাই লাই গণহত্যা বা চেক প্রজাতন্ত্রের লিডিস গণহত্যার চেয়েও ভয়াবহ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রথম তিনমাসেই এখানে মাই লাই ও লিডিসের মতো শখানেক বড় গণহত্যার তথ্য জানতে পারেন নিউজউইকের এক সাংবাদিক। সেই গণহত্যার ধারাবাহিকতায় গোপালগঞ্জে একাধিক নারকীয় গণহত্যা চালানো হয়। বিশেষত গোপালগঞ্জ জেলার তারাকান্দর গ্রামের গণহত্যা পাশবিকতার ভয়ংকর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই তারাকান্দরের অবস্থান কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নে। পিঞ্জুরী গ্রাম থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালে ধু-ধু করে দেখা যায় গ্রামটি। বর্ষায় শিশুধানসহ দোল খায় গ্রামখানাও ।

১৯৭১ সালে এই তারাকান্দর গ্রামকেই তৈরি করা হয় বধ্যভূমিতে। কোটালীপাড়ার বৃহত্তর বধ্যভূমি তারাকান্দর গ্রামে। কিন্তু ৫০ বছরের মধ্যে সবাই এটা ভুলতে বসেছে। এ ইতিহাস অনেকেরই অজানা, এই বধ্যভূমি যাদের সহায়তায় হয়েছিলো তাদেরও কেউ কেউ জীবিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও এই গণহত্যার ইতিহাস কেউ বলতে চায় না। রাজাকার, আল বদর, আল শামসরা এত শক্তপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত যে এদের নাম বলে কেউ জীবনের নিরাপত্তা হারাতে চায় না। যে কারণে অবহেলায় থেকে গেছে গণহত্যার ইতিহাস। লিখিতভাবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই মেলেনি বর্বোরোচিত এই গণহত্যার।

১৯৭১ সালের মে মাসে ঘটনাটি ঘটে। বঙ্গাব্দের ১৯ জ্যৈষ্ঠ। দেশজুড়ে তখন চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কান্দি ইউনিয়নের ভূমিজ মানুষেরা দেশীয় অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলে তারাকান্দর ‘বালা বাড়ি’তে। এখান থেকেই প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল এলাকার মানুষ। অন্যদিকে গোপালপুর ও কুরপালায় চিহ্নিত কয়েকটি বাড়ি ছাড়া বেশিরভাগই ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাহায্যকারী।

কারণ ততদিনে কুরপালায় মিলিটারি ক্যাম্প বসেছে। তারাকান্দরের নদী পার হলেই কাকডাঙ্গা-গোপালপুরে সামরিক বাহিনীর সহায়তাকারী রাজাকার, আল বদর বাহিনীতে ভরে গেছে। সমগ্র কোটালীপাড়ায় তারা ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। মাঝবাড়ি, হিরনে পিস কমিটি হয়েছে। তারাশীর বেবাজিয়া বা সওদাগর সম্প্রদায় ‘নিম্নবর্গের’ বিধায় এবারে তারা চূড়ান্ত হামলার চেষ্টা করছে। তাদের ‘বাইদা’ বলে যে হেলাফেলা করা হতো এবারে তারা যেন তার শোধ নিতে মরিয়া। তারা যে যার মতো লুটপাট ডাকাতি করছে হিন্দুবাড়িতে। এই এলাকায় তখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয় নিতে আসা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিলের মধ্যে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসছে বিভিন্ন এলাকা থেকে।

এ খবর জানতে পারে পার্শ্ববর্তী গোপালপুর পূর্ণবতী গ্রামের রাজাকার-আলবদর। এরপর তারা কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন পাকিস্তানি সেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকারদের অনেকে। তাদের ইশারায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দর আক্রমণের। তারাকান্দরের লোকজন তখন মর্টার বা মেশিনগানের শক্তির ব্যাপারে একদম ছিল অজ্ঞ। তারাকান্দর ধারাবাসাইল কান্দির লোকজন যখন ঢাল সড়কি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তৎপর তখনই পাকিস্তানি বর্বররা দেশীয় রাজাকার–আল বদরদের সহায়তায় ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে।

মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হাজার খানেক মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। অস্ত্র রেখে পেছন দিকে যে যেভাবে পারে পালাতে থাকে। এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রামদা, কুড়াল, বল্লম দিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর। বেলা ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ। শহীদ হন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। সেই নৃশংসতার নীরব সাক্ষী পুরো তারাকান্দর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এবং সেই সময় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য।

তারাকান্দর গ্রামের নটোবর রায়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। তাদের মধ্যে ডহরপাড়া গ্রামের নরেন দাঁড়িয়া, তার স্ত্রী, মা এবং চিন্তা দাঁড়িয়া ও তার ছেলে ছিল।’ এ ছাড়া ছিল দর্শন রায়, তার স্ত্রী ও মেয়ে এবং মনমোহন রায়ের ছেলে হরলাল রায়। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনও মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন তিনি। তারাকান্দর খালের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণু রায়ের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়।

এভাবে তারাকান্দর বৈদ্যবাড়ি, রায়বাড়ি, বিশ্বাসবাড়ির দক্ষিণপাশের মাঠ ও পুকুরপাড়ে সারি সারি লাশ দেখা যায়। যে শহীদদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় তাদের মধ্যে রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু মণ্ডলের স্ত্রী কুটিশ্বর মণ্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রী। এ ছাড়া নাম না-জানা এলাকা ও এলাকার বাইরের বহু লোককে সেদিন এই তারাকান্দর এ জায়গায় হত্যা করা হয়। এর পাশাপাশি নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। দুঃখজনক হলো- আজ পর্যন্ত সেই গণহত্যার স্পট চিহ্নিত হয়নি।

সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য। বয়স তার ৭৫ ছুঁই ছুঁই। শত্রুর তাড়া খেয়ে ওই দিন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানাভর্তি ডোবার মধ্যে। তার এক হাতে রামদা, অন্য হাতে বল্লম। শত্রুরা তার হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে চলে যায়। কিন্তু ৩৪টি কোপ খেয়েও বেঁচে আছেন জগদীশ বৈদ্য। জীবনের নিরাপত্তার জন্য পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বাসুন্দিয়ায় আশ্রয় নেন। সেখানে এখন দিনমজুরি করে সংসার চলে তার।

ভিয়েতনামের মাই লাই বা চেকের বধ্যভূমি ও গণহত্যার চেয়ে তারাকান্দ কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত জগদীশ বৈদ্যরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। কোনো শহীদের নাম কেউ রাখেনি মনে। তাদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। এমনকি তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা অনেকে জানেও না। আজ পর্যন্ত এ শহীদদের নামে কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। এই শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে না একাত্তরের এই বীরত্বগাথা।

ফুটনোট: ছবিটি তারাকান্দর নয়।

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর