মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির হাজার বছরে শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিসেনার রক্তে রঞ্জিত এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল বাংলাদেশ- বিশ্বের মানচিত্রে এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এক সাগর রক্ত ও ৩০ লাখ প্রাণ ও প্রায় তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।
রাজনৈতিকভাবে অগ্রসরমাণ নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এক অদম্য শক্তি নিয়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বতার প্রতিশোধ নিতে একদল তরুণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক অটুট মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মারণাস্ত্রের চেয়ে মনোবলই যে অধিকতর শক্তিশালী, পুরো যুদ্ধকালে তার প্রমাণ রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী জেলা ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহ (পরে মেজর জেনারেল ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান)। নরসিংদীকে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে নেয়া হলে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. নূরুজ্জামান।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নরসিংদীকে মুক্ত করতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা যেসব স্থানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সে স্থানগুলো হলো নরসিংদীর সদর উপজেলার বাঘবাড়ী, পালবাড়ী, আলগী, পাঁচদোনা, পুটিয়া, চলনদীয়া, মনোহরদী উপজেলার হাতিরদীয়া বাজার, রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর বাজার, রামনগর, মেথিকান্দা, হাঁটুভাঙ্গা, ভাঙালীনগর, খানাবাড়ী, বেলাব উপজেলার বেলাব বাজার, বড়িবাড়ী, নারায়ণপুর ও নীলকুঠি। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে করে এখনও ভয়ে আঁতকে ওঠে নরসিংদীবাসী। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষী আছে নরসিংদী জেলাজুড়ে অনেক গণকবর।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় নরসিংদীর ১৫টি বধ্যভূমিতে বিভক্ত করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্চ অফিস, শ্মশানঘাট, খাটেহারা সেতু, শীলমান্দি, রায়পুরা উপজেলার পরিষদ ভবন, মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশন, রামনগর, বেলাব বড়িবাড়ী, পলাশের জিনারদী রেলওয়ে স্টেশন ও শিবপুরের ঘাসিরদিয়া, পুটিয়া উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদী জেলায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ঢাকায় ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে আকস্মিক হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। সে সময় কয়েকজন বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক কোনো রকমে আত্মরক্ষা করে ক্যাপ্টেন (পরে ব্রিগেডিয়ার) মতিউর রহমানের নেতৃত্বে সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩১ মার্চ নরসিংদী পৌঁছন। ৩০ মার্চ ময়মনসিংহে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেজর কে এম শফিউল্লাহর নির্দেশে তারা নরসিংদী আসেন।
এর কদিন পর (৮ এপ্রিল) ক্যাপ্টেন মতিউর পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বাগবাড়ী কড়ইতলায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেন। কৌশলগত কারণে পরদিনই হানাদার বাহিনী নরসিংদীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করলে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান। ৯ এপ্রিল দুপুরের আগেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাহিনী পেছনে সরে পালবাড়ীতে ক্যাম্প স্থানান্তর করে।
অন্যদিকে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীও রাতের অন্ধকারে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে। পরদিন ১০ এপ্রিল দুপুরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার, রকেট শেল, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৫-১৬টি ট্রাকবহর নিয়ে মাধবদী বাবুরহাট পেরিয়ে পাঁচদোনা মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছলে পালবাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সাহসী দল তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গতিরোধ করে। বিকাল পর্যন্ত মরণপণ যুদ্ধ করেও পাকিস্তানি বাহিনী সামনে এগোতে ব্যর্থ হয়ে বাবুরহাটের দিকে পিছু হটে। পরে ঢাকা থেকে আরও সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করলে পাকিস্তানি বাহিনী ফের নরসিংদী শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
সীমিত শক্তি নিয়ে রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর ইপিআর বাহিনীর গোলাগুলি শেষ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীকে অবস্থান ত্যাগ করতে হয়। এ সুযোগে নরসিংদী দখল করে শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ছুটিতে আসা নৌ সৈনিক নেহাব গ্রামের সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মাত্র দুজন সৈন্য জখম হন। ইপিআরসহ মাত্র ১২ জন যোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের সঙ্গে ছিল মাত্র একটি মর্টার, দুটি মেশিনগান, কিছু রাইফেল ও গুলি। এ যুদ্ধের খবর আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল।
ইতিপূর্বে ৩ এপ্রিল আকাশ বাণীতে প্রচার করা হয় যে, নরসিংদী থেকে প্রায় চার হাজার বাঙালি সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা আক্রমণের জন্য রওনা হয়েছেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ৪ ও ৫ এপ্রিল বিমান থেকে ১ ঘণ্টাব্যাপী নরসিংদী শহরে বোমাবর্ষণ করে। এতে শহরের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই বিমান হামলায় নরসিংদী শহরের চার-পাঁচজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ১৯৭১-এ বর্তমান জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই ২৭-২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটক রাখা হতো। নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড়সংলগ্ন লোহারপুলের নিচে।
সেখানে চার-পাঁচজনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২০-২২ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা শেষে লোহারপুলের নিচে সবাইকে একসঙ্গে মাটিচাপা দেয়া হয়। বোমাবর্ষণ ও নরসিংদী দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ফলে বিক্ষুব্দ্ধ জনতা আক্রোশে ফুঁসতে থাকে। নরসিংদীর নেতারা ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈন্য এবং তরুণরা দ্রুত নরসিংদী শহর ছেড়ে চলে যায়।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭১-এর মার্চে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। এতে হাজার হাজার ছাত্রজনতা তাদের স্বাগত জানায়। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলে শত শত যুবকের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
পরে শুরু হয় প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও চোরাগোপ্তা হামলা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের পর সাফল্য ও ব্যাপক তৎপরতায় হানাদারদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা সব সময় সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে। এদিকে দেখতে দেখতে মুক্তির দিনও দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে। ১৯৭১-এর ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে রায়পুরা ও সদর ছাড়া জেলার সব এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। পরে ১০ ডিসেম্বর রায়পুরা মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী নরসিংদী শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এত ব্যাপক তৎপরতা ছিল যে, একটু সময়ের জন্যও হানাদারদের বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হতো না। এমনিভাবে সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে চলে আসে ১১ ডিসেম্বর।
এদিন শিবপুরের মজনু মৃধার নেতৃত্বে খোদ নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। তার পরের দিন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর সকালবেলায় সংঘটিত হয় নরসিংদীর শেষ যুদ্ধ। নৌ সৈনিক সিরাজের নেতৃত্বে জিনারদী রেলস্টেশনের পুব পাশে পাটুয়া গ্রামে সংঘটিত এ যুদ্ধে ২১ জন হানাদার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী সম্পূর্ণভাবে মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়।
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী মুক্ত হওয়ার পর সেদিন বিকেলেই ৪ গার্ড রেজিমেন্ট ও মিত্র বাহিনীর ‘৩১১-মাউনটেন ব্রিগেড’ নরসিংদী অঞ্চলে পৌঁছয়। ১৩ তারিখে তারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। পরে ক্রমান্বয়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বহু কাঙ্ক্ষিত বিজয়। কিন্তু ১২ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এরই চারটি দিন নরসিংদীর এলাকাবাসীর কাটে মুক্তির অপেক্ষা, আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায়। কখন না আবার হয় আক্রমণ, থেমে যায় মুক্তির আনন্দ! স্বাধীনতার দীর্ঘ নয় মাসে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন থানায় শতাধিক যুদ্ধ, খণ্ডযুদ্ধ ও অসংখ্য অপারেশন হয়।
এসব যুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর নিপীড়ন-নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন নরসিংদীর ১১৬ বীর সন্তান। এর মধ্যে নরসিংদী সদরে ২৭, মনোহরদীতে ১২, পলাশে ১১, শিবপুরে ১৩, রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলায় ১৬ জন। সশস্ত্র যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে শত শত নারী পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা মনে হলে এখনও শিউরে ওঠে এলাকাবাসী।
দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পূর্বাংশের সংযোগস্থল মেঘনাবিধৌত নরসিংদী ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের খেতাবে ভূষিত হয়েছেন নরসিংদীর ছয়জন। তারা হলেন ফ্লাইট লে. শহীদ মতিউর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ, নেভাল সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ বীরপ্রতীক, লে. কর্নেল আব্দুর রউফ বীর বিক্রম, সুবেদার খন্দকার মতিউর রহমান বীর বিক্রম, বিগ্রেডিয়ার (অব.) এ এস এম নুরুজ্জামান বীরবিক্রম ও লে. কর্নেল (অব.) নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া বীরবিক্রম।
মহান মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর। এই দিনটি তাই নরসিংদীবাসীর কাছে একই সঙ্গে বেদনা ও আনন্দের।
লেখক: চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়