বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস: বৈষম্য ঘুচিয়ে মানবাধিকারের সুরক্ষা চাই

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৫:৫৪

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে পরিপূরক বলা যায়। একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে তোলে। গণতন্ত্র ছাড়া মানবাধিকার কল্পনা করা যায় না। আবার মানবাধিকার অবহেলা করে নিজেকে গণতান্ত্রিক বলেও দাবি করা যায় না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘ এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। মানবাধিকার কোনো নতুন কিছু নয়। জাতিসংঘ এই ধারণাটিকে শুধু একটি বিধিবদ্ধ রূপ দিয়েছে। যা একে বৈশ্বিকভাবে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের এই সনদের আলোকেই রাষ্ট্রগুলো নিজদেশের জন্য মানবাধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের সংবিধানেও মানবাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে।

বিভিন্ন বিষয়ে জাতিসংঘের অনেক সনদ থাকলেও মানবাধিকারের মতো এত জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বৈশ্বিক দলিল নেই। সম্ভবত জাতিসংঘ-সনদের চেয়েও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রটি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অনেক দেশের মানবাধিকারের মানদণ্ড নির্ণয় ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই দলিলটি রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে।

মানবাধিকারের এই সনদটির বয়স ৭৩ বছরে। এই ৭৩ বছরে বিশ্বে মানবাধিকারের ধারণা ও সূচকের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকারের সনদ ও জাতিসংঘ। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ব বড় কোনো যুদ্ধের মুখোমুখি হয়নি। বলা যায় এটিই জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় অর্জন। তবে বৈশ্বিক শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরালে জাতিসংঘ সনদ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রই কাজ করেছে।

এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়, ব্যাপক অর্থে মানুষে-মানুষে বৈষম্য কি কমেছে? এক কথায় এর উত্তর মেলে, না। ধনী-দরিদ্রের, ক্ষমতাশালী-ক্ষমতাহীনের মধ্যে বৈষম্য এখনও কমেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েই চলেছে। এক কথায় বলা যায়, মানবাধিকারের সংস্কৃতি এখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের খুব কম দেশ মানবাধিকারকে একটি সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে। যদিও ইউরোপ বা স্ক্যানডেনেভিয়ান কয়েকটি দেশ এমন দাবি করে থাকে।

ওই দেশগুলোতে উন্নত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে টেকসই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে পরিপূরক বলা যায়। একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে তোলে। গণতন্ত্র ছাড়া মানবাধিকার কল্পনা করা যায় না। আবার মানবাধিকার অবহেলা করে নিজেকে গণতান্ত্রিক বলেও দাবি করা যায় না। তবে, এ দুটোর অনুপস্থিতেও দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির শিখরে উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার না থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নতি ঠিকই আছে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উন্নয়নশীল কিছু দেশও সে পথেই অগ্রসর হতে চায়। কাজেই, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে যে গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের কোনো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে তেমনটি নয়। তবে নিঃসন্দেহে উন্নত অর্থনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আরও ভালোভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর মানবিক উন্নয়ন এক নয়। মানবিক উন্নয়নের সঙ্গে Human Dignity-র বিষয়টি জড়িত। আর উন্নয়ন সে তো প্রবৃদ্ধি ও আয়-ব্যয়ের হিসাব। পঞ্চাশের দশকে যে স্বপ্ন নিয়ে মানবাধিকার সনদ প্রণয়ন করা হয়, সেটি ওই মানবিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই। ৭৩ বছর পরে সেখানে অগ্রগতি কতটুকু হলো সেটিই দেখার বিষয়।

মানবিক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষার বিকাশ, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ও রাজনৈতিক সচেতনতার সম্পর্ক গভীর। এগুলোর বিকাশ ঘটলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা অস্বীকারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠতে পারে না। মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের ১ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সকল মানুষ স্বাধীনভাবে এবং সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা যুক্তি ও বিবেকের অধিকারী এবং ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে তাদের একে অপরের প্রতি আচরণ করা উচিত।’

এ অধিকারগুলো মানুষের জন্মগত অধিকার। অথচ সব মানুষের সমান স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার বাস্তবে একটি অবাস্তব বিষয়। কাজেই এই কথাটিকে একটি আদর্শ চেতনা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটিই ওই অনুচ্ছেদের মূল কথা।

সব মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন এটা বিশ্বাস করতে পারলে কোনো মানুষ বা জাতিগোষ্ঠীকে পরাধীন করে রাখা যায় না। অর্থাৎ, যেসব শাসকগোষ্ঠী এখনও বিশ্বের নানা প্রান্তে কোনো মানুষ বা জাতিগোষ্ঠীকে নির্যাতন-নিপীড়ন করছে, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতে শক্তি প্রয়োগ করছে; তারা মূলত মানুষের জন্মগত স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।

বলা যায়, বর্তমান বিশ্বে যে বৈষম্য তা মানুষের সহজাত স্বাধীনতার অবিশ্বাস থেকে জন্মলাভ করেছে। তাই বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আগে মানবাধিকারের আদর্শপাঠ জরুরি। মানবাধিকরের চেতনা ও আদর্শ উপলব্ধি ব্যতীত বিচ্ছিন্নভাবে মানবাধিকারের সূচক পরীক্ষা করা ও সে অনুযায়ী বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

জাতি-বর্ণ, লিঙ্গ-ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্যান্য মতাদর্শ, জাতীয় বা সামাজিক সূত্র ও অন্যান্য মর্যাদা-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই সমান। সব মানুষের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতি ছাড়া বিশ্বে শান্তি-স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি রচনা করা সম্ভব না। অভাব ও শঙ্কামুক্ত জীবনাচারের মধ্যে মানুষ ধর্ম ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বিশ্ববাসী মানবাধিকার, মানব দেহের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী-পুরুষের সমান অধিকারের প্রতি তাদের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছে। এটি একটি বৈশ্বিক অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারই মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাসমূহের ভিত্তি তৈরি করে।

মানবাধিকারে সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি ধারা রয়েছে। মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে বিশ্ববাসীর অঙ্গীকারগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সেখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রটিকে মানবাধিকারের মৌলিক নীতিমালাও বলা যায়। জাতিসংঘের অপরাপর মানবাধিকার-সংক্রান্ত দলিলগুলোও এই সনদকে অনুসমর্থন করে। বিভিন্ন দেশও এই সনদের অনুসমর্থনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানেও রয়েছে এই ঘোষণাপত্রের ছায়া। এমনকি দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে।

সংবিধানের বাইরেও মানবাধিকার বাস্তবায়নের জন্যে এদেশে বিভিন্ন আইন রয়েছে। মানবাধিকার একটি বিস্তৃত ধারণা। কাজেই, কোনো একটি আইন দিয়ে একে সীমাবদ্ধ বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। পৃথকভাবে শুধু মানবাধিকার বাস্তবায়ন তদারকির জন্য ২০০৭ সালে একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। এর আলোকে, ২০০৯ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন প্রণয়ন করা হয়।

১২ বছরে কমিশনের অর্জন কী এ প্রশ্ন করাই যায়। দেশে মানবাধিকারের উন্নয়ন কতটুকু সেই প্রশ্নও। তবে সব প্রশ্নেরই উত্তর নিহিত রয়েছে দেশে মানবাধিকারের চেতনাগত উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তার ওপর। চেতনাগত বা আদর্শিক অবস্থানের উন্নয়ন হয় মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা দিয়ে। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মানবাধিকারের চেতনা তুলে ধরতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবাধিকার উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি জনবল-সংকট ও আইনগত দুর্বলতা রয়েছে। এরপরও মানবাধিকার রক্ষায় এটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মানবাধিকার বাস্তবায়নে সরকার তথা প্রশাসনের ভূমিকাই বেশি। এটি লঙ্ঘনের ব্যাপারে এদের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও জনবলের অভাবের কারণে, মানবাধিকার কমিশনের পক্ষে দেশের সর্বস্তরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়।

এছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় সাধারণ নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ নয়। আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। কিন্তু তারপরও আদালত ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু, অনানুষ্ঠানিক বিচার পাওয়ার সুযোগ আরও বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এটি সম্ভব। এক সময় গ্রাম্য শালিশিব্যবস্থায় অনেক বিষয়ই সুরাহা হতো। এখন সে পথ প্রায় বন্ধ। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবেই মানুষের অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। বিশাল জনবহুল একটি দেশের জন্য আনুষ্ঠানিক বিচারালয়ে শুধু মামলার জটই বাড়ছে। বিলম্বিত হচ্ছে ন্যায়বিচার।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি আধা বিচারিক প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ এলে কমিশন সরকারসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারে। কমিশনে বর্তমানে ৩৫-৪০ জন কর্মকর্তা–কর্মচারী আছে। এই জনবল দিয়ে মানবাধিকার বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সমন্বয়ও সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও তাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। কমিশনের সদিচ্ছা নিয়ে এর আগেও হাইকোর্ট প্রশ্ন তুলেছে।

২০১৩ সালে গৃহকর্মী খাদিজাকে গৃহকর্তা কর্তৃক অমানুষিক নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরে কমিশনের কাছে প্রতিকার চাওয়া হয়। কিন্তু কমিশনের কার্যক্রম সন্তুষ্ট হতে না পেরে ভুক্তভোগী ২০১৮ সালে কমিশনের বিরুদ্ধে সিসিবি ফাউন্ডেশন একটি রিট দায়ের করে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট উক্ত রিটের রায়ে মন্তব্য করেন- “কমিশন গাফলতির পরিচয় দিয়েছে। মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে’।” হাইকোর্ট তখন আরও বলেছিল, সরকার যদি কমিশনের সুপারিশ না শোনে তবে কমিশন যেন হাইকোর্টের কাছে আসে।” কিন্তু কমিশনের কার্যক্রমে গতি এসেছে বলে মনে হয় না। সদিচ্ছার অভাব সক্ষমতার অজুহাত দিয়ে ঘোচানো যায় না।

কাজেই, কমিশনকে সদিচ্ছা ও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এবারের মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য-বৈষম্য ঘোচাও সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও। মানবাধিকার কমিশন এই প্রতিপাদ্য নিয়ে কাজ করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। কমিশনকে তার সাধ্যানুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকেও শুধু তার নিজের অধিকারই নয়, সবার অধিকার মানে মানবাধিকার বিষয় সচেতন হতে হবে।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর