একসময়ে দেশে প্রতিবন্ধীদের সমাজের বোঝা হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই দিন বদলেছে। দেখা যাচ্ছে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নন।একটু মমতা পেলেই তারা নিজেদের তুলে ধরতে পারেন। দেখাতে পারেন নিজের যোগ্যতা। এদেশে এমনই এক বাস্তবতা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন একজন। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কন্যা সুযোগ্য উত্তরসূরি সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। যিনি সমাজসেবায় এগিয়ে চলছেন মায়ের দেখানো পথেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কন্যা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্মদিন আজ। ১৯৭২ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সায়মা ওয়াজেদ দেশে ‘পুতুল’ নামে পরিচিত। সারা বিশ্বে অটিস্টিক শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন পুতুল।
তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য। একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়বিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পায়। মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকস-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন।
তিনি ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন। পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১-এ ঢাকায় প্রথমবার অটিজমের মতো অবহেলিত একটি বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী অংশগ্রহণ করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশে ‘নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট ২০১৩’ পাস করা হয়। সেই সঙ্গে তার প্রদান করা পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই জাতিসংঘ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালে সায়মা ওয়াজেদকে ‘এক্সেলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলিতে অটিজমের বিষয়টি তিনিই সংযুক্ত করেন। বাংলাদেশে অটিজম-বিষয়ক বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে অটিজম-বিষয়ক ‘শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ কাজ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশেষত বাংলাদেশে অটিজম-সংক্রান্ত ধারণা দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। বর্তমানে অটিজম নিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সবার মধ্যে বেড়েছে সচেতনতা। বাংলাদেশেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় অটিজম-আক্রান্তরা নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
তিনি ২০০৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে অটিস্টিক শিশুদের অধিকার ও শিশুদের অটিজম-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ করে আসছেন। সায়মা ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘের অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন। তিনি জাতিসংঘ আয়োজিত ‘অ্যাড্রেসিং দ্য সোসিওইকোনমিক নিডস অব ইনডিভিজুয়ালস, ফ্যামিলিস অ্যান্ড সোসাইটিজ অ্যাফেকটেড বাই অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডারস, ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনম ক্ষেত্রপাল সিংয়ের উদ্যোগে এ অঞ্চলের ১১টি দেশের জন্য অটিজম-সংক্রান্ত ব্যক্তিদের কল্যাণে নিরবচ্ছিন্ন ও উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে অটিজম-বিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনোনীত হন। এ ছাড়া সায়মা ওয়াজেদ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের একজন মনোনীত (সিভিএফ) ‘থিমেটিক দূত’।
এরই মধ্যে সায়মা বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে সায়মা ওয়াজেদ পরিচালিত ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এক ইতিবাচক পরিবর্তনের বাতিঘর। তাই অটিজম, সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল এবং বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা।
সায়মা ওয়াজেদ একজন সুবক্তা ও লেখক বটে। মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিক্সের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে মানসিক ভারসাম্য ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার ইস্যুতে বড় ধরনের অবদান রেখেছেন।
সমাজ ও পরিবারে মেয়েদের কোণঠাসা, নির্যাতিত অবস্থার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকন্যা সদা সোচ্চার এক কণ্ঠস্বর। এ ব্যাপারে তার স্মরণীয় উক্তি: ‘আমরা মেয়েরা কেন অস্বস্তিতে থাকব? আমরা কেন ভয়ে থাকব? আমাদের কেন এভাবে চলতে হবে, আর তা না হলে আমাদের দোষ দেয়া হবে? আমাদের ছোটবেলা থেকে ভয় নিয়ে কেন বড় হতে হবে? আমরা সাহস নিয়ে কেন চলতে পারব না?’
গেল বছর আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘পাবলিক প্লেসে নারীর নিরাপত্তা’ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানের উদ্বোধনী বক্তব্যে সায়মা ওয়াজেদ বলেছেন, ‘হ্যাঁ, সেলফ প্রটেকশন স্কিলস জানা উচিত, অফকোর্স। কিন্তু আমাদের কেন এভাবে থাকতে হবে?
কেন আমরা জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে চলব? আমরা মেয়ে বলে কেন ভয়ে চলতে হবে? এক্সট্রা কেয়ারফুলি চলতে হবে, অন্যভাবে চলতে হবে? আমাদের যেটা মনে চায়, যেটা ইচ্ছা, যেটা আমরা করতে পারি, সেটা কেন আমরা করতে পারব না?’
সায়মা ওয়াজেদ আরও বলেছেন, ‘আমাদের দেশকে যেন আমরা এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যেখানে কোনো মেয়ে হয়রানির শিকার হবে না। কোনো মেয়ের অশ্রদ্ধাও হবে না। আমরা যেন সম্মানের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি। যে যেটার স্বপ্ন দেখছি, যেটা করতে চাচ্ছি মন খুলে যেন এটা করতে পারি। সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ছোটবেলা থেকেই নারী-পুরুষের সমতার শিক্ষা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’
সায়মা অটিজম-সংক্রান্ত ব্যক্তিদের কল্যাণে নিরবচ্ছিন্ন ও উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনম ক্ষেত্রপাল সিংয়ের উদ্যোগে এ অঞ্চলের ১১টি দেশের জন্য এ পুরস্কার চালু করা হয়। সায়মার উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলিতে অটিজমের বিষয়টি তিনিই সংযুক্ত করেন।
তিনি ২০১১ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি প্যানেলের একজন সদস্য হন। তার উদ্যোগে ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অটিজম-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সায়মা বাংলাদেশে স্বাস্থ্য এজেন্ডায় অটিজমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে আন্তরিক প্রচেষ্টা নেন। অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার এবং অন্যান্য মানসিক ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বিষয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আকর্ষণে সহায়তা করার জন্য ২০১৭ সালে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে অটিজমবিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনোনীত হন।
সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অটিজম ও স্নায়ুবৈকল্য-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি এ দেশের প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদান, তাদের জীবন অর্থবহ করার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অটিজম মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই তার কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অটিজম বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথমে নিজ মাতৃভূমিতে, পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তিনি কাজ করেন।
তার পরিচালিত ‘সূচনা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ‘নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ ২০১৩ সালে পাস করা হয়। বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের পথে সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এক আলোকবর্তিকা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক