বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টি নিষ্পত্তি হোক

  •    
  • ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:২০

শুধু হিজড়া ইস্যুতেই নয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০১৯-এর আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে ’পুত্র’ বা ’কন্যা’র পরিবর্তে আইনে শুধু ‘সন্তান’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতে করে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার হবে না। এরকম মানবিক ও নিরপেক্ষ চিন্তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

দেশের হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী বাবার সম্পত্তিতে অধিকার পেতে পারেন, এরকম একটি কথা আমরা কখনও কল্পনাও করতে পারিনি, অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাই বলেছেন এবং করে দেখাতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তি আইন মুসলিম অনুযায়ী চলে। এদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী কখনও বাবা-মায়ের সম্পত্তি পাওয়ার কথা স্বপ্নেও দেখেনি। সবসময়, সবক্ষেত্রেই তারা অধিকারবঞ্চিত। পরিবার-সমাজ, রাষ্ট্র কোথাও তাদের স্থান ছিল না। বাবা-মা মারা গেলে, তাদের শূন্যহাতে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। এবার প্রধানমন্ত্রীর নেয়া এই উদ্যোগ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমন একটি আইন প্রণয়নের কথা সরকার ভাবছে, যাতে হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ হিজড়া রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে তারা ভোটাধিকারও পেয়েছে তৃতীয়লিঙ্গ হিসেবে।

শুধু হিজড়া ইস্যুতেই নয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০১৯-এর আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে ’পুত্র’ বা ’কন্যা’র পরিবর্তে আইনে শুধু ‘সন্তান’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতে করে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার হবে না। এরকম মানবিক ও নিরপেক্ষ চিন্তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

এ প্রসঙ্গে মনে হলো স্বনামখ্যাত আইনজীবী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর কথা। আবদুল মতিন খসরুর সঙ্গে আমার দু’একবার কথা হয়েছিল, একটি দৈনিকে কাজ করার সময়। সেসময়ে আমি তার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম উত্তরাধিকার আইন নিয়ে এবং সেজন্যই ওনার কথা মনে হলো। দৈনিকটিতে ওই সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে কেন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দেয়ার বিধান কায়েম করেন না? আপনাদের সরকার তো আইনে অনেক ধরনের প্রগতিশীল পরিবর্তন এনেছে?

তিনি আমার কথা উত্তরে বলেছিলেন- নানা কারণে আমাদের হাতপা বাঁধা। তাই চাইলেও সরকার এরকম ইতিবাচক একটি পরিবর্তন আনতে পারবে না। আমার নিজের এক ছেলে, এক মেয়ে। আমি মনেপ্রাণে চাই দুজনকে সমানভাগে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যেতে। আমি বাবা হিসেবে দুজনকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু আমারও হাতপা বাঁধা। পারছি কই উত্তরাধিকার আইনে কোনো পরিবর্তন আনতে?” তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন সাক্ষাৎকারের বাইরে, অফ দ্যা রেকর্ড-এ।

নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০ এবং সংশোধন-২০০৩ আইনটি মতিন খসরু সাহেবের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। তিনি নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ আইভি রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং নারীর অধিকার আদায়ে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। হয়তোবা আরও বেশ কিছু সময় আইনমন্ত্রী থাকার সুযোগ পেলে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আরও কিছু করে যেতে পারতেন।

আওয়ামী লীগ সরকার যখন ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, তখন নারী উন্নয়ন নীতি-১৯৯৭-এর ৭.২ অনুচ্ছেদে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকারের কথা বলা হয়। ইচ্ছে করলেই হয়তো সরকার একটি আইন পাস করতে পারত বা নীতি গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু না, তারা তখন সেটা করতে পারেনি। বোঝা যায় নব নির্বাচিত সরকার হয়তো এত বড় ঝুঁকি নিতে চায়নি।

আর এর ফলে আমাদের পেতে হলো বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়কার নারী উন্নয়ন নীতির দ্বিতীয় খসড়া ২০০৪ সালে। তৎকালীন সরকার উত্তরাধিকার আইনে ও ভূমির উপর অধিকারের অংশটি কেটে দিয়েছিল। আমরা তৃতীয় খসড়াটি পেয়েছিলাম ২০০৮ সালে। সে যাক, অনেক জল ঘোলা হয়েছে এই নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে। এমনকি কেয়ারটেকার সরকার পর্যন্ত আলেমদের নিয়ে কমিটি করেছিলেন নীতিটি যাচাই-বাছাই করার জন্য। ফলে একদিন নীতিটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবসময়ই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নারী উন্নয়ন নীতিতে সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিয়ে নীরবতা প্রদর্শন করেছে। (সূত্র: দি ডেইলি স্টার, নিবন্ধ: প্রফেসর ড. কাবেরি গায়েন)

মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো উত্তরাধিকার আইনে যখন সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে আসছে। মুসলিম পরিবারে যে বাবামায়ের শুধু কন্যা সন্তান রয়েছে, তারা জানেন নিজের আত্মজাকে নিজের সম্পত্তিটুকু দিয়ে যেতে কতটা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। হয় তাদের জীবদ্দশায় হেবা করে দিয়ে যেতে হয় বা উইল করে দিতে বাধ্য হন।

যদিও এই পদ্ধতি বাবামায়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাও মানুষ এই পদ্ধতির দিকেই হাঁটছেন, নয়তো কন্যা সন্তান কখনই আইনত বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির শতভাগের মালিক হতে পারবে না। তার বাবার ভাইয়ের ছেলে সন্তানরা এর থেকে ভাগ পাবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে আমরা সবসময় বলছি, দুই সন্তানই যথেষ্ট। সেখানে কারো যদি দুটিই কন্যা সন্তান হয়, তখন সেই পরিবার কী করবে? কাজেই সবকিছুই বাস্তবতার নিরিখে ভাবতে হবে।

কোনো মাবাবাই তাদের সন্তানদের মধ্যে ফারাক করেন না বা করতে চান না। কোনো বাবা কি তার মেয়ে সন্তানকে কম ভালোবাসেন, নাকি কম যত্ন করেন? আইনে আছে বলে তারা বাধ্য হন এভাবে ভাগ করে দিতে। আজকাল মেয়েরাও বাবামায়ের প্রতি অনেক দায়িত্ব পালন করেন। অনেকে পুরো দায়িত্বই পালন করেন।

আমার জানামতে, উদাহরণ দিই। হাসনা, সে কাজ করে হংকংয়ে গৃহ সহযোগী হিসেবে। যখন থেকে মেয়েটি কাজ করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই ওর বেতনের সব টাকা দিয়ে বাবামায়ের সংসার টানত। গত চার বছর যাবৎ হংকংয়ে কাজ করে ভাইবোনদের পড়াশোনা, বাবামায়ের চিকিৎসা, ভিটায় পাকা বাড়ি তোলার কাজ, সব করেছে। সেক্ষেত্রে এই মেয়ে কি বাবার সম্পত্তিতে সমান ভাগ দাবি করতে পারে না? কিংবা বাবার কি ইচ্ছা করতে পারে না যে, তিনি তার এই মেয়েকে নিজের সম্পত্তিতে সমান ভাগ দেবেন?

এরকম অনেক কন্যা সন্তানই আছেন, যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবামা, ভাইবোনের পাশে থাকেন। আমার এক বন্ধুকে এমনও দেখেছি যে ছেলে সন্তান নেই বলে বিছানায় শায়িত বাবাকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নিজের কাছে রেখে দেখাশোনা করেছে। এই বাবার সম্পত্তিতে আর কার অধিকার থাকা উচিত? আর কেউতো এসে ওনাকে দেখা শোনা করেনি, কোনো খরচও করেনি তার চিকিৎসার জন্য। এরকম শত শত উদাহরণ আছে আমাদের সমাজে, আমাদের দেশে।

সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী বার বার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংরক্ষণের কথা বলেছেন। তিনি এ-ও বলেছেন পিতার অর্জিত সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে যেন শরিয়া আইনের অপব্যবহার করা না হয়। বিচারপতিদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন যে, হ্যাঁ আমরা শরীয়া আইন মেনে চলব, সেই সঙ্গে এমন কোনো উপায় বের করতে হবে, যেন ইসলামি আইনের নাম ব্যবহার করে নারীকে কেউ স্বামী ও পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে না পারে। যদিও ইসলাম নারীকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে কিন্তু সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরা বোনকে বঞ্চিত করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমরাও কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাইছি যে, আমরা কাউকে শরিয়া আইন পরিবর্তন করতে বলছি না। কিন্তু সম্পত্তি আইন ধরে এই বিষয়টির নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তিনি নিজেই অনেক ইসলামি চিন্তাবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তারা অনেকেই বিষয়টিতে তাদের সম্মতি জানিয়েছেন।

এবার প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, এর চাইতে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের ইতিহাসে সেই দেশ, যে দেশে বার বার নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। কোনো দিক থেকে কোনো বাধা আসেনি। ‘আদর্শ মসজিদ’ও উদ্বোধন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। যারা ‘ধর্ম গেল’ বলে শঙ্কিত থাকেন, তাদের বুঝতে হবে সময়ের আবর্তে অনেক ধর্মীয় মতবাদ ও আইনি নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে এই দেশেই ইসলামি দলগুলো বহুবার নারী নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, শপথ নিয়েছে। ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া ১৯৩৭ সালের মুসলিম পারসোনাল আইন (শরিয়া আইন) পাকিস্তান আমলে এসে পরিবর্তন করা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে। যেমন, দাদা বা নানার সস্পত্তিতে, নাবালক সন্তানের সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার কার্যকর হয়েছে, এখন চাইলেই কোনো মুসলিম একসঙ্গে চারটি বিয়ে করতে পারে না। তাকে নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

হিল্লা বিয়েও অনেক কঠিন করা হয়েছে এবং সর্বোপরি মুসলিম নারী তার স্বামীকে কারণ উল্লেখ করে এবং চার বছর নিরুদ্দেশ থাকলে তালাক দিতে পারেন। অনেকে ফতোয়া দিয়েছেন যে ছবি তোলা হারাম, সেটাও উঠে গেছে কাজের প্রয়োজনে। হজে যেতে চাইলে ছবি তুলতেই হবে। এসব নানা ধরনের উদাহরণ দেয়া যাবে।

আমরা চাই এদেশের মেয়েরা বাবার সম্পত্তির ভাগ ছেলেদের সমান পাক। বাবার অর্জিত সম্পত্তি ছেলে সন্তান না থাকলেও মেয়ে ও স্ত্রীর মধ্যে পুরোটা ভাগ হবে। এটাই এই সময়ে ন্যায্য। আমরা জানি ‘ইসলাম মানে ইনসাফ’। এই সত্যটি মানতেই হবে। শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, একটি ইউনিফর্ম আইন হওয়া দরকার, সব ধর্মের মানুষের জন্য। বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই সিভিল ল আছে, আবার শরিয়া আইনও আছে। যে পরিবার, যেভাবে সুবিধা পাবেন, তারা সেভাবেই সম্পত্তি ভাগ করবেন।

প্রধানমন্ত্রী, আপনি বাংলাদেশের নারীদের সবক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে দিয়েছেন, কাজেই এই কাজটুকু আপনার হাত দিয়েই হবে বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর