বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বানর ও হাতি নিধন বন্ধ হোক

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ৩০ নভেম্বর, ২০২১ ১৭:২২

হাতি তার শারীরিক শক্তি ও আকার নিয়ে যত সহনশীল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিজপরিসরে বসবাস করে আসছে তা অতুলনীয় ব্যাপার। হাতি তার শ্রেষ্ঠত্বে কখনও উন্মাদ হয়নি। নিজেকে সংযত করে অন্যদের সঙ্গে সখ্য ও ভারসাম্য বজায় রেখে প্রাণিরাজ্যে বাস করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া হাতি লোকালয়ে আসেনি, তার দরকার হয়নি। মানুষ সে পরিস্থিতি আজ তৈরি করেছে। তাকে লোকালয়ে আসতে বাধ্য করছে।

‘‘আমাদের ঘরে ঘরে প্রতিনিয়ত চলছে হত্যাকাণ্ড। আমরা মশা মারি, মাছি মারি, পিঁপড়ে মারি, ছারপোকা মারি আর মারি তোলাপোকা-ক্বচিৎ ইঁদুরও। আর খাদ্য হিসেবে পশুপাখি ও সবজি হিসেবে এবং ফল হিসেবে উদ্ভিদও মারি। কাজে হত্যা দিয়ে হনন দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জাগ্রত মুহূর্তগুলো কাটে’’-আহমদ শরীফ-এর ডায়রি; ভাব-বুদ্বুদ; জাগৃতি প্রকাশনী (২য় সংস্করণ; ২০১৫)।

তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে আরও বলছেন- হত্যা অরণ্যের মাঝে/হত্যা লোকালয়ে/হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে/কীটের গহ্বরে/অগাধ সাগরে জলে/নির্মল আকাশে/হত্যা জীবিকার তরে/হত্যা খেলাচ্ছলে/হত্যা অকারণে/হত্যা অনিচ্ছার ফলে।

আহমদ শরীফ-এর আরও আহবান- হত্যা এড়ানোর যুগান্তর আসন্ন, হত্যা কমানোর প্রয়াস আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

সম্প্রতি হাতি হত্যাকাণ্ড বেড়ে চলেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বছরে তিন থেকে চারটি করে হাতি হত্যার শিকার হতো। ২০২০ সালে ১২টি হাতি হত্যা করা হয়। এ বছর ইতোমধ্যে হাতিহত্যার সংখ্যা ৩৩-এ দাঁড়িয়েছে । বন দখলকারী একটি চক্র ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে হাতি হত্যা করাচ্ছে, শেরপুর, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে একই কায়দায় হাতি হত্যা করা হচ্ছে। বিষয়টি আদালতের নজরেও আনা হয়েছে।

হাতিহত্যার জন্য ভাড়াটে খুনিদের কাজে লাগানো হচ্ছে এবং নেপথ্যে কাজ করছে বনভূমি দখল। দখলের মনোবাসনা আজ এতটাই তিব্র যে, অভয়ারণ্য-জল, জঙ্গল-তরঙ্গ সবকিছু করয়াত্ত করার হিংস্র বাসনা পেয়ে বসেছে আমাদের। জনমনোভঙ্গি হলো- প্রকৃতিতে কেবল মানুষ থাকবে আর কেউ না। একেই বলে একীকরণ প্রক্রিয়া। অর্থাৎ একক অবস্থান। মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করার যোগ্যতা হারাচ্ছে।

প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের গুরুত্ব সে মুখে মুখে আলোচনা করে, সভা-সেমিনার করে, জাতীয় ও আন্তজার্তিক ফোরামে নানা নীতি-কাঠামো বানায় কিন্তু দিনশেষে এগুলো কাজে লাগছে না। প্রাণী অধিকার আজ কাগজ ও ক্যাবিনেটে-বন্দি। একটা কাগজ উৎপাদন করে তা বন্দি করতে পারাতেই পৌরুষত্ব। দিনে দিনে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের গুরুত্ব মূল্যহীন হয়ে উঠছে। হৃদয়হীন কংক্রিট দিয়ে সবুজ অরণ্য ও তার অনুষঙ্গ বধের অপতৎপরতা চলছে সবখানে। বাংলাদেশ হলো আজ অনেকগুলো নিষ্ফলা দলিলের সমষ্টি।

মানুষের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে জানাশোনার পরিধি যত বাড়ছে, অনুভূতির ব্যাপ্তি তত ছোট হচ্ছে। প্রকৃতিতে বিরূপ এক বন্যতা জেঁকে বসেছে। মানুষের মনুষ্যত্বের চেয়ে তার প্রাণিত্ব বড় হয়ে উঠছে। মানুষের প্রথম পরিচয় প্রাণী; প্রাণী হিসেবে মানুষ কাম-ক্রোধ, লোভ-মোহ, মদ-মাৎসর্যে চালিত হয় আর মানুষ হিসেবে সে কৃপা-করুণা, দয়া-দাক্ষিণ্য সংযমে, সহিষ্ণুতায় বিবেকানুগত্য ও ন্যায্যতা-ক্ষমা, ধৈর্য-অধ্যবসায়, আদর্শনিষ্ঠায় অসামান্য হয়ে ওঠে (পূর্বোক্ত)।

মনুষ্যত্বের পরিচয় ডিঙিয়ে যদি প্রাণিত্বের পরিচয় বড় হয়ে ওঠে অর্থাৎ লোভই যদি শাসনের সূচক হয় তাহলে তো বুঝতে হবে আমরা এক বড় চোরাবালিতে আটকে পড়েছি। কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতির সংজ্ঞায় যর্থাথই বলেছেন- একজন সংস্কৃতিমান মানুষের পক্ষে অন্যায় নিষ্ঠুরতা দেখানোও সম্ভব নয়। অর্থাৎ যেখানে নিষ্ঠুরতা সেখানে অসভ্যতা বা বর্বরতা। শুভ্রতার বিপরীতে অশুভ্রের সাধনায় আমরা নিবিষ্ট হয়ে পড়েছি। স্বার্থ ও লোভের সাধনা আজ মূল প্রেরণা।

জনমনস্তত্ত্বে হিংস্রতার বসতবাড়ি, যেখানে কোনো সংবেদের উপলক্ষ নেই। অপরিশোধিত মানুষের ঘনবসতি আজ বাংলাদেশ। বিযুক্তি ও হননের তিব্র আকাঙ্ক্ষার লকলকে জিভ চারদিক। লোভের বাসনা এমন রোগ যা থাকলে আর কোনো অসুখ লাগে না। এ নীচুতা কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের পাবলিক সাইকিকে।

একটি প্রাণ যখন আরেকটি প্রাণ হনন করতে চায় তখন তার চেয়ে করুণ বিষয় আর কিছু হতে পারে না। হনন পূর্বপ্রস্তুতি মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচয়টি আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অমানুষ করে তোলে। অর্থাৎ যেকোনো হনন অপপ্রয়াস একটি সাংঘাতিক বন্যপ্রস্তুতি। এক প্রস্তুতিচর্চা আজ একক ও যৌথ, কূটকৌশলে। অর্থাৎ এ বিমানবীকরণ প্রচেষ্টা একক কোনো তৎপরতা নয়, ক্ষুদ্র দলীয় বা বড় স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কালো অন্তর্জাল।

শুভ কাজের তুলনায় অশুভ কাজে বাঙালির পেশাদারী উৎকর্ষ আজ বেড়েছে অনেক গুণ। থাকছে অভিনব সব অপকৌশল। অপরাধ কৌশলে অভিনবত্ব ও সংযুক্তি বিস্ময় জাগায়। মানুষরূপী এসব কীটদের জঘন্য মানসিকতা পাঠের অযোগ্য।

হাতি তার শারীরিক শক্তি ও আকার নিয়ে যত সহনশীল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিজপরিসরে বসবাস করে আসছে তা অতুলনীয় ব্যাপার। হাতি তার শ্রেষ্ঠত্বে কখনও উন্মাদ হয়নি। নিজেকে সংযত করে অন্যদের সঙ্গে সখ্য ও ভারসাম্য বজায় রেখে প্রাণিরাজ্যে বাস করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া হাতি লোকালয়ে আসেনি, তার দরকার হয়নি। মানুষ সে পরিস্থিতি আজ তৈরি করেছে। তাকে লোকালয়ে আসতে বাধ্য করছে।

হাতির শরীরের স্নিগ্ধতা ও সারল্য যে অনুভব করেনি তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে আছে! আফ্রিকান এক প্রবাদে বলা হয়েছে, হাতি নিজদায়িত্বে তার শুঁড় বয়ে বেড়ায়। অর্থাৎ নিজদায়িত্ব সম্পর্কে হাতি খুব সচেতন এবং সে তা সুচারুভাবে প্রতিপালন করে। বলা হয়, পৃথিবীর স্থলভাগের সবচেয়ে বড় কিন্তু ক্ষতিকর নয় এমন একটি প্রাণী হলো হাতি। হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও দায়িত্বশীল প্রাণী।

বাঙালির কাছে স্বার্থ যখন মুখ্য তখন গুণবিচার মূল্যহীন। শক্তির বিবেচনায় বন দখলে সে হাতিকে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। হাতিকে সরাতে পারলে বন দখল তার সহজ হয়। কিন্তু বাস্তবতা হাতিকে স্মৃতিহীন বা ইতিহাস থেকে মিলিয়ে দেয়া খুব সহজ নয়। এরা সভ্যতার এক অপরিহার্য অংশীদার।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, হাতিহত্যার অনুকুলে সমাজে অনেক আগেই একটি প্রাধান্যশীল আখ্যান বা ডমিনেন্ট ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে যেমন- হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা। এ আখ্যানের মূল বিষয় হলো জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় হাতির মূল্য সমান। হাতির জীবন ও মৃত্যুকে অর্থমূল্য দিয়ে সমান করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্যালকুলেশনে মূল ফ্যালাসি বা ভ্রান্তি হলো হাতির জীবনের মূল্যটি উপেক্ষিত থেকেছে। কেবল অগ্রাধিকার পেয়েছে তার আকার বা শরীর।

মানুষের ন্যারেটিভের প্যান্টার্নগুলো এরকমেরই যা তার আধিপত্য, ক্ষমতা সর্বোপরি নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে সহায়তা করে। আমরা যদি হাতির দিক থেকে মানুষ নিয়ে আখ্যানগুলো শুনতে পেতাম তাহলে হয়ত ভিন্ন বাস্তবতা উৎপাদিত হতো। প্রাণীদেরও মনস্তত্ত রয়েছে।

ইজরাইলের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ইয়ুভেল নোয়াহ হারারি গরুর মানসিক অবস্থা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। একে তিনি বলছেন বোভাইন ম্যান্টালিটি। হাতির যে রয়েছে এক গভীর মনোকাঠামো তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

যুগপৎভাবে, গত অক্টোবর মাসে সংবাদমাধ্যমে কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রায় ৫০টি বানর হত্যা করার খবর প্রকাশিত হয়। বানরগুলো স্থানীয় এক কৃষকের ফাঁদ হিসেবে রাখা বিষাক্ত কলা খেয়েছিল। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, বড় মহেশখালীর পাহাড়–জঙ্গলে হাজারো বানরের বসবাস। বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় বানরগুলো খাদ্যসংকটে পড়ে। মাঝেমধ্যে বানর দল বেঁধে হানা দেয় স্থানীয় লোকজনের খেতে। বানরগুলোর এ আচরণকে তারা চিহ্নিত করেছে ‘উপদ্রব’ হিসেবে।

ক্রমশ বনভূমি কমে যাওয়া ও খাদ্যসংকটের কারণে বানরগুলো লোকালয় ও ফসলের খেতে ঢুকে পড়ছে। বনভূমিতে অবৈধ মালিকানা স্থাপন করে বানরগুলোর বসবাসের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। বন্যপ্রাণীদেরও যে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।

বানরের ক্ষেত্রেও ভিকটম ব্ল্যামিং চলছে। সব দোষ বানরের। আমরা যেমনটি বলি বাঁদরামি করবে না। বানরের আচরণকেও আমরা লেবেলিং করেছি। তাদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে হত্যার পথ তৈরি করেছি। জীবন নাশ তো শেষ অস্ত্র কথা নয়। এর আগে কিছু বিকল্প ভাবা যেত?

প্রাণীদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদাসনীতা বা শৈথল্য বেদনাদায়ক। প্রাণী-পাখি-উদ্ভিদ সুরক্ষায় বন বিভাগের এখতিয়ার ও দায়িত্ব বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এ থেকে উত্তরণে পরার্থবোধ বা অন্যের জন্য কল্যাণবোধের জাগৃতি জরুরি। প্রতিটি প্রাণ অমূল্য। আমরা তা কেড়ে নিতে পারি না।

শেষান্তে আবারেও স্মরি আহমদ শরীফকে- পিঁপড়ে থেকে হাতি, তিমি অবধি সবার প্রাণের ও জীবনের মূল্য ও মমতা সমান- এ তত্ত্ব, তথ্য ও সত্য অনুভব ও উপলব্ধি করতে হবে। তা করতে হবে একটি বৈচিত্র্যময়, সহাবস্থান মূলত নিরাপদ প্রকৃতিবলয় গড়ে তোলার স্বার্থে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

এ বিভাগের আরো খবর