ডিসেম্বর কড়া নাড়ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ এখন অস্তাচলে। দিন যায় কিন্তু কিছু স্মৃতি, কিছু অবিস্মরনীয় ঘটনা থেকে যায়। সেসব কেউ ভোলে, কেউ মনে রাখে। যারা ভোলে না তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারে। অনেকের দুর্ভাগ্য এই যে, তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে না। আর করে না বলেই মারাত্মক ভুলের ফাঁদে পড়তে হয়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর গৌরবময় ২০২১ সাল চলে যাবে কিন্তু রেশ থেকে যাবে। ২০২২ সালেও মনে পড়বে করোনা মহামারির তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড সময়ের কথা। এই দুর্যোগ ছাড়াও মনে পড়বে রাজনৈতিক অবক্ষয়জনিত দুর্ভোগের নানা স্মৃতি।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে পেছনে তাকালে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো একটি আনন্দমুখর স্থানীয় নির্বাচন কীভাবে সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছে ২০২১ সালে। সেই অবাঞ্ছিত বাস্তবতা নিয়েই শুরু হবে ২০২২ সাল। পর নতুন বছর। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তৃতীয় ধাপের যে ইউপি নির্বাচন, সেখানে কি থাকবে না এমন দুঃখজনক সহিংসতার ঘটনা? এই গ্যারান্টি তো নেই।
সড়ক পরিবহনের সৃষ্ট অনিয়মের কারণে সারা বছর যে কত প্রাণ ঝরে গেছে সেসব দুঃখজনক অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু যাওয়া যাবে না। যারা পরিবহন সেক্টর সুশৃঙ্খল করতে পারত, তারা সক্রিয় হবে না। যদি সরিষাতেই ভূত থাকে তাহলে সেই সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না। সবকিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ লাগে! বাংলাদেশে এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার! গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে। বহু বছরের চলে আসা এই নিয়ম এখন মেনে নিতে রাজি নয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকপক্ষ। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এক সাবেক মন্ত্রী, যিনি পরিবহন সেক্টরেরও শীর্ষপর্যায়ের নেতা, বললেন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলবেন, তাই মেনে নেব আমরা।
শিক্ষার্থীরা সমস্ত গণপরিবহনে হাফ ভাড়ায় চলাচল করবে, এটা তো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দাবি ছিল না। কিছুদিন আগেও এ নিয়ম চালু ছিল। আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগেও শিক্ষার্থীরা যানবাহনের ভাড়া দিয়েছে অর্ধেক। তাদের দাবি পূরণের যৌক্তিকতা সরকারও স্বীকার করছে। আলোচনায় বসেছে। হতাশার কথা এই যে, নিষ্ফল সে আলোচনা।
পরিবহন মালিকরা হাফ ভাড়ার দাবি মেনে নিচ্ছে না অথবা পারছে না। সরকার বিআরটিসি বাসের অর্ধেক ভাড়ায় শিক্ষার্থীদের চলাচলের ঘোষণা দিয়েছে। বিআরটিসির সীমিত বাসে তা কতটা কার্যকর করা সম্ভব? সমস্যা থেকেই যাবে। বিআরটিসি বাসের আশায় রাস্তায় অপেক্ষা করে সময়মতো ক্লাস করা সম্ভব হবে না।
বিআরটিসি হতে পারত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন। কিন্তু শুধু অব্যবস্থাপনার কারণেই বছরের পর বছর ধরে খুঁড়িয়ে চলছে এই সরকারি সংস্থাটি। বিপুল ঘাটতি টেনে সরকার এই সংস্থাটিকে আজও কেন টিকিয়ে রেখেছে তাও এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। সেনাবাহিনী পরিচালিত সব সংস্থা যদি লাভজনক হয়, তাহলে একই সরকারের অসামরিক সংস্থাগুলো কেন লাভজনক হবে না? প্রশ্নটি অনেকের মাথায় আসে। দেশে যে বিপুল পরিমাণ যাত্রী, তাতে বিআরটিসি অলাভজনক তো হওয়ার কথা নয়। সরকারের কোটি কোটি টাকার বাস নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে, মেরামত হয় না। কেবল নতুন কেনার দিকে ঝোঁক!
অথচ পরিবহন খাতে বেসরকারি বাসমালিকরা একটি বাস থেকে দশটি বাসের মালিক হয়েছে ১০ বছরের ভেতর, এমন দৃষ্টান্ত একাধিক। টিসিবি আর বিআরটিসি হতে পারত দরিদ্র জনগণের সবচেয়ে বড় সহায়ক প্ল্যাটফর্ম। বাজারের আগুনের তাপ থেকে স্বল্প আয়ের মানুষকে বাঁচাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত এই দুটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে তা হয়নি।
কথায় বলে বোঝার উপর শাকের আঁটি। সম্প্রতি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বহু সংকট সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থীরা এখন যে রাজপথে, তারও কারণ ওই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। একটি খাতকে সহায়তা করতে গিয়ে শত খাতকে বিপর্যস্ত করার কোনো মানে হয় না।
প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১২ বছর ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশের অনেক সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এই সরকারের হাত দিয়ে। কিন্তু সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় এখনই উদ্ভাবন করতে হবে। ২০২৩-এর ডিসেম্বরে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। এর আগেই দেশে একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টির আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সারা দেশের নানা স্তরে সুবিধাবাদী লোক এই দলে ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতার ব্যক্তিগত দুর্বলতার সুযোগ না পেলে এই অনুপ্রবেশ ছিল অসম্ভব। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশ ও দলকে বড় করে দেখলেই এটি হতো না। দলে এমন লোকরাই ঢুকেছে- যারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ঘোরতর বিরোধী। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই তাদের অস্তিত্বে গাঁথা!
ক্যাসিনো কাণ্ডে ধরপাকড়কে কেন্দ্র করে কেঁচো খুঁড়তে বহু বিষধর সাপও বেরিয়ে আসে। যারা আওয়ামী লীগের সম্পদ নয়, কলঙ্ক। তাদেরই দায় বহন করতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং বাংলাদেশকে উন্নয়নে আধুনিকতায় শাণিত করা দল আওয়ামী লীগকে!
সম্প্রতি গাজীপুর এবং রাজশাহীর কাটাখালির বহিষ্কৃত দুই মেয়রের দুটি অডিও আলোচনা শুনে চমকে ওঠেছি। কী ভয়ংকর সে আলোচনা! সেখানে ৩০ লাখ শহীদের মৃত্যুর জন্য সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী বলা হচ্ছে! বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাস্কর্য স্থাপনকে মৌলবাদী জঙ্গিদের ভাষায় তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে!
জীবন দিয়ে হলেও সেই ভাস্কর্য স্থাপন ঠেকানো হবে; এমন জঙ্গিবাদী উক্তি করতে পারে যে বা যারা, তাদেরকে দলে আনতে কারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে? আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত তাদেরকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা। আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত না হলে ২০২১ সাল মোটেও সুখকর হবে না।
২০০১ সালে শাহ এমএস কিবরিয়ার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এক সভায় মতামত জানতে চাওয়া হলে বলেছিলাম, গ্রামগঞ্জে জামায়াত-বিএনপিকর্মীরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। মসজিদে মসজিদে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, জনগণকে বিভ্রান্ত করছে; তৃণমূলপর্যায়ের কর্মীদের সক্রিয় করে এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা না নিলে বিপর্যয় এড়ানো যাবে না।
অনেকেই সেদিন বিরক্ত হয়েছিল। নির্বাচনে দেখা গেছে লতিফুর রহমানের মতো পক্ষপাতদুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে অপপ্রচার আওয়ামী লীগকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। শুধু তাই নয়, সহিংসতার তাণ্ডবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন।
ইউপি নির্বাচনে এই বছর যে মাত্রায় সহিংসতা হলো এমন কোনো নজির অতীতে নেই। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অবশ্য এ কাজেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকেই সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। তিনি হস্তক্ষেপ না করলে কিছুই হবে না।
মনে রাখতে হবে, দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তত সুস্থির নয়। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার কিংবা ঘর পোড়ার মধ্যে আলুপোড়া দেয়ার মতো লোকের অভাব নেই। দেশ-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। তাকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবিতে বিএনপি এবং তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য মিত্র দেশ-বিদেশে জোট বাঁধছে।
দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা হোক, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন এটা দলনিরপেক্ষ মানুষও চায়। কিন্তু তার চিকিৎসা নিয়ে যেন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগ করে দেয়া না হয়। তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার সর্বাত্মক আন্তরিকতার পরিচয় দেবে, এ আশা করাই যায়।
প্রবল প্রতাপশালী জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছেন ৯ বছর। কল্পনাও করেননি তাকে কারাগারে যেতে হবে কোনোদিন! নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ৩ জোটের রূপরেখা অনুযায়ী নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবেই যেন জিতে যায় বিএনপি।
সরকার গঠনের পর এরশাদ গেলেন কারাগারে। নয়টি বছর মামলার পীড়নে জর্জরিত হলেন। দণ্ডিতও হলেন দু-একটি মামলায়। তখন কি বেগম জিয়া কল্পনাও করেছেন কোনোদিন তিনিও বিচারের মুখোমুখি হয়ে দণ্ডিত হবেন?
২০০৬ সালে যখন তার প্রবল প্রতাপ, লাখো শহীদের রক্তেভেজা জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে; তখন তো কল্পনাও করতে পারেননি যাকে চক্ষুশূল মনে করেন, তার কাছেই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বিদেশে যাওয়ার জন্য তার অনুকম্পা চাইতে হবে।
সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত ক্ষোভে-দুঃখে বিএনপি এবং বেগম জিয়ার তার প্রতি নৃশংস মানসিকতা আর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি অন্ধ পক্ষপাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যবর্তী ঘটনাগুলো এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কালো অধ্যায়। কাদের উদগ্র ক্ষমতালিপ্সায় কীভাবে ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাও ইতিহাসে লেখা আছে।
অতএব, স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকেও আজ জোয়ারভাটার এই দেশের অস্থিরচিত্ত মানুষের মন বুঝে সতর্ক পা ফেলতে হবে। প্রকাশ্য অথবা গোপনে শুদ্ধি অভিযান দলের ভেতরে চালাতে হবে। এভাবে এই সংকটময় পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন।