বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শহীদ ডা. মিলন ও গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বপ্ন

  • কামরুল হাসান খান   
  • ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ১৭:৪২

১৯৯০ সালে চিকিৎসকদের প্রাণের দাবি ২৩ দফা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন চলছিল। এ দাবিতে চিকিৎসকের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, অবকাঠামো সংস্কার, বাজেট, মেডিক্যাল শিক্ষা সংস্কারসহ বিভিন্ন জরুরি বিষয় ছিল ওই আন্দোলনের দাবি। ডা. মিলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এদেশের চিকিৎসকসমাজ জনগণের কাছে মর্যাদার আসন পেয়েছে।

ডা. শামসুল আলম খান মিলন ১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর আনুমানিক বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বায়োক্যামিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক। পাশাপাশি সেসময়ের বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ ) যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও প্রকৃচি-এর (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ–চিকিৎসক) কেন্দ্রীয় নেতা।

২৭ নভেম্বর ১৯৯০, দিনটি ছিল বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও চিকিৎসকদের ২৩ দফা বাস্তবায়ন আন্দোলনের কর্মসূচি সারা দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং সেসময়ের পিজি হাসপাতালের বটতলায় সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশ। পাশাপাশি দেশব্যাপী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের কর্মসূচি। ছাত্র সংগঠনগুলো সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল। দেশ তখন চূড়ান্ত কর্মসূচির অপেক্ষায়।

ডা. মিলন সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সেসময়ের পিজি হাসপাতালের দিকে রওনা হন। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে আরেক রিকশায় থাকা বিএমএর সেসময়ের মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। মিলন নিজের রিকশা ছেড়ে ওই রিকশায় ওঠেন।

আর রিকশার প্যাডেলে চাপ পড়তেই ডা. মিলন পেছন থেকে গুলিবিদ্ধ হন এবং ওখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে প্রিয় চিকিৎসক নেতা ডা. মিলন চিরতরে হারিয়ে যান। থ্রি নট থ্রির একটি বুলেট তার ফুসফস ও হৃদপিণ্ড ভেদ করে গিয়েছিল।

মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। গর্জে ওঠে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজপথ। সর্বত্র জনগণের কণ্ঠ- ‘মিলন ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’। আন্দোলন এমন এক ঝড়ের গতি পায়, যে ঝড়ে কোনো রাজন্য বা স্বৈরাচার কখনও টিকে থাকতে পারে না।

ডা. মিলন হত্যার প্রতিবাদে পুনরুজ্জীবিত হয়ে দেশের চিকিৎসক-সমাজ, মেডিক্যাল-ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। চারদিক থেকে চিকিৎসক ও ছাত্রজনতা বিশাল মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জনতার এক মহাসমুদ্র তৈরি করে।

পোস্ট মর্টেম এবং বহির্বিভাগের সামনে অনুষ্ঠিত জানাজা শেষে মিলনের শেষশয্যা রচিত হয় তারই প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেদিনের সব আয়োজনের দায়িত্ব বর্তেছিল আমার ওপর।

মিলনের মৃত্যুসনদটিও আমাকে লিখতে হয়েছিল। তাকে কবরে শায়িত করার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেলাম এরশাদ সরকার ইতোমধ্যে কারফিউ জারি করেছে। জরুরি আইন ঘোষিত হয়েছে। এটি ছিল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার শেষ অস্ত্র।

জনগণ ঘৃণাভরে সেই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করল। সে রাতেই কারফিউ ও জরুরি আইন অমান্য করে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামে ঢাকার রাজপথসহ সারা দেশে। ২৮ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সব মেডিক্যাল শিক্ষক ও সরকারি চিকিৎসক পদত্যাগ করে এরশাদ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানায়।

এই পদত্যাগ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব ফেলে। আমরা ২৮ নভেম্বর সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সভাকক্ষে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করি। সেখান থেকেই বিএমএর কর্মসূচি সারা দেশে পরিচালিত হয়।

৪ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় এবং সেই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের পতন ঘটে। রাতে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ভরে যায় আনন্দমিছিলে। আমরাও ঢাকা মেডিক্যাল থেকে মিলনের সহকর্মী হিসেবে আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে যোগ দেই সে মিছিলে।

ডা. মিলন, নূর হোসেন, জেহাদসহ আরও অসংখ্য শহীদের রক্তে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক সংযোজন ‘গণ-অভ্যূত্থান ৯০’। যা দেশবাসীর কাছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক নতুন আশার সঞ্চার করে।

১৯৮৩ সালে ডাক্তার হওয়ার পর থেকে মিলন চিকিৎসক ও পেশাজীবীদের সব আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। প্রতিটি আন্দোলনে তাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। এমনকি চাকরিচ্যুত পর্যন্ত হতে হয়েছে। যদিও চিকিৎসক-পেশাজীবীদের চাপের মুখে সরকার প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে।

মিলন তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এদেশের চিকিৎসক, পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদদের হৃদয়ে মযার্দার আসন অর্জন করেছিল। মিলনের সঙ্গে আমার ৮৩ সাল থেকে বন্ধুত্ব হলেও, ওর জীবনের শেষ দুটি বছর একরকম অহর্নিশি আমরা একসঙ্গে থাকতাম।

অমায়িক ব্যক্তিত্বের মানুষ মিলনের সঙ্গে ঢামেক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। আমি জয়ী হওয়ার পর ওকে কোষাধ্যক্ষ পদের প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যান করেনি। দিনরাত একসঙ্গে বিএমএ, শিক্ষক সমিতি ও পেশাজীবী আন্দোলনে কাজ করেছি।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আন্দোলন সংঘটিত করার জন্য সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি হুলিয়া মাথায় নিয়ে রাতে হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে দুজনে একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। মিলন প্রগতিশীল রাজনীতির কর্মী ছিল এবং স্বপ্ন দেখত দেশে গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়নের।

১৯৯০ সালে চিকিৎসকদের প্রাণের দাবি ২৩ দফা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন চলছিল। এ দাবিতে চিকিৎসকের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, অবকাঠামো সংস্কার, বাজেট, মেডিক্যাল শিক্ষা সংস্কারসহ বিভিন্ন জরুরি বিষয় ছিল ওই আন্দোলনের দাবি।

ডা. মিলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এদেশের চিকিৎসকসমাজ জনগণের কাছে মর্যাদার আসন পেয়েছে। যে কারণে বিএমএর সেসময়ের সভাপতি ডা. এমএ মাজেদকে র্সবদলীয় রাজনতৈকি সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকাররে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদান করেন।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এদেশের চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও মেডিক্যাল শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। দেশের চিকিৎসকসমাজ নানা রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত।

এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএমএ ও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু মিলনের আত্মত্যাগের সাক্ষী বিএমএতে দলমত নির্বিশেষে গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা, চিকিৎসকদের উন্নয়ন ও অধিকারের স্বার্থে সব চিকিৎসকদের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি।

উন্নত বিশ্বে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নীতিনির্ধারনে মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা অপরিসীম। কখনও আবার প্রধান। ডা. মিলনসহ লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’কেও সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা দরকার।

শহীদ ডা. মিলনের ৩১ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, এদেশের চিকিৎসক সমাজের চিকিৎসাক্ষেত্রে ভেদাভেদ ভুলে দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ মেধা, শক্তি ও সুযোগ ব্যয় করবে- এটিই প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত।

শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. আলীম ও ডা. মিলনসহ বহু চিকিৎসক দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। জাতির কাছে চিকিৎসকদের একটি র্মযাদার আসনে বসিয়ে গেছেন।

এ দেশের চিকিৎসকদের দায়িত্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার সব সীমাবদ্ধতা পাস কাটিয়ে, সাধারণ মানুষের সুচিকিৎসার জন্য আন্তরকিতার সঙ্গে শক্তভাবে পাশে দাঁড়ানো। তবেই স্থায়ী হবে চিকিৎসকদের র্মযাদা। শান্তি পাবে শহিদের আত্মা।

এজন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার। স্বাস্থ্যখাতে যে বাস্তবতা বিরাজ করছে তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এই বাস্তবতাকে গণবান্ধব করতে কিছু সুপারিশ সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই-

১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ। একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠনরে মাধ্যমে অবকাঠামো এবং র্কমচারীদের দায়িত্ব পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত থাকবে। প্রতিটি কাজের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং ফলো-আপ থাকা

২. শেখ হাসিনা সরকার প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০০-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন

৩. জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরকিল্পনা

৪. জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেট। প্রয়োজনীয় বাজেটে (জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ১০%) বরাদ্দ এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা

৫. স্বাস্থ্যখাতে কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন

৬. নিয়োগ ও বদলি নীতিমালা। অর্থাৎ চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিংসহ একটি গ্রহণযোগ্য বদলি-পদোন্নতির কার্যকর নীতিমালা থাকা যেখানে সবার অধিকার নিশ্চিত হবে

৭. মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন

৮. ল্যাবরেটরি সার্ভিস নীতিমালা হালনাগাদ ও জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ ও সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যৌক্তিক মূল্যনির্ধারণ

৯. বিএমডিসিকে র্কাযকর ও শক্তিশালী করে তোলা

১০. বেসরকারি কলেজ-হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনা

১১. চিকিৎসক ও সব হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

১২. স্বাস্থ্য প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ

১৩. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন

১৪. মেডিক্যাল ইনফরমশেন সিস্টেম (এমআইএস) গঠন

১৫. অভ্যর্থনা ও তথ্যকেন্দ্র তৈরি

শেখ হাসিনা সরকার-প্রণীত সর্বজনগৃহীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০০-এর ওপর ভিত্তি করে সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যনীতি গড়ে উঠবে এটাই বিশ্বাস।

লেখক: চিকিৎসক ও অধ্যাপক। সাবেক উপাচার্য, বিএসএমএমইউ।

এ বিভাগের আরো খবর