বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নাকাল নগরবাসী

  •    
  • ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:১১

কারো কোনো বিষয়ে দাবি থাকলে তার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দাবি নিয়ে কথা বলা যায়। প্রয়োজনে শীর্ষ কর্তৃপক্ষের কাছেও যাওয়া যেতে পারে। গণমাধ্যম তো প্রস্তুতই রয়েছে, এসব দাবি-দাওয়ার কথা প্রচার করতে সরকারের দৃষ্টি তাতে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো এখন সুলভ হয়ে গেছে। এসবকে বাদ দিয়ে আমরা এখন ৫০-৬০ বছর আগের ব্যবহৃত পদ্ধতি রাস্তা অবরোধ করে, ধর্মঘটের নামে দাবি আদায় করার জন্য যা করছি তা জনদুর্ভোগকে চরমপর্যায়ে নিতেই কেবল সাহায্য করছে।

ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে জনজীবন অনেকটাই স্থবির হয়ে আসছে দিন দিন। ছোট শহরগুলোতেও অবস্থা প্রায় একই রকম হতে যাচ্ছে। এমনিতেই শহরগুলোর ওপর কর্মজীবী মানুষের চাপ ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে নাগরিক-সুবিধা নিয়ে যেকোনো শহরে বসবাস করা অকল্পনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের ঘনত্ব এত বেশি যে রাস্তায় স্বাভাবিকভাবে হাঁটা যায় না।

রাস্তা ও ফুটপাতও প্রয়োজনের তুলনায় নেই বললেই চলে। বড় ছোট সব শহরের ফুটপাতের প্রায় সবটাই হকার মার্কেটে পরিণত হয়ে আছে। সেগুলোতে কেনাবেচাও চলছে রাতদিন। পথচারীদের এসব ভাসমান হকার মার্কেট অতিক্রম করে চলতে হয় অতিশয় ধীর গতিতে। ঢাকা শহরে এটি এখন এক অভিনব দৃশ্য। রাস্তায় বাস, ট্রাক, ছোট যানবাহন ও রিকশা গাদাগাদি করে চলছে। কোনোটারই গতি দিনের বেলা স্বাভাবিক নয়।

সুতরাং যানজট শুধু জেব্রা ক্রসিং, চৌরাস্তা বা ট্রাফিক সিগন্যালের সম্মুখে ঘটে তা নয়, সাধারণ সড়কেও স্বাভাবিকের চাইতে বেশিসংখ্যক যানবাহন হওয়ার কারণে প্রায়ই যানজট সৃষ্টি হয়। কোনো একটি ছোট পরিবহন আকস্মিকভাবে থেমে গেলে কিংবা খারাপ হলে তো কথাই নেই। ট্রাফিক পুলিশ কবে সেই বিকল গাড়ি সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে তার ওপর নির্ভর করতে হয়। এছাড়া প্রায় সব কটি বড় শহরেই কিছু জায়গা দিয়ে অতিক্রম করতে যানজটের ধকল সহ্য করতেই হবে, সময় অতিরিক্ত ব্যয় হতে পারে এমনটিও ধরে নিতে হবে।

রাজধানী ঢাকা শহরে গত এক দশকে ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সড়কে স্বাভাবিক গতি নিয়ে পরিবহন চলার ব্যবস্থা খুব বেশি স্বস্তি দিতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে নানা ধরনের পরিবহনের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। রাস্তার সম্প্রসারণ তো সেভাবে করা সম্ভব নয়, একইভাবে নতুন নতুন রাস্তায় তৈরি করাও বড় শহরগুলোতে অসম্ভব ব্যপার। সেকারণে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো এখন চলাচলের জন্য খুবই ধীরগতির, যানজট ও ফুটপাতবিহীন চলাচলের অনিরাপদ শহরে পরিণত হয়েছে। সময়মতো কোথাও পৌঁছানো কষ্টের এবং জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানুষকে তাই হাতে বেশ কিছু সময় রেখেই ঘর থেকে বের হতে হয়। এতে মানুষের সময়ের অপচয় যেমন বেড়ে চলছে একইভাবে শ্রমঘণ্টা, কর্মক্ষমতা এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবেশ হ্রাস পাচ্ছে। মানুষের ধৈর্য, সহনশীলতা, মনোবৃত্তি ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়েই চলছে। অথচ উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষ আসছে শহরে। শহরগুলোতে মানুষের ঢল যেন বেড়েই চলছে। কিন্তু সেই শহরে এ তো মানুষের বসবাস, যাতায়াত, নিত্যদিনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ ইত্যাদি এখন আর স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার মধ্যে নেই। বড় শহরগুলো অনেক আগেই নাগরিক জীবনের ধারণা হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি অভিজাত এলাকাগুলোতেও এখন ঘিঞ্জি অবস্থা।

এমনই এক দুঃসহ বাস্তবতা আমাদের বেশিরভাগ নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক চিত্র হিসেবে দৃশ্যমান। এর অলৌকিক কোনো সমাধান কেউ আশা করতে পারে না। স্বাভাবিক সমাধানের উপায়ও বের করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক, ব্যবসা বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের সেবার অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বড় শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়া।

এর ফলে গ্রাম থেকে প্রতিদিন মানুষ ছুটছে শহরে, ঢাকায় এটি যেন জনস্রোতের রূপ ধারণ করেছে। এতে ঢাকার জনজীবন নানা জটে নাকাল হয়ে পড়ছে। এটি অনেকটাই সহ্যের সীমা অতিক্রম করে বসে আছে। সুতরাং নতুন করে যে চাপ প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে তার অবস্থা কতটা করুণ রূপ ধারণ করছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

এমন এক নিত্যদিনের ভয়াবহ স্বাভাবিক চিত্রের ওপর যখন পরিবহনব্যবস্থায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে দেখা যায় তখন জনদুর্ভোগকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে সেটিই আমরা বুঝতে অক্ষম। একবার পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আকস্মিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় সবধরনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে যারা নিত্যদিন যাওয়া-আসা করেন তাদের সময়মতো পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তায় বাস নেই তো দূরের যাত্রায় অন্য পরিবহনের ওপর ভর করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। গলাকাটা ভাড়ার এক মহোৎসব চলতে থাকে।

বাধ্য হয়ে অনেককেই পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে কিংবা বাড়ি ফিরতে হয়েছে। আবার ভাড়া নিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের ইঁদুর-বিড়াল খেলা শুরু হয়েছে। মালিক-পরিবহন শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকাতে থাকে, তা নিয়ে মোবাইল কোর্ট বসায় বিপুলসংখ্যক বাস রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। গণপরিবহণের সংকটে যাত্রীদের ভোগান্তি যেন ভাগ্যের লিখনের মতো আপনা-আপনি কপালে এসে পড়তে শুরু করে! সেটি এখনও কমবেশি চলছে।

নতুন করে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের হাফ-পাস দেয়ার দাবিতে আন্দোলন। তাতেও বেশ কিছু রুটে গাড়ি চলাচল বলতে গেলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেই রাস্তা অতিক্রমকারীদের জন্য তখন একমাত্র প্রকৃতিপ্রদত্ত দুই পা-ই ভরসা। সেভাবেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। এভাবে হঠাৎ করে গণপরিবহন যারা আটকে দিয়েছে কিংবা বন্ধ করে দিয়েছে তারা শুধু তাদের কথাটাই ভেবেছে, তাদের স্বার্থটাই দেখেছে!

গণপরিবহন বন্ধ করে দিলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষের যাতায়াতে নেমে আসে বড় ধরনের বিপর্যয়, দুর্ভোগ সেকথা তারা একবারও ভাবতে চায় না। আমরা সেভাবে তো ভাবতে বোধহয় অভ্যস্তও নই। কারো কোনো বিষয়ে দাবি থাকলে তার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দাবি নিয়ে কথা বলা যায়। প্রয়োজনে শীর্ষ কর্তৃপক্ষের কাছেও যাওয়া যেতে পারে।

গণমাধ্যম তো প্রস্তুতই রয়েছে, এসব দাবি-দাওয়ার কথা প্রচার করতে সরকারের দৃষ্টি তাতে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো এখন সুলভ হয়ে গেছে। এসবকে বাদ দিয়ে আমরা এখন ৫০-৬০ বছর আগের ব্যবহৃত পদ্ধতি রাস্তা অবরোধ করে, ধর্মঘটের নামে দাবি আদায় করার জন্য যা করছি তা জনদুর্ভোগকে চরমপর্যায়ে নিতেই কেবল সাহায্য করছে।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে গোটা মিরপুরে রাস্তা অবরোধ করায় সমগ্র ঢাকা শহরই কয়েক ঘণ্টা অচল হয়ে পড়ে। এমন অচল অবস্থায় সামনে বা পেছনেও যাওয়া যায় না। লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ যেন রাস্তাতেই মানুষের হাপিত্যেশের মধ্যে আটকে ছিল। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিদিন অমুক দলের মানববন্ধন, অমুক সংগঠনের প্রতিবাদ সভা লেগেই আছে।

ফলে ওই পথে সেই সময় পরিবহনের বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। অন্যপথে ঘুরে যাওয়াও সহজ কথা নয়। সমাবেশটি যদি হয় বড়সর তাহলে এর ধাক্কা লাগে গোটা শহরে। তখন যানজট নয়, সব পরিবহনই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তেমন পরিস্থিতিতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় পরিবহনের ভেতর আটকে থাকে। যাদের এসি গাড়ি নেই তারা প্রখর রোদে ঘামতে থাকেন।

সমাবেশ কখন শেষ হবে তা সংগঠনের নেতাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা শোনাতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষের পথচলার অধিকার যে হরণ করেন, কর্মস্থল কিংবা জরুরি কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ান, সেটি তারা বুঝতে চান না। সেই প্রশ্ন এখন করাটাও বোধহয় তাদের ভাষায় গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে পড়ে।

প্রায় প্রতিদিনই তো এ দল ও দলের আন্দোলন, সমাবেশ অবস্থান, ধর্মঘট ইত্যাদি শহরগুলোতে, এমনকি সড়ক, মহাসড়কে আকস্মিকভাবে ঘটতে দেখা যায়। সড়ক, মহাসড়কগুলো যেন জনসাধারণের জন্য নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক যাতায়াতের সুযোগ দেয়ার প্রস্তুতি রেখেও দিতে পারছে না! আমাদের সমাজেরই আমরা কেউ না কেউ সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান-অবরোধ, ধর্মঘট ইত্যাদি করতে পছন্দ করি।

আমরা শহরের কোনো মাঠ অথবা জনসমাবেশের জন্য নির্ধারিত ময়দানে গিয়ে প্রতিবাদ করাকে যথেষ্ট মনে করছি না। রাস্তাই আমাদের প্রতিবাদের উত্তম জায়গা বলে বিবেচিত হচ্ছে। সেই রাস্তা যদি সরু গলিও হয় তাহলে সেখানেই হবে আন্দোলন সংগ্রামের অবস্থান, ধর্মঘট! আমরা বহুকাল আগে থেকে শিখেছি ‘লড়াই হবে রাজপথে’, ‘রাজপথ রাজপথ ছাড়ি নাই ছাড়বো না’ ইত্যাদি স্লোগান। সেই রাজপথে যদি স্বল্পসংখ্যক প্রতিবাদীও দাঁড়ায় কিংবা বসে যায় তাহলেও হাজার হাজার মানুষকে বহনকারী গাড়ি থেমে যেতে বাধ্য হয়।

পরিবহনে যাত্রীদের দুর্ভোগ দেখার কেউ নেই। পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরাও যেমন দেখে না, কলকারখানার শ্রমিকরাও সবসময় দেখে না, রাজনীতির নেতাকর্মীরাও দেখে না, অন্য যেকোনো দাবি আদায়কারীরাও দেখে না। আসলেই আমরা যে যার মতো করে নাগরিক জীবনটাকেই বোধহয় এখন এক অভিশপ্ত জীবনে পরিণত করে ফেলেছি। এখান থেকে বের হয়ে আসার কথা কজনইবা বিবেক ও যুক্তি দিয়ে উপলব্ধি করছে? যখন নাগরিক জীবন ততটা জমে ওঠেনি তখন হয়ত রাজপথে এত পরিবহন ছিল না, শহরেও এত মানুষ ছিল না। রাজপথে আন্দোলন মিছিল হলে গোটা শহরে বসবাসকারী মানুষের জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলত না।

তখন অবশ্য সমাবেশ হতো পল্টন ময়দান কিংবা শহরের জনসভা স্থলগুলোতে কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে । কিন্তু এখন নগরজীবন যখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ তখন আমাদের প্রতিবাদের সবকিছুই যেন রাস্তাঘাটে এসে পড়েছে। এই রাস্তাগুলো গভীর রাতেও এক মিনিটের জন্য পরিবহনবিহীন থাকে না। জীবন জীবিকা মানুষের এখন এতই নগর এবং পরিবহনকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে যে, এক মুহূর্ত কোনোটি বন্ধ রাখা মানেই হচ্ছে জনদুর্ভোগে মানুষকে শুধু অতিষ্ঠ করাই নয়, জীবন জীবিকাকেও স্তব্ধ করে দেয়া। এই বাস্তবতার বোধটি আমাদের সহসাই কি জাগ্রত হবে?

লেখক: গবেষক-অধ্যাপক

এ বিভাগের আরো খবর