হত্যা-সংঘাত, সংঘর্ষ-হামলা, গোলাগুলিসহ নানা সহিংসতার মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে দেশের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১২০২টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে ১৮৪৭টি ইউপি নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হয়েছে। পঞ্চম ধাপের তফশিল এখনও ঘোষিত হয়নি। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সহিংস ভোটাভুটিতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে ৩৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইউপি নির্বাচনে আগে এত সহিংসতা হতো না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পর থেকে ইউপি নির্বাচন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। বলা যায়, যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কারণ বা অনুষঙ্গ অনেক বেশি। জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে মূলত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বই বেশি কাজ করে। কিন্তু একটি ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে স্থানীয় আধিপত্য বজায় রাখার লড়াই, গোত্রীয় বা বংশীয় সম্পর্ক, বংশমর্যাদা, এলাকাভিত্তিক প্রভাব, আত্মীয়তার সম্পর্কসহ নানা বিষয় কাজ করে।
এসব বিষয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ফলে, ইউপি নির্বাচন এখন জাতীয় নির্বাচনের সব চরিত্রই ধারণ করেছে। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি এখানে অনুপস্থিত। এছাড়া খুন-সংঘাত, ভোটকেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, মনোনয়নবাণিজ্য- সবই আছে।
ইউপি নির্বাচনে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ২০১৫ সালে। এ বছর আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে ইউপিতে আত্মীয়তার সম্পর্কের চেয়ে এখন রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক, নিজেদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের চেয়ে যখন রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন সেখানে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ইউপি নির্বাচনে এখন তা-ই দেখেছি।
জাতীয় নির্বাচনের মতো ইউপি নির্বাচনেও একই দল থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচন করছে। এদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। এটি স্থানীয়পর্যায়ে দলীয় অন্তকোন্দলেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আগের ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদেরকে আওয়ামী লীগ সতর্ক করেছিল বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছিল। কিন্তু এবার দল থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বা সতর্কও করা হয়নি। এটি দলের একটি কৌশলও হতে পারে।
আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে স্থানীয়পর্যায়েও অনেক নেতা-কর্মী থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। আবার সব নেতাই শাসন কাঠামোর অংশীদার হতে চাইবেন এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু গদি কম, ভাগীদার বেশি। ফলে, যেকোনো নির্বাচন এলেই প্রার্থী বাছাই করতে দলকে হিমশিম খেতে হয়। জাতীয় নির্বাচনে দেশের প্রধান দুটি দলকেই এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। নির্বাচনে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন না পেলে তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিরোধীপক্ষের হয়ে কাজ করেন। জাতীয় নির্বাচনে দলের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এর সঙ্গে রয়েছে আসন খোয়ানো ও ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার সম্পর্ক। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিতরা বিদ্রোহী প্রার্থী হলে এমনকি জয়ী হলেও দলের জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নয়।
কারণ, এর সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগের জন্য বিষয়টি এখন আরও সহজ। কারণ, আওয়ামী লীগতো ক্ষমতায় আছেই। এক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থী অন্য প্রতীক নিয়ে জয়ী হলে তাকে পরে কোলে তুলে নিতেও দলের কোনো সমস্যা হবে না। আর বিদ্রোহী বিজয়ী প্রার্থীরাও ক্ষমতাসীন দল প্রতীক না দিলেও দলে ফিরে আসতে দেরি করবেন না। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না।
আওয়ামী লীগ এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই প্রতীক একজনকে দিলেও নির্বাচনের মাঠ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। জিতে আসো, দরজা খোলা আছে- ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই নীতি অনুসরণ করেছে। জিতলে নৌকা। কিন্তু পরাজয় শুধু নৌকার বা ব্যক্তির, আওয়ামী লীগের নয়। আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে এভাবেই দেখছে বলে মনে হয়।
এদিকে বিএনপি সক্রিয় রাজনীতিতে নেই। চোখে পড়ার মতো তাদের কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। কেন্দ্রীয়পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনই বিএনপির একমাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম। খালেদা জিয়ার চিকিৎসাই বিএনপির একমাত্র রাজনৈতিক এজেন্ডা। কেন্দ্রে ও স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি এখন কোণঠাসা। কাজেই ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথা নেই। জাতীয় নির্বাচনে মহা পরাজয়ের পর ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা না থাকাই স্বাভাবিক।
সে কারণেই চলমান ইউপি নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না। এছাড়া একাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়ার চ্যালেঞ্জ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাব্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকায় তারা দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে আসেনি। একজনকে মনোনয়ন দিয়ে বিএনপি বাকি প্রার্থীদের মন ভাঙতে চায়নি।
একজনকে সক্রিয় করে দুই-তিনজনকে নিষ্ক্রিয় করা তারা সংগত মনে করেনি। নিষ্ক্রিয় থাকলেও তো অন্তত দলেই আছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন দলের কোনো পর্যায়েই বিএনপি তার নেতা-কর্মীদের হতাশ করতে চায় না। এ মুহূর্তে দল থেকে কেউ বের হয়ে গেলে বা কেউ বিদ্রোহী হয়ে গেলে সেটা বিএনপির জন্য অনেক কিছু হারানোর শামিল। এমনিতেই তারা অনেক হারিয়েছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটিটাও অনেক। মাঠে তাদের কর্মী নেই। যারা আছে তাদেরকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া না করাই দল ভালো মনে করেছে।
এভাবে একের পর এক নির্বাচন বর্জন করার মধ্য দিয়ে আজকের সুপ্ত নেতা-কর্মীরা যে চিরদিনের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে বিএনপিকে সেটিও ভাবতে হবে। একটি দলের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে ওই দলই এক সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। ইউনিয়ন পর্যায়ের সব প্রার্থীরাই নিজদলের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। যেহেতু নির্বাচন এখন একটি লাভজনক বাণিজ্য, প্রার্থীরা তাই অর্থ বিনিয়োগ করতেও কার্পণ্য করেন না।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও এটি একটি নির্বাচনি বাণিজ্যে। এই বাণিজ্য আগে সংসদ নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ইউপি নির্বাচনেও শুরু হয়েছে। ইউপি নির্বাচনে এবার ব্যাপকহারে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শোনা গেছে। ভোটে বিরোধী পক্ষ না থাকায় সরকারি দলের টিকেট পাওয়া মানেই নির্বাচিত হওয়া। ফলে, শোনা যায় কোনো কোনো প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কোটি টাকা পর্যন্ত লগ্নি করেছেন।
এত সংঘাতের বিনিমিয়ে ও অর্থলগ্নি করে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের অনেকেই কিন্তু বিজয়ী হতে পারেননি। গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা অনেক ইউপিতেই পরাজিত হয়েছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে, নীলফামারী সদরের ১১টির মধ্যে ৯, মাদারীপুরের কালকিনিতে ১২টির মধ্যে ৯টিতে নৌকা পরাজিত হয়েছে। এমনকি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে ৭টির মধ্যে ৬টিতেই নৌকা হেরে গেছে। এই পরাজয়কে শুধুই অর্থের বিনিময়ে যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন না দেয়ার খেসারত হিসেবে দেখা যেতেই পারে।
আবার এ পরাজয়কে নিছক স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী বিশেষের প্রতি ভোটারের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই ফলাফলকে জাতীয় নির্বাচনে নৌকা বা আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ ভোটারদের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখার সুযোগ কি একেবারেই নেই? আওয়ামী লীগের উচিত পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করা। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনের ফলাফলকে জাতীয় নির্বাচনে দলের জনপ্রিয়তা যাচাই ও জনগণের নাড়ি পরীক্ষার একটি সুযোগ হিসেবেও দেখতে পারে। এর ওপর ভিত্তি করে দল তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও নির্ধারণ করতে পারে।
নির্বাচনে বিরোধী দল না থাকায় সব কোন্দলই এখন আওয়ামী লীগে ভর করেছে। দল-সমর্থিত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থী দুজনই নিজেদেরকে জয়ী হবেন বলে ভাবছেন। কিন্তু বিরোধী দল নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগে এত বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ত নির্বাচন করত না। একই পদে দুজন প্রার্থী থাকলে তৃতীয়জন প্রার্থী হওয়ার কথা সহসা চিন্তা করেন না। অর্থাৎ এত বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব হতো না।
বিএনপি দলীয়ভাবে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও তাদের স্থানীয় নেতারা অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন করছেন। ফলে নির্বাচনি মাঠে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীই শ্ক্ত অবস্থানে। এতে সংঘাত আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিদ্রোহী প্রার্থী বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের সমর্থন ও ভোট পাওয়ায় নির্বাচনে সংঘাত যেমন বেড়েছে তেমনি নির্বাচনে নৌকার পরাজয় আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করা জাতীয় রাজনীতিতে তাদের কোনো কার্যক্রম না থাকারই বহিঃপ্রকাশ। একই কারণে তারা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেনি। এই প্রবণতা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে।
এদিকে আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল জাতীয় রাজনীতি থেকে যে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত ঠেকেছে তারও একটা নজির দেখা গেল ইউপি নির্বাচনে। দলীয় আত্মতুষ্টি নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়েই ভরাডুবির কারণ হতে পারে। এছাড়া দলের তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমও নেই।
কেন্দ্র থেকে গ্রামপর্যায়ের বিভিন্ন স্তরে দল গোছানো ও অন্তঃকোন্দল নির্মূলের জন্য দলের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম নেই। জাতীয় রাজনীতি ও নির্বাচনে অবশ্যই এর একটি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ইউপি নির্বাচনে সে প্রভাব দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে যে এর কোনো প্রভাব পড়বে না সে কথা বলা যায় না।
সর্বশেষ, নির্বাচন কমিশন বরাবরের মতো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেভাবে নিষ্পৃহ থাকে, ইউপি নির্বাচনেও তারা একই ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রবণতা নির্বাচন কমিশন তথা নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি। নির্বাচনে যেকোনো সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা কমিশনের কাজ। কিন্তু কোনো ইউপিতেই সহিংসতা ও নির্বাচনি অনিয়মের বিরুদ্ধে কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
আইনানুযায়ী কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার কমিশনের আছে। তারা চাইলে প্রার্থিতা ও ভোট ও ভোটের ফলাফলও বাতিল করতে পারেন। এসব কাজ করতে পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য লাগে না। কমিশনের সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। কমিশন বরং দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবি করছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সহিংস নির্বাচনের দায় তবে কার?
সব মিলিয়ে জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় নির্বাচনের একটি মহড়া হয়ে গেল চলমান ইউপি নির্বাচনে। নির্বাচন এখনও চলমান। তাই চূড়ান্ত ফলাফল ও বিশ্লেষণের জন্য আমাদের শেষপর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক