যতই বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজকে টিনের ঘর করুক, দ্বিতল-ত্রিতল দালানে পরিবর্তন করা হোক না কেন; তাতে কি আসলে জ্ঞানী, সৎ ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরি হচ্ছে?
বাংলাদেশে অসংখ্য স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কল্পনাতীতভাবে বাড়িয়ে তা নিয়মিত করা হয়েছে। অথচ বেশিরভাগ সময় দেখা যায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কমছে। অথচ প্রায় সবপর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অসংখ্য কোচিং সেন্টার খুলে সেগুলোতে ক্লাসের পড়াগুলোই টাকার বিনিময়ে পড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভেতর একটি ধারণা তৈরি করে দেয়া হয়েছে যে, সেখানে ভর্তি না হলে ভালো ফল করা যাবে না। এমনকি হয়ত সাধারণভাবে পাসও করা যাবে না।
আগে শোনা যেত, ডক্টরেট করতে গাইড শিক্ষককে খুশি করতে হয়। ভাবতাম, এটাই হয়ত ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার নির্দোষ রীতি। এখন দেখা যায়, এমন পরামর্শদাতার সংখ্যা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসাগুলোতে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের কারারুদ্ধ হওয়ার খবর বিরল নয়।
এত কিছু যে ঘটছে, সরকার তা জানে না, সেটা আদৌ সত্য নয়। জানে বলেই শিক্ষামন্ত্রীকে মাঝেমধ্যে বলতে শোনা যায়- ‘নিয়মিত ক্লাস করতে হবে, কোচিং সেন্টারগুলো বেআইনি ঘোষণা করা হলো, সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’। কিন্তু এর পরিণতিতে দেখা যায়, প্রায়ই শিক্ষক-শিক্ষিকারা চলে যান থানা বা জেলা শিক্ষা-কর্মকর্তাদের তৈল মর্দনে।
বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকার সময় স্কুলের চাইতে বেশি কাটে কোচিং সেন্টার ও এ ধরনের সরকারি অফিসগুলোতে। শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারগুলোতে নিয়মিত বিপুল অর্থের বিনিময়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। তা না হলে নাকি পাস করা যাবে না, এ প্লাস আসবে না। পরে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে! এটাই বর্তমান সংস্কৃতি।
এছাড়াও কোচিং সেন্টারে অন্য স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে পড়লে হবে না, পড়তে হয় নিজ-স্কুল বা কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে। কারণ পরীক্ষার খাতা তারাই দেখবেন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো শিক্ষাদান হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য প্রতি জেলা-উপজেলায় পরিদর্শক নিয়োগ করা আছে। তাদের সম্পর্কেও অভিভাবক বা সাধারণ মানুষের মনে খুব ইতিবাচক ধারণা নেই। শোনা যায়, তারা কদাচিৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্রিম খবর দিয়ে যেয়ে থাকেন। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গেলেই তাদেরকে বিপুল সংবর্ধনার মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। বাকি সবকিছুই তারা ঠিকঠাক করেন, তবে কাজের কাজ কতটুকু করেন সেটিই প্রশ্ন?
এসব বিষয় বহুকাল ধরে চর্চিত হলেও, জিপিএ শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের সময় থেকে এর উত্তরোত্তর বিকাশ হচ্ছে। ফলে নির্দিষ্ট স্কুলটির উন্নয়ন বরাদ্দের বিপুল স্ফীতিও ঘটে থাকে বলে শোনা যায়। সবকিছুর পরও এটিই এ দেশে সরকার-প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীরা একসময় বিভিন্ন চাকরিতে যোগ দেয়। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নেয়।
এই দলে যারা থাকে তারা রীতিমতো সৌভাগ্যবান। বদলিযোগ্য এই চাকরি। আজ এখানে, কাল সেখানে। উচ্চ বেতন, গাড়ি-বাড়ি, ভাতা কতকিছু। তাদের হুকুমে দেশ চলে। তাই নানা রকম অন্যায়-দুর্নীতি করারও যেন অধিকার তাদের আছে! এসব অদৃশ্য নয়। সবাই দুর্নীতি করে তা নয়। তবে যারা করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করাও কঠিন।
সরকারের ফিন্যান্স বিভাগে যারা চাকরি পায় তাদের ভাগ্যের দরজা এমনভাবেই খুলে যায় যে, আক্ষরিক অর্থেই তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে যেতে পারে। বিশেষ করে যারা সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। ছোট দেশ হলেও এদেশে ব্যাংকের অভাব নেই। যারা দ্রুত বড়লোক হতে চায় এবং বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারে, তারা আবার ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে বেশ সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে। এরা সবসময় অসম ক্ষমতার অধিকারী হয়। পছন্দসই হলে কোনোরকম যাচাই-বাছাই এবং আইনানুগ জামানত ছাড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ দিব্যি দিয়ে দেয়ার অভিযোগও পাওয়া যায় এদের বিরুদ্ধে।
এদের অনেকে আবার ঋণগ্রহীতা (যদি বেনামে না হয়) হয়ে সেই টাকায় দুচারজন অংশীদার নিয়ে নতুন ব্যাংক খুলে বসে। পরে দেশ-বিদেশে কোটি কোটি টাকা নানাপথে পাচার করে। আর এসব টাকার মূল মালিক জনগণের রক্ষিত সঞ্চয় এভাবে দিব্যি ব্যবহৃত হয়ে যায়। যারা এসব করে এরা সবাই শিক্ষিত। এরকম বহু সর্টিফিকেটধারী আছে যারা বাংলা কিংবা ইংরেজিতে একটি চিঠির খসড়াও প্রস্তুত করতে পারে না। অথচ তারা বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন। এসব বয়ান হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবে না।
সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি অংশেই গলদ। এসব রাতারাতি ঠিক করা যাবে না। তবে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য সমাজে যত দ্রুত সম্ভব সুশিক্ষার জায়গাটি ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য প্রথমেই পাঠ্য বই থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব সাম্প্রদায়িক লেখা প্রত্যাহার করা জরুরি। এছাড়াও সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে সব সাম্প্রদায়িক বই, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা দরকার। প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক লেখক-লেখিকার রচনা পাঠ্যবইয়ে গুরুত্বসহ স্থান দিলে এবং ইতিহাস ও বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যাপক প্রসার বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা মননের দিক থেকে উপকৃত হবে।
একটি জরুরি কথা মনে রাখা দরকার, সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করা প্রয়োজন। যদি সরকারি ৪টি ব্যাংক মিলিয়ে একটি সরকারি ব্যাংক তৈরি করে বাকিগুলো তুলে দেয়া যায়, এতে দুর্নীতি কমবে বলে আশা করা যায়। তবে তুলে দেয়া ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাক্ষেত্রে নিয়োজিত করা দরকার।
অতিরিক্ত বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানে আলাদা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা না দিয়ে সব শিক্ষাকে একই প্রতিষ্ঠানের আয়ত্তে নিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি মাদরাসায় বাংলা ভাষার মাধ্যমে সাধারণ ও বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।
দরিদ্র শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বিভিন্ন ভাতা প্রদান ও মাধ্যমিক পর্যন্ত ট্যুইশন ফি ছাড়াই পড়ার সুযোগ দেয়া বেশি কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়। পাশাপাশি সব পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতিটি স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যায় আনুপাতিক হারে বাড়ানোও প্রয়োজন। এসবের মাধ্যমে কিছুটা হলেও পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।