কবি জীবনানন্দ দাশ দ্বিচারী মানুষের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন-
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।” (অদ্ভুত আঁধার এক)
ভীনদেশিদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গঠিত বিএনপি নামক অপরাজনৈতিক দলটির চরিত্র বিশ্লেষণে জীবনানন্দের এ কবিতার বয়ান যথোপযুক্ত বলেই প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশে সম্প্রতি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে অপরাজনীতির চেষ্টা করছে জনবিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর বিএনপি-জামায়াত চক্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে ডিজেলের মূল্য ছিল প্রতি লিটার ৬৮ টাকা, এরপর ৩ টাকা করে কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। একটানা পাঁচ বছরের বেশি সময় দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়েনি।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে ডিজেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বাংলাদেশে যেহেতু তেলের খনি নেই তাই বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করে দেশের তেলের চাহিদা মেটানো হয়। আর বৈশ্বিকভাবে তেলের মূল্য বেশি হওয়ায় জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার ভর্তুকি দিয়ে সহনীয় মূল্যে তেল বাজারজাত করে থাকে।
এবছরের জুনে লিটার প্রতি ২.৯৭ টাকা, জুলাইয়ে ৩.৭০ টাকা, আগস্টে ১.৫৮ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৫.৬২ টাকা এবং অক্টোবরে ১৩.০১ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এতে গত সাড়ে পাঁচ মাসে ডিজেলের জন্য বিপিসির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১৪৭.৬০ কোটি টাকা। সেইসঙ্গে ডলারের মূল্য ২০১৬ সালে ৭৯ টাকা থেকে এ মাসে দাঁড়ায় ৮৫.৭৫ টাকা। ফলে বাংলাদেশকে ডলারে মূল্য পরিশোধে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে।
এদিকে, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মিথ্যাচারের রাজনীতিতে মেতে উঠেছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে ৫ টাকা কমে ডিজেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে সেদেশের সরকার। যা অসত্য প্রচারের নিদর্শন।
তিনি হয়তো ভেবেছেন জনগণ কিছুই জানবে না তারা যা বলবে তাই গোগ্রাসে বিশ্বাস করবে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে ফখরুল সাহেবের অসত্য প্রলাপ ধোপে টিকেনি। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেল ভারতে জ্বালানি তেলের মূল্য কমার পরও পশ্চিমবঙ্গে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৯০ রুপি বা ১০৪ টাকা, দিল্লিতে ৯৮.৪২ রুপি বা ১১৪ টাকার সমান। মুম্বাইতে যা প্রায় ৯৪.১৪ রুপি টাকার মূল্যে যা দাঁড়ায় প্রায় ১১০ টাকা করে। নেপালেও এই মূল্য ১১২.৩৯ নেপালি রুপি বা ৮১ টাকা। প্রতিবেশী এসব দেশের চেয়ে মূল্য তুলনামূলক কম থাকায় চোরাকারবারিরা প্রতিবেশী দেশে ডিজেল পাচার করছে।
অন্যদিকে, সরকার আগাম নির্দেশনা দিলে মজুদদাররা কমদামে অতিরিক্ত তেল মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার প্রবণতা এদেশের বাণিজ্যিক সিন্ডিকেটের বহু পুরনো অপসংস্কৃতি। তাই সরকার জনগণের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায় আগাম তথ্য না দিয়েই তেলের দাম বাড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অতি প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে বিবেক দিয়ে চিন্তা করলেই বাস্তবসম্মত ধারণা পাওয়া যায়।
এদিকে, এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য বিএনপির অযৌক্তিক গলাবাজির কথা না বললেই নয়। জন্মলগ্ন থেকে জনগণের সুখে-দুঃখে দলটির পাশে না থাকার নজির নেই। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে লুটপাট সন্ত্রাসবাদ কায়েম করে হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবনের মধুবিলাসের নষ্ট চরিত্র বদলাতে পারেনি।
করোনা মহামারির সময় তারা দেশের জনগণের কোনো খোঁজ রাখেনি। এমনকি বিএনপির দলীয় শীর্ষ নেতারা ভ্যাক্সিন গ্রহণ করলেও জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে। কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন সম্পর্কে জনমনে নানারকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে করোনাকালে জনগণের লাশ নিয়ে অপরাজনীতি করার নিকৃষ্টতম পথে হাঁটতে চেয়েছে তারা। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা প্রয়োজনের জঘন্য বর্বর গুজব ছড়াতেও তারা দ্বিধা করেনি কোনোদিন।
অতিসম্প্রতি সম্প্রীতির বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র পাকিস্তানের অপকৌশল বাস্তবায়নে দুর্গাপূজাকে টার্গেট করে তারা। কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে রাতের আঁধারে দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে পবিত্র কোরআন রেখে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটিয়েছে বিএনপি-জামায়াতগোষ্ঠী।
পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের আন্তরিকতায় তদন্তে সিসিফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য প্রমাণে বিএনপির নগ্ন কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ছে। কুমিল্লা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর ব্যক্তিগত সহকারী মণ্ডপে কোরআন রেখে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করে বলে এমন অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়টি প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা আমলে নেবে বলে আমরা আশা করি।
বিএনপির চরিত্র নতুন করে বলার নেই। এর প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়া ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে ও ৩ নভেম্বর জাতীয় চারনেতাকে জেলখানায় বন্দি অবস্থায় হত্যার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছে।
একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সে গর্তে নিজেকেই পতিত হতে হবে। তেমন বিএনপি তাদের অসত্য প্রচারকে অবলম্বন করে এদেশে অপরাজনীতির যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছে তাতে আজ তারা নিজেরাই ধরাশায়ী। অন্যের সমালোচনায় বিভোর হয়ে তারা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি না করে নিজেদেরেকে অন্ধকারে পতিত হয়েছে।
পবিত্র আল-কোরআন ও হাদিসে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীদের ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-
“যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না।” (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৬)।
রাসূল (সা.) বলেন-
“মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা মিথ্যাবাদী থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।”
(তিরমিজি : ১৯৭২)
হিংসাপরায়ণ হয়ে অসত্য বলা, মন্দ ধারণা থেকে মিথ্যা বলা, বিদ্বেষী মনোভাব থেকে মিথ্যা বলা, বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে মিথ্যা বলা কখনোই ইসলামসম্মত নয়। আল্লাহতায়ালা মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করেন এবং এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
একটি প্রবাদ আছে। ‘চিলে কান নিল’ বলে অযথা চিলের পেছনে দৌড়ানো। অথচ হাত দিয়ে একবারও কান স্পর্শ করে দেখে না আসলেই কান নিয়েছে কি না। এটাকে বলে ‘কানকথা’ বা ‘শোনা কথা’। কোনো কথা শুনেই এখানে-সেখানে বলে বেড়ানো হাদিসের ভাষায় অসত্য বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন-
“কারো কাছে কোনো কথা শোনামাত্রই তা বলে বেড়ানো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।” (মুসলিম : ৯৯৬)।
অসত্য প্রচার মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাবাদীর শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন-
“তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
ওদের যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে অনাচার কর না, তারা বলে, আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী। জেনে রেখ, ওরাই অনাচার বিস্তারকারী, কিন্তু ওদের চেতনা নেই’। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০-১২)।
সর্বোপরি বলা যায় যে, অসত্য প্রচার করে সাময়িক সুবিধা পেলেও একসময় মিথ্যুকদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে তারা নিন্দিত হবে এবং পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। যারা সত্যবাদী, তাদের জীবন চলার পথ কিছুটা কণ্টকাকীর্ণ হলেও তারা ইহকালে সম্মানিত হবে এবং পরকালে পাবে উপযুক্ত পুরস্কার।
লেখক: ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।