এবারও শরতের শুভ্র রূপ প্রকাশিত হয়নি বর্ষার তীব্র দাপটে। হেমন্ত চলে এলেও কী এক সখ্যে বর্ষা যেন বাংলার আকাশকে আঁকড়ে ধরেছে ষোড়শী তরুণীর অবুঝ হৃদয়ের মতো। কখনও ঝিরঝিরে পেঁজা তুলোর মতো বাদল নামে, কখনোবা তুমুল বৃষ্টির জলধারা। আবার আকস্মিক প্লাবনও নেমেছে... হেমন্তের এমন প্রকৃতি কে কবে দেখেছে!অথচ এ সময়টায় নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর ঝলমলে রোদের সোনালি আভার সঙ্গে প্রভাতের শিশিরসিক্ত মৃদুমন্দ বাতাসের মিতালিতে প্রকৃতি মনোমুগ্ধকর হওয়ার কথা। জলবায়ুর এমন বদলে যাওয়ায় প্রকৃতি তার আদি রূপ রস থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি বিরহিত করছে গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো নিসর্গ প্রেমিক মানুষদেরও।
কার্তিকের দ্বিতীয় পক্ষে এসে ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে প্রকৃতির পাগলামি। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে শান্ত, স্নিগ্ধ, মনোহর হেমন্ত পূর্ণ প্রাণে বিকশিত হয়ে রূপ-লাবণ্যে পাখা মেলছে আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে। ভোরে হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে ঘাসের ডগায়, ধানের শীষে, পাতায় পাতায় সোনালি সূর্যের আলোয় চোখে পড়ে মুক্তোর মতো শিশিরকণা। দিগন্তবিস্তৃত কাঁচাপাকা ধানের সবুজাভ-হলদে আভায় একাকার চারদিক। ধূসর আবহ ঘিরে শেষ বিকেলে কুয়াশার আবছা আবরণের মৃদু প্রলেপ পড়ে চারদিকে। হালকা শীতের মৃদুমন্দ হাওয়া ঢেউ খেলে যায় সোনালি ধানের শিষে, শুকিয়ে যাওয়া পথঘাটে, খালেবিলে। রাখালের বাঁশির মাতাল করা মোহনীয় সুরে আনমনা উদাসী মন হৃদয়ে ঝংকার তোলে। স্বপ্নীল এক জগৎ হাতছানি দিয়ে ডাকে। শীতের আগমনী বার্তা পৌঁছতে থাকে প্রকৃতির আনাচে-কানাচে। বিবর্ণ পাতারা গভীর বিষাদে ঝরে পড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।এ সময়টায় অদ্ভুত এক রঙের খেলায় মেতে ওঠে প্রকৃতি। রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার এই বিস্ময়কর ক্ষমতা শুধু প্রকৃতি ছাড়া আর কার আছে? এই সৌন্দর্য যেন পৃথিবীর বাকি সবকিছুকেই হার মানায়। নীলাভ আকাশে অসীমের পানে তাকিয়ে নিজেকে হারিয়ে খোঁজার সময় তো এটাই!
হেমন্তের ফুলেরা রঙ-রূপ-গন্ধে জাদুমুগ্ধ করে রাখে সৌন্দর্য পিয়াসীদের। মনোলোভা মল্লিকা, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন আর রাজ-অশোকের হৃদয়কাড়া রঙে, মনমাতানো রূপে প্রাণচাঞ্চল্য বয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে। গভীর রাতে ছাতিমের উদ্দাম তীব্র গন্ধের প্লাবনে আনমনা হয়ে ওঠে মন। কামিনী আর গন্ধরাজের উদাস করা সুবাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে মন। দোলনচাঁপাও তার অদ্ভুত সুগন্ধে বিমোহিত করে রাখে অনুক্ষণ। আর কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের মিষ্টি রোদে ওম মাখানো ছড়িয়ে থাকা শেফালি ফুলেরা ভাবুক হৃদয়ে ঝড় তোলে মুগ্ধতার ছোঁয়ায় আর ভালোবাসার অসীম মমতায়।
কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুটি মাস পেলেও হেমন্ত বড়ই নিঃশব্দ আর ক্ষণস্থায়ী ঋতু। শুরুটা মিশে থাকে বর্ষা আর শরতের ছোঁয়ায়, শেষটা চলে যায় শীতের গহ্বরে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্ত ছুঁয়ে দিয়ে যায় নরম কোমল ঈষৎ পেলবতায়। তবুও হেমন্তের বদলে যাওয়া চিত্র স্পষ্টই ধরা দেয় প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষদের। মানব হৃদয়ের মননশীল অনুভব হেমন্ত ঋতুকে সেভাবেই ছুঁয়ে গেছে যুগে যুগে। তাকে নিয়ে সহস্র ভাবনার বিলাসিতায় উৎসাহিত হয়েছে চিন্তামগ্ন মানুষের হৃদয়। হেমন্তের চরিত্র আর তার বাইরের রূপ নিয়ে জগৎজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য শিল্পকর্ম, লোকগাথা-গল্প, গান ও প্রেমের কবিতা।
পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ, অদ্ভুত হাসি ছড়ানো সূর্যের আলোকিত ঔজ্জ্বল্যের আহ্বানে সর্বজনীন লৌকিক শস্যোৎসব, নবান্নকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই বাংলায় হেমন্ত আসে এক অনাবিল প্রশান্তি নিয়ে। এক সময় অত্যন্ত সাড়ম্বরে সব মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উদ্যাপিত হলেও কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব বিলুপ্তপ্রায়। তবুও কৃষান-কৃষানির স্নিগ্ধমধুর হাসিই বলে দেয় হেমন্ত এসেছে, নতুন ধান এসেছে, অভাবকে বিদায় দেবার দিন সমাগত।এক সময় বাংলার বছর শুরুই হতো হেমন্ত ঋতু দিয়ে। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ এ দুটি তারার নামানুসারে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের নাম রাখা হয়েছে। আবার ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুম’। অগ্রহায়ণ যেহেতু ফসল তোলার মাস, তাই সম্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকা তৈরির সময় অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কৃষিভিত্তিক আবহমান বাংলায় হেমন্ত একদিকে মানুষের মনে আনন্দ, ঐশ্বর্য আর দিন বদলের স্বপ্ন দেখায়; অন্যদিকে প্রবল কষ্ট আর হাহাকারেও বিদীর্ণ হয়ে ওঠার সময় এই হেমন্তই। এ সময় নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে কৃষকের মন। ভবিষ্যতের ঘোরলাগা স্বপ্নীল দিন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভাগ্য বদলের একমাত্র হাতিয়ার; শস্যের ভেতর স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। এ ঋতুর শুরুতে ক্ষুধার হাহাকার, অন্নের তীব্র কষ্ট; শেষে শস্যের প্রাচুর্য। শস্য ওঠার আগ মুহূর্ত আনন্দের বান ডেকে যায় কৃষকের হৃদয়ে; দৈবদুর্বিপাকে সেই শস্য নষ্ট হয়ে গেলে বিভীষিকা নেমে আসে জীবনে।
ঋতুর শুরুতে অর্থনীতির নতুন সোপান রচনা করে প্রাণোচ্ছলতা বয়ে যায় মনে। আশানুরূপ সাফল্য না পেলে বিষণ্ণতা নেমে আসে পুরো বাংলায়। তাই এ ঋতুতে বিস্ময়কর বৈপরীত্যও বিরাজমান। এমনই আনন্দ-বেদনার যুগপৎ উপলব্ধির নামই হেমন্ত।প্রকৃতি তার প্রতিবেশকেও সাজিয়ে রাখে অতিথি পাখিদের স্বাগত জানাতে। সময়ের মেলবন্ধনে সাজসজ্জা, গভীর টান আর অনুরাগে তাই হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসে পরিযায়ী পাখি। হাওর বাওর বিল ঝিল নদীগুলো মুখরিত করে রাখে তাদের কলকাকলিতে।ঘুমভাঙা সকালে কুয়াশার পাতলা আঁচল পাতা নিসর্গ আর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত মেঘমুক্ত রাতের আকাশের মোহনীয় রূপ আবিষ্ট করে রাখে প্রকৃতি প্রেমিকদের। অজান্তেই মনের ভেতর মৃদঙ্গ বেজে ওঠে। অনুপম নির্জন প্রকৃতির সান্নিধ্য, এলোমেলো ভাবনাগুলোকে একত্রিত করার এক চমৎকার বাতাবরণ, যা কল্পিত হৃদয়ে ঘোরলাগা আকাঙ্ক্ষায় মোহগ্রস্ত করে রাখে। এ যেন বাস্তব জীবনে প্রবেশের আগে আরেক অধিবাস্তব জীবন; যেখানে সংবেদনশীল জগতের অস্তিত্ব, কল্পনা ও স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চলমান জীবনের ভেতর আরেক জীবন; যে জীবনে আনন্দ, ভালোবাসা, ভালোলাগা, এমনকি দুঃখের মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায় জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার রসদ। যা একান্তই নিজস্ব, আপন, ভীষণ আপন।লেখক : শিক্ষক-প্রাবন্ধিক