বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মেঘদলের ‘ওম’ এবং অত্যুৎসাহীদের অনুভূতি!

  •    
  • ৬ নভেম্বর, ২০২১ ১৬:৪৩

একজন শিল্পী যদি সর্ব ধর্মের মিলন তথা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বোঝাতে মসজিদ মন্দির গির্জা ও প্যাগোডার সিম্বল নিয়ে একটি ছবি আঁকেন, তাহলে কি তার বিরুদ্ধে এই প্রশ্ন তোলা হবে যে আপনি কেন মসজিদ মন্দিরকে একসঙ্গে আঁকলেন? তার বিরুদ্ধে কি ধর্ম অবমাননার মামলা হবে?

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কথিত কটুক্তির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলার আবেদন করা হয় সম্প্রতি। যেদিন আদালতে গিয়ে বাদী জানালেন যে, তিনি মামলাটি চালাবেন না; এর কদিন পরেই গণমাধ্যমে একটি চমক জাগানো খবর প্রকাশিত হয়, ‘মেঘদল’ নামে একটি ব্যান্ড দলের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ মামলা করেছেন একজন আইনজীবী। শুধু তাই নয়, মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।

খবরে বলা হয়, সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে আয়োজিত একটি কনসার্টে ‘ওম’ শিরোনামে একটি গান পরিবেশন করে মেঘদল। কিন্তু এই গানের কিছু কথা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে— এমন অভিযোগে মেঘদলের বিরুদ্ধে ২৮ অক্টোবর দণ্ডবিধির ২৯৫(ক) ধারায় একটি মামলা করেন ইমরুল হাসান নামে একজন আইনজীবী। এতে আসামি করা হয় মেঘদলের শিবু কুমার শীল (গায়ক), মেজবাউর রহমান সুমন (গায়ক), রাশিদ শরীফ শোয়েব (গিটারবাদক ও গায়ক), এমজি কিবরিয়া ( বেজ গিটারবাদক), আমজাদ হোসেন (ড্রামবাদক), তানভির দাউদ রনি (কি বোর্ডবাদক) এবং সৌরভ সরকারকে (বাঁশিবাদক)।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় ধর্মীয় অবমাননার ব্যাখ্যা ও শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে যে, যেকোনো ধর্মের মানুষের জন্য তাদের বিশ্বাস আহত হলে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। ২৯৫ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের কোনো নাগরিককে মৌখিক, লিখিতভাবে বা অন্য কোনো উপায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে তা ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ব্লাসফেমি আইন করার দাবিও উঠেছিল। বিশেষ করে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে যে ১৩ দফা দাবি তোলা হয়, তার দুই নম্বরেই এই দাবিটি ছিল।

সরকার সেই দাবি মেনে না নিলেও ২০১৮ সালে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে, সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি আরও বাড়িয়ে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যদিও ধর্মীয় অনুভূতির মানদণ্ড কী এবং কী করলে সেটিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হবে— তা এই আইনে স্পষ্ট নয়। সম্ভবত আইনে বিষয়টি অস্পষ্ট রাখাই হয়েছে যাতে যেকোনো সময় যে কাউকে এই আইনে যাতে সহজেই ভিকটিম করা যায়।

‘ওম’ শিরোনামে মেঘদলের গানটি ২০০৪ সালে তাদের ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা’ অ্যালবামে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মানে গত ১৭ বছর ধরে গানটি নানা ফোরামে এই ব্যান্ড দল গেয়েছে এবং গানটি ইউটিউবেও রয়েছে। অথচ ১৭ বছর পরে গিয়ে কোনো একজন আইনজীবীর মনে হলো যে, গানটিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে এবং সে কারণে তিনি মামলা করে দিলেন। উপরন্তু আদালতও সেটি তদন্তের জন্য খোদ পিবিআইয়ের মতো একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন!

কী আছে এই গানে?

সুমধুর বাঁশির সুরের সঙ্গে হিন্দুদের মন্ত্র। তারপরে মুসলমানদের হজের সময়ে উচ্চারিত বাক্য ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। গানের যে ধরন, যন্ত্র ও সুরের ব্যবহার, তাতে এখানে স্পষ্ট যে, এই গানে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, ধর্মের মূল বাণী যে ঐক্য ও শান্তি সেই কথাই বলা হয়েছে। মুসলমানদের প্রধান বাক্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং কোরবানি বা ত্যাগের বিষয়টিও রয়েছে। এখানে ধর্মের অবমাননা হলো কোথায়?

হিন্দুদের তীর্থে যাওয়া এবং মুসলমানের হজে যাওয়ার বিষয়টিকে অভিন্ন দর্শন থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে গানে। একজন গীতিকার এভাবে লিখতেই পারেন। এটা একজন শিল্পীর স্বাধীনতা। এটুকু স্বাধীনতা না থাকলে পৃথিবীর কোথাও কোনোকালে কোনো শিল্প বা সাহিত্য সৃষ্টি হতো না।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও লিখেছিলেন, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।’ নজরুল যখন এই কবিতা লেখেন তখনও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলার আইন ছিল। অথচ সেই সময়ে এই কবিতার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা হয়নি। কিন্তু নজরুল বেঁচে থাকলে নিশ্চিত এখন মামলার আসামি হয়ে যেতেন এই অভিযোগে যে, তিনি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন আঁকার কথা লিখেছেন মানে তিনি ভগবানের বুকে লাথি মারতে চেয়েছেন। ধর্ম নিয়ে এরকম অতি উৎসাহী লোকের সংখ্যা এখন সমাজে অনেক। ফলে প্রশ্ন হলো- গত একশ বছরে আমরা শিক্ষা-দীক্ষা, সহনশিলতা, রুচি ও মননে এগোলাম না পেছালাম?

সুধীন্দ্রনাথ দত্তর ‘বিস্মরণী’ কবিতার লাইন: ‘উড়ায়ে মরুর বায়ে ছিন্ন বেদ-বেদান্তের পাতা/ বলেছি পিশাচহস্তে নিহত বিধাতা।’ তো এখন কি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিরুদ্ধে বেদ-বেদান্তের পাতা ছিন্ন করা কিংবা পিশাচের হাতে বিধাতার নিহত হওয়ার কথা লেখার অপরাধে ধর্ম অবমাননার মামলা হবে? আরেকটি কবিতায় তিনি বিধাতাকে ‘উদাসীন’ বলে মন্তব্য করে লিখেছেন: ‘বুঝিবে কি সে দুর্দিনে—উদাসীন বিধাতার কাছে / তুল্যমূল্য আমাদের ধৈর্য আর আত্মবিস্মরণ।’

জীবনানন্দ দাশও ঈশ্বরকে ‘ভুখা’ বলে উল্লেখ করেছেন তার একটি কবিতায়:

‘জানি না ঈশ্বর কে বা

জানি শুধু ভুখা ভগবান,

দিনগত পাপ ক্ষয় করে পাব ত্রাণ;

তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে কিংবা

কাশী মিত্রের তল্লাটে পড়ে রব।’

১৯৪৯ সালে লেখা ‘সত্য, বিশ্বাস ও কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘ধর্ম এখনো দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু সত্য—নিজের এলাকার সত্যগুলোও তার বিজ্ঞানের হাতে চলে যাচ্ছে—দেখছে সে, তার সত্য ভুল? বিজ্ঞানের সমস্তই সত্য? ধর্মের নষ্ট সত্যগুলোর স্থিরতর মানে বেরুবে কিন্তু বিজ্ঞানে খণ্ডিত না হয়ে? না সত্যই বদলে যাবে ধর্মের? অন্য এক নতুন জিনিসকে ধর্ম বলা হবে?’

গান-কবিতা-সাহিত্য বা চিত্রকর্মে এরকম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আনা হলেও আরও অসংখ্য অভিযোগ করা যায়। বিশেষ করে কবিগান, জারিগান, কাওয়ালি এমনকি লালনের অনেক গানের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ আনা যায়। এখন কি তাহলে ওইসব গানের বিরুদ্ধেও মামলা হবে?

বাংলাদেশে প্রচারিত পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গীতিকার সলিল চৌধুরী রচিত একটি বিখ্যাত গান ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা/ আজ জেগেছে এই জনতা’। গানটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রেরণা জোগায়। এখন কেউ কি এই গানের গীতিকার বা রেনেসাঁর বিরুদ্ধে বিচারক এবং বিচার বিভাগের অবমাননার অভিযোগে মামলা করেন, আদালত কি সেই মামলা আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেবেন?

একজন শিল্পী যদি সর্ব ধর্মের মিলন তথা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বোঝাতে মসজিদ মন্দির গির্জা ও প্যাগোডার সিম্বল নিয়ে একটি ছবি আঁকেন, তাহলে কি তার বিরুদ্ধে এই প্রশ্ন তোলা হবে যে আপনি কেন মসজিদ মন্দিরকে একসঙ্গে আঁকলেন? তার বিরুদ্ধে কি ধর্ম অবমাননার মামলা হবে?

প্রশ্ন হলো, কথিত মানহানি কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে যারা এরকম মামলা করেন, তাদের আসলে উদ্দেশ্য কী?

মূল উদ্দেশ্য সম্ভবত নিজেকে কথিত মানহানি হওয়া ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ বা অনুগত বলে নিজেকে প্রমাণ করে কোনো না কোনো স্বার্থ সিদ্ধি করা অথবা এ জাতীয় মামলা করে আলোচনায় আসা।

মেঘদলের বিরুদ্ধে যে আইনজীবী মামলা করেছেন, তার ব্যাপারে একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদে বলা হয়েছে, সুযোগ পেলেই তিনি মামলা করেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে গত বছরের ২৫ অক্টোবর তিনি মামলা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়া রহমানের বিরুদ্ধে। এরপর গানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেন চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে।

রাষ্ট্র এ জাতীয় অত্যুৎসাহী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয় না। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রও হয়তো চায় যে, মানুষ ভয়ের মধ্যে থাকুক। যাতে কেউ কোনো বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পায়। মানুষ যাতে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সমাজ রাষ্ট্র নিয়ে তারা যাতে না ভাবে।

ভাবলেও সেই ভাবনার প্রকাশ যাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় না আসে। কারণ মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষোভ ও ভাবনার মিলিত প্রকাশের কী বিশাল শক্তি— তার বড় উদাহরণ গণজাগরণ মঞ্চ; তার বড় উদাহরণ নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। রাষ্ট্র এসব মঞ্চ ও আন্দোলনকে ভয় পায়। ভয় পায় কারণ এসব বিক্ষোভের মুখে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। তাতে রাষ্ট্র বিব্রত হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর