অনেকদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সবেমাত্র খুলতে শুরু করেছে। বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ছাত্রাবাসে ফিরে আসতে শুরু করেছে। এখন তাদের একদিকে যেমন পড়াশোনা, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য বজায় রেখে কীভাবে শিক্ষাজীবন দ্রুত শেষ করবে সেটিই সবচাইতে বেশি প্রত্যাশিত। মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সব মহলই সংযত আচরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাস্তবতাই দেখতে চায়।
দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো- চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ খুলতে না খুলতেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত মারামারির ঘটনায় বন্ধ করে দিতে হলো। মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একটি অংশের এটি মোটেও কেউ আশা করতে পারেনি। তাদেরকে আমাদের সমাজ সবসময় মেধাবীদের আসনে দেখে এসেছে। কিন্তু এই মেধাবীরাই যখন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারিতে লিপ্ত হয়, তখন আমাদের কষ্টের কথা বলার জায়গা থাকে না। আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও মেধাবীদের জায়গা বলে মনে করে থাকি।
সেখানেও যখন হামলা, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ঘটার খবর প্রচারিত হয়। তখন এই মেধাবীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারি না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও যখন হলগুলোতে নানা ধরনের অনিয়ম, জোর জবরদস্তির সঙ্গে ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয়ে কেউ জড়িয়ে পড়ে তখন ছাত্র রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মারামারির ঘটনাটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রভাব এবং নানা ধরনের অছাত্রসুলভ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ঘটেছে।
গণমাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। কয়েকজন এরই মধ্যে ধরাও পড়েছে। বিচার কতটা কী হবে জানি না তবে চমেকের ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি এবং হবু ডাক্তারদের কয়েকজনের ছাত্রাবাসে অবস্থানের পেছনে লেখাপড়ার চাইতে প্রভাব বিস্তার এবং অন্যান্য অনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত রয়েছে জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করতে হচ্ছে। আহত দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিব এ লেখা লেখার সময়ও আইসিউতে চিকিৎসাধীন আছেন। সে তো তাদেরই কারো না কারো সহপাঠী আবার রাজনৈতিকভাবেও একই মতাদর্শের অনুসারী। তারা তো কেউ কারো শত্রু হওয়ার কথা নয়।
একজনের শরীরে আরেকজনের হাত বা লাঠি ওঠারও কথা নয়। কে তাদের সেই অধিকার দিয়েছে? তারা কি সেই সভ্যতা-ভব্যতাগুলো শিখে আসেনি? তাহলে তারা কীভাবে মেধাবী ছাত্র হলো? মেধাবী ছাত্র তো তাকেই আমরা বলব যে লেখাপড়া, আচার, আচরণ, চিন্তাভাবনা ও দেশপ্রেমে প্রশ্নাতীতভাবে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই, মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই তাকে ভালো ছাত্রের সংজ্ঞায় ফেলা যায় না।
মেধাবী ছাত্রকে সাধারণত ভালো ছাত্র হিসেবেও ভূষিত করা হয়, শিক্ষাজীবনে সেই ভালো যে আচার-আচরণ, যুক্তি-স্বাভাবিক ছাত্রসুলভ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক-পরবর্তী জীবনের শিক্ষায় অনেকেই নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারছে না, জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে; যেখানে লেখাপড়া ও অধ্যয়নের নিরন্তর যুক্ত থাকাটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়।
ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী স্বাভাবিক লেখাপড়ার সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত না রেখে রাজনৈতিক অনেক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়। যা তাদেরকে আগের পরিচয়ে চেনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনটি যখন ক্ষমতাসীন কোনো সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন হয় তখন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের অনেকেই নিজেদের ছাত্রত্ব ভুলে গিয়ে নেতার আসনে নিজেকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসে দলীয় প্রভাব বিস্তার এবং দলের নেতা হওয়ার মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎকেও ভাবতে শুরু করে। তাদের অধীত বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞ হওয়ার চিন্তা কেন তারা করতে পারে না?
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন বিশেষজ্ঞ দেশ এবং জাতিকে অনেক কিছু দেয়ার রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাজনীতিতে কতজন সফল হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে অনেকে পা বাড়ায়। সরকারি দল হলে টেন্ডারবাজি করা, অর্থকীড় আদায় করা কিংবা কোথাও অমুক গ্রুপ, তমুক গ্রুপের নেতা হয়ে প্রভাব বিস্তারের মধ্যে এক ধরনের চমক ও শিহরণ অনুভব করা যেতে পারে। কিন্তু আখেরে সমাজে শ্রদ্ধার চাইতে অশ্রদ্ধা ও আতঙ্কের ভাবমূর্তিই অনেকে তৈরি করে থাকে।
এই বিষয়গুলো তৎকালীন সরকারি দলের ছাত্রনেতারা ভুলে যায়। কিন্তু পেছনে ফিরে ইতিহাসটা দেখলে অনেকের জীবনের করুণ পরিণতি দেখার অভিজ্ঞতাও তাদের ঘটত। কিন্তু তরুণ নেতারা পেছনে দেখতে চায় না, বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। অর্থ-বিত্ত ও প্রভাবশালী হওয়ার মধ্যে জীবনে বড় হওয়ার যে স্বপ্ন দেখে তা আদৌ মেধাবীদের কাছে আশা করা যায় না।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে একসময় ছাত্র শিবিরের প্রভাব ছিল। তাদের হাতে অন্য শিক্ষার্থীরা নিগৃহীত হয়েছিল। ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ অনেকটাই তাদের ‘কৃপার’ ওপর নির্ভরশীল করত। হানাহানি, মারামারি তখনও ঘটেছিল। বিএনপির শাসনামলে ছাত্রদলের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনও ছাত্রাবাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিংবা ছাত্রলীগ সমর্থকদের আসন নিয়ে দলীয় প্রভাব থেকে নানা ধরনের সংঘাত সৃষ্টি হতো।
স্থানীয় বিএনপির উপদলীয় কোন্দল চমেকেও পড়েছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে নগর পিতা মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছিরের সঙ্গে তার বিরোধ চট্টগ্রামের সব প্রতিষ্ঠানের মতো চমেকেও পড়েছে। এখন মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবিত নেই , তার ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছেন। আ জ ম নাছির নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র।
তাদের উভয়ের দীর্ঘদিনের বিরোধ নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কিছু করণীয় থাকলে করাটাই ভালো ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল এবং কলেজগুলোতে ছাত্রলীগের যে বিরোধটি যুগ যুগ ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে তাতে ছাত্রলীগের রাজনীতি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, আওয়ামী লীগেরও ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে গত ২৯ তারিখে সাধারণ কথাকাটাকাটি থেকে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, তাতে দুজন আহত হয়। এভাবে উত্তেজিত হওয়ার পেছনে সাধারণ কোনো কারণ থাকে না। থাকে দীর্ঘদিনের বিরোধ, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব এবং দলীয় রাজনীতির বিশেষ ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য।পরদিন শনিবার ক্লাসে যাওয়ার সময় এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে হামলা করে।
যেন ওরা বাচ্চা শিশুর চাইতেও কম বিবেক দ্বারা পরিচালিত মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্র, আবার ছাত্র সংগঠনের নেতাও! শনিবারের ওই আক্রমণে দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিব গুরতর আঘাতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার অবস্থায় চলে যায়। তাকে চমেক হাসপাতালে আইসিউতে ভর্তি করা হয়। তার ওপর এমন আক্রমণের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা দেখেই মেডিক্যাল কলেজের কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়, ছাত্রছাত্রীরা আবার বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
কলেজে আসতে না আসতেই এই ফিরে যাওয়াটি তাদের শিক্ষাজীবনের ওপর আবার বাধা হয়ে দাঁড়াল। চমেক হবু ডাক্তারদের শিক্ষাজীবন আবার অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ছাত্রলীগ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ কীভাবে এই জট খুলতে এগিয়ে আসবে সেটা এখন দেখার বিষয়। ছাত্রলীগ তো দাবি করে থাকে তাদের মূল নেতা হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে কি সেখানেও হস্তক্ষেপ করতে হবে?
লেখক: গবেষক-অধ্যাপক।