সময়টা এখন বন্যার নয়, নয় বৃষ্টিরও। অথচ এই হেমন্তেও তিস্তার আকস্মিক প্লাবনে ক্ষেতের ফসল হারিয়ে দিশেহারা উত্তরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। প্রতিদিনের বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত রবিশস্য। বছরজুড়েই প্রকৃতির এখন বৈরিতা।প্রকৃতির চরম অসহিষ্ণুতায় ঋতু বৈচিত্র্যের সেই বাংলাদেশ আর নেই। জলবায়ুর এমন বদলে যাওয়ায় প্রকৃতি তার আদি রূপ রস হারিয়েছে অনেক আগেই। বছরের অল্প কিছু সময় বাদ দিলে বাকি সময়টা তীব্র গরমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
অসময়ের বৃষ্টিতে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কারণে অকারণে যেকোনো সময় শুরু হয় অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি, যার ফল হলো- বন্যা অথবা খরা। তবে এ চিত্র শুধু বাংলাদেশর নয়, পুরো পৃথিবীই এখন উষ্ণতার বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এবং এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র মানুষই দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব প্রকৃতিতে যেমন পড়েছে, জীব বৈচিত্র্যেও পড়েছে। ফলে, প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বৈশ্বিক পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। শিল্পোন্নত দুনিয়ার লাগামহীন কার্বন নিঃসরণ এবং মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এই গ্রহখানিকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
এমনই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক উষ্ণতারোধে করণীয় নির্ধারণের ধারাবাহিকতায় আজ (৩১ অক্টোবর) থেকে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু (কপ-২৬) সম্মেলনকে ঘিরে তাই ঔৎসুক্য পরিবেশ সচেতন সবার মনে। ঐকমত্যে পৌঁছানোর অপূর্ব সুযোগ হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই সম্মেলনকে। যদিও একমত হওয়া খুব কঠিন। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়, সবাইকে এক কাতারে আনা যায়নি।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘ গঠিত আন্তঃসরকার জলবায়ু প্যানেলের ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন-সংক্রান্ত যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেগুলো মারাত্মক বিপজ্জনক। অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে তাপমাত্রার ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি রোধে বিশ্ববাসী যদি এখনই ঐকমত্যে আসতে না পারে তাহলে বর্তমান শতাব্দীর শেষে বাসযোগ্য পৃথিবীর চিন্তা অনেকটাই কল্পনার বাইরে চলে যাবে।
মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বছরে ৫১ বিলিয়ন টন গ্রিন হাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে যোগ হয়। এর প্রায় পুরো দায় শিল্পন্নোত ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর। অথচ তাপমাত্রা হ্রাসে প্রায়ই তারা উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোকে জবরদস্তিমূলক বিভিন্ন পন্থা চাপিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষের দিকে। গবেষণায় উঠে এসেছে, বড় দুই অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মিলে ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করছে বায়ুমণ্ডলে। এর মধ্যে চীন করছে ২৮ শতাংশ। অথচ ওই নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান নগণ্য, মাত্র ০.৪২ শতাংশ। শিল্পোন্নত দেশের অসহযোগিতায় জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। ফলে কার্বন নিঃসরণের হার না কমে বরং বেড়েছে। ২০১৮ সালে এই হার দুই শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টনের রেকর্ড ছুঁয়েছে।
আবার শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে আটকা পড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উষ্ণতা বাড়ার কারণে দাবানলে বনভূমি পুড়ে সেখানেও বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হচ্ছে। সবকিছু মিলে উষ্ণায়নের কারণে বেড়েই চলেছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। ফলে বাড়ছে মেরু অঞ্চলের বরফ গলার হার । প্রতিনিয়ত গলছে হিমবাহের বরফ, উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। বাড়ছে খরা দাবদাহ বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র।
জলবায়ু সহনীয় রাখতে উন্নত দেশগুলোর আচরণ প্রথম থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। তাই গ্লাসগো সম্মেলনে উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলোর চাহিদার বিষয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে রাজি করতে ব্যাপক চাপ প্রয়োগের বিকল্প নেই।প্রতিবারই বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের আগে ধরিত্রীর উষ্ণায়নে উন্নত দেশগুলোর দায় নিয়ে ব্যাপক শোরগোল হলেও, সম্মেলন শেষে সবকিছু থেমে যায়।
যেমন ২০১৫ সালে সম্পাদিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুসারে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে উন্নত দেশগুলো ২০২০ সাল থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যাতে তাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা সহজ হয়। কিন্তু জাতিসংঘ সম্প্রতি বলেছে, এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। ফলে, এই প্রতিশ্রুতির মাত্রা বাড়ানোর জন্য ধনী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ধাক্কা ইতোমধ্যে বড় শহরগুলোতে লাগতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এসেছে, নগরগুলো দিন দিন মাত্রাতিরিক্ত হারে উত্তপ্ত হচ্ছে। এ কারণে মানুষের বহু শ্রমঘণ্টা নষ্টের সঙ্গে দাবদাহে মৃত্যুর শঙ্কাও বাড়ছে।
আবার জলবায়ুর রূপান্তরে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অসময়ে বন্যায় জীবন-জীবিকা, কৃষিসহ নদীভাঙনে বিরূপ প্রভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ শহরে ভিড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরগুলো বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। গবেষণায় উঠে এসেছে ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী রোগের বিস্তারেও উষ্ণায়নের প্রভাব দায়ী। বাড়ছে ভারী ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যনতুন দুর্যোগের। বড়-মাঝারি শহরগুলোতে জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত ঘটনা।
জলবায়ু সম্মেলনের আগে এক বিবৃতিতে এ নিয়ে কথা বলেছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি)। তারা বলেছে, ‘ বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানো এবং জলবায়ু অর্থায়ন বাড়ানো আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি।জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনে আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসি) বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়ে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, হিমালয় থেকে শুরু করে আ্যন্টার্কটিকা-জুড়ে হিমবাহ ও বরফের স্তূপ আগের তুলনায়ও দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে। এর আগে আইসিপি সতর্ক করলেও গত বছর বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও গ্রিনহাউজ গ্যাসের উপস্থিতির কারণে ভয়াবহ পরিণতির মুখে রয়েছে বিশ্ব।জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ অংশে আইপিসি তাদের প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানিয়েছে যে, এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে৷
দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ওই ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে৷ এ কারণে গৃহহীন হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ৷ এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমছে, বাড়ছে নিত্য নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ৷ সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা৷ ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে৷ বেড়েছে বজ্রপাতের পরিমাণও। গবেষকরা বলছেন, কোনো জায়গায় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের পরিমাণ ১২ শতাংশ বেড়ে যায়৷ বিজ্ঞানীরা বলেন, শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী বিশ্বের তাপমাত্রার তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচা যাবে।
শিল্পোন্নত শীর্ষদেশগুলো এখনও পর্যন্ত কার্যকর প্রতিশ্রুতি না দেয়ায় উষ্ণায়নের ঝুঁকি না কমে বরং বেড়েছে। তাদের কোনোভাবেই বাধ্য করা যাচ্ছে না। যদিও জার্মানি, ফিনল্যান্ড, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো নিজেদের মতো করে এই পরিস্থিতি উত্তরণের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর মনোভাবের কারণে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে৷
ভারত বলেছে, আগামী এক দশক তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু না রাখলে বিদ্যুৎ সংকট সামাল দিতে পারবে না। কার্বন ঢেলে দেয়া শীর্ষ দেশগুলো যদি মানবিক না হয়, যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তাহলে এ পৃথিবী ক্রমশই উত্তপ্ত হতে থাকবে। বিপন্ন হতে থাকবে প্রাণিকুলের অস্তিত্ব।
এখন পর্যন্ত যেসব প্রাণী টিকে আছে, তারাও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের মতো বিপন্ন হতে হতে একসময় বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হবে। আর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলেই সৌরজগতের একমাত্র প্রাণের আধার এ ধরিত্রী, নির্জীব প্রাণহীন গ্রহে পরিণত হয়ে যাবে। তাই উষ্ণায়ন রোধে, ১.৫ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নামিয়ে আনতে পরিবেশেবাদীরা গ্লাসগোর রাস্তায় নেমেছে প্ল্যাকার্ড হাতে।ধরিত্রী সুশীতল রাখতে বিশ্ব নেতাদের মানবিক বোধ জাগ্রত হওয়ার বিকল্প নেই। নইলে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে মহাকালের অসীম গহ্বরে।
লেখক: শিক্ষক-প্রাবন্ধিক