পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশের স্বাধীনতার শত্রুরা বেঁচে আছে; পৃথিবীর কোনো দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই যারা তাদের জন্মভূমির স্বাধীনতার শত্রুদের তল্পিবাহক হিসেবে গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম মানবাধিকারের চূড়ান্ত নিদর্শন স্থাপনকারী একটি দেশ। এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি শুধু বেঁচে আছে তাই নয়, তারা দিব্যি সক্রিয়ভাবে ক্ষমতাচর্চার রাজনীতি করে আসছে। তারা নানা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবৈধভাবে একাধিকবার এদেশের ক্ষমতা দখল করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহিদের রক্তেরাঙা বর্ণমালায় প্রণীত সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক চরিত্রকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
যার চূড়ান্ত প্রতিফলন হিসেবে লাল সবুজের পতাকাকে বদলে দেয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান এবং বীর বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে পাকিস্তানের ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে অপসারণ করা পাকিস্তানি ভাবধারায় নেয়ার অপতৎপরতা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জিয়া কর্তৃক ক্যান্টনমেন্ট-সৃষ্ট দুর্নীতি, লুটতরাজ ও খুনি সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর জনবিচ্ছিন্ন দল বিএনপি। বাংলাদেশবিরোধী এই গোষ্ঠীগুলো সংঘবদ্ধভাবে তাদের হীন অপচেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পাকিস্তানি দালাল বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী কোনোভাবে রাজপথে যৌক্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে সম্প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক ফ্যাশাদ লাগিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়ার হীন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন ও বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার জন্যেই কুমিল্লায় দুর্গাপূজার মণ্ডপে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে পবিত্র কোরআন রেখেছিল স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের ক্যাডারেরা। বিশদ তদন্তে সিসি ফুটেজ দেখে তা এখন প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা দেখলাম বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে পর্যালোচনা না করেই, বিবেকবুদ্ধি দিয়ে চিন্তা না করেই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দোষারোপ করে তাদের পূজামণ্ডপ ভাঙচুর এবং তাদের বসতবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জবরদখল, চুরি, লুটপাট করার মাধ্যমে তাদের তথাকথিত ঈমানের নগ্ন পরিচয় দিয়েছে। আদতে তারা কি ঈমানের পরিচয় দিতে পারল! এই যে তারা নিরপরাধ মানুষকে আক্রান্ত করল, অসহায় মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল, ধর্মকে পুঁজি করে লুটপাট এবং চুরির মতো জঘন্য কর্মকাণ্ড করল; এতে কি তাদের পাপ হয়নি?
ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নামধারী মুসলমান কোরআনকে অপমান করল এর জন্য তারা কি বিচারের মুখোমুখি হবে না? তাদের কি আল্লাহর আদালতে বিচার হবে না?
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কসাই ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানসহ কায়েমি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনো কূলকিনারা না পেয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধান করতে না পেরে ধর্মের বিষবাষ্প ছড়িয়ে এদেশের নিরস্ত্র গণমানুষের উপর গণহত্যা এবং লুটপাট চালানো শুরু করল। এমনকি তারা গণমানুষকে নগ্ন করে গণতল্লাশি চালিয়েছে যারা হিন্দু তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। মা-বোনদের ধরে নিয়ে তাদের যৌন লালসা চরিতার্থ করে গণহত্যা চালিয়েছে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের ‘পাকিস্তানি জেনারেলদের মন’ বইটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। আজকের সমাজে এসে ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, হানাহানি কেন হচ্ছে? এর দায়ভার রাষ্ট্রযন্ত্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে- যখন এদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানি বাহিনীকে চারদিক থেকে পাকড়াও করে ফেলছিল তখন বাঙালি জাতির চিরশত্রু গাদ্দার জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘ (যার বর্তমান নাম ছাত্রশিবির) দ্বারা গঠিত পাকিস্তানি দালাল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচারের অংশ হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতের চর হিসেবে অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করত, তাদের ষড়যন্ত্রমূলক অপচেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
পাকিস্তানের পা-চাটা গোলাম এই বর্বর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি ইসলাম রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে ও লক্ষাধিক মা বোনকে গণধর্ষণ করে হত্যা করে। কিন্তু সেসময় বাংলার ভূমি সন্তানেরা হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বীর বাঙালি মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে কাপুরুষ পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছিল।
পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা। এই যে আজকের শিক্ষিত সমাজেও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের উদ্গীরণ ঘটছে তার পেছনেও রয়েছে বাংলা ও বাঙালির শত্রুদের দীর্ঘদিনের সুচতুর পরিকল্পনা। সুদীর্ঘকাল ধরে এদেশের মানুষকে সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া করে দেয়ার এক ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দালালগোষ্ঠী।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের জিঘাংসু প্রজন্ম বাংলার মাটিতে এখনও বেঁচে আছে। এ জাতির উপর তাদের ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা এখনও তৎপর রয়েছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করার মোক্ষম অস্ত্র হলো সে জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকবোধকে বিনষ্ট করে দেয়া।
সে অপচেষ্টার অংশ হিসেবে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দালালগোষ্ঠীর হীন উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবায়নের জন্য বাঙালিকে জ্ঞানবিমুখ ও সংস্কৃতিবিমুখ করা একান্ত জরুরি। এরই অংশ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিকে সাংস্কৃতিকভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে খুনি জিয়া, খালেদা-নিজামীর বিএনপি জামায়াত গংয়ের সুকৌশলী চক্রান্ত আজ বর্ণনা করব। যাদের বয়স ৩০ এবং যারা প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত, যাদের মন এবং মনন আলোকিত তারা বিষয়টি বোধ করি ধরতে পারবেন। বিএনপি জামায়াত খুনিচক্র বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে যে প্রক্রিয়ায় নির্মূল করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো-
১. শিক্ষিত প্রজন্মকে সিনেমা হল-বিমুখ করার লক্ষ্যে বাংলা চলচ্চিত্রে ভয়াবহ রকমের অশ্লিলতা ও কাটপিসের (নগ্ন চিত্র প্রদর্শন) প্রবর্তন করা হয়
২. সিনেমা হলে ও বৈশাখী মেলায় বোমা হামলা
৩. উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কর্মসূচিতে বোমা হামলা
৪. প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা।
৫. জঙ্গিগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় মদদ প্রদান করা
৬. তারেক জিয়া ও বাবরের পরিকল্পিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় খালেদা-নিজামী সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা।
৭) খালেদা-নিজামী সরকার কর্তৃক জেএমবি, বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান।
এছাড়াও, অসংখ্য অগণিত রাষ্ট্রীয় অপরাজনৈতিক কুকর্ম সম্পাদনের মধ্য দিয়ে বাংলাকে সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি দালাল বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী।
আজকের দিনে নতুন প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, একটি সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ নিয়ে বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানের দালালগোষ্ঠী বিএনপি-জামায়াতের বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অমোঘ নির্দেশনা অনুসরণ করে পথচলায় সর্বাগ্রে গুরুত্বারোপ করতে হবে, জাতির পিতা এ জাতিকে যেসব কালোত্তীর্ণ নির্দেশ প্রদান করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. ‘সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।
২. সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ, শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।
৩. যদি আমরা বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে আত্মঘাতী সংঘাতে মেতে উঠি, তাহলে যারা এদেশের মানুষের ভালো চান না ও এখানকার সম্পদের ওপর ভাগ বসাতে চান তাদেরই সুবিধা হবে এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে।
৪. পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।
এদেশের জন্মলগ্ন থেকে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া রাজনৈতিকগোষ্ঠী বিএনপি-জামায়াত এ মাটিকে গুজব ষড়যন্ত্রের অপরাজনীতির মাধ্যমে রক্তাক্ত করেছে, ক্রমাগত ছিন্নভিন্ন করে চলেছে তাই তরুণ প্রজন্মকে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে পথচলতে হবে। আমরা যেন অপশক্তির হীনউদ্দেশ্যে পাতা ফাঁদে যেন না পড়ি। আমাদের চিন্তাভাবনা ও শিক্ষা যেন মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে না যায়।
আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রামের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন “যখন একজন মানুষ বিবেচনা করে যে, নিজজাতি এবং স্বদেশের প্রতি সে তার দায়িত্ব পালন করেছে, তখন সে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে।”
সবশেষে মহান স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করছি- ‘একবার একান্ত আলাপচারিতায় যুবলীগের কয়েকজন কর্মীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙা রেখে দিস। লোকে জানবে এই একটা লোক একটা টিনের চোঙা হাতে নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিল এবং সারাজীবন সেই টিনের চোঙায় বাঙালি বাঙালি বলে চিৎকার করতে করতেই মারা গেল।’
লেখক: ছাত্রনেতা।