বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সৈয়দ আবুল মকসুদ: একজন দায়বদ্ধ ও সাদামনের মানুষ

  •    
  • ২৩ অক্টোবর, ২০২১ ১৪:৫৮

তিনি ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সত্যাগ্রহ শুরু করেন এবং বর্জন করেন পাশ্চাত্য পোশাক ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। ‘ইরাকে হামলার প্রতিবাদে’ এই সত্যাগ্রহ যতটা ঠিক ততটাই সেটা ছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমি সংস্কৃতি, ভোগবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এই চার অপশক্তির বিরুদ্ধে। এসময় তিনি বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় প্রচারাভিযান চালান তার সত্যাগ্রহের সমর্থনে। আমৃত্যু তিনি এই পোশাক পরিধান করেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে। মা সালেহা বেগম এবং বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ (১৯০৫-১৯৮৮)। জন্মের দুই বছর পর ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর সন্তান জন্মদানের সময় জটিলতায় তার মা ইন্তেকাল করেন। তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বিমাতা বেগম রোকেয়া আখতার তাকে সন্তানস্নেহে লালনপালন করেন।

ছেলেবেলা থেকেই সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহিত্যিক আবহে বেড়ে ওঠেন। তার পিতা কাব্যচর্চা করতেন, রয়েছে তার দুটি বই- ভ্রমণকাহিনি ‘কাশ্মীর’ এবং কবিতাগ্রন্থ ‘পুষ্পমালিকা’।

সৈয়দ আবুল মকসুদের শিক্ষাজীবন শুরু নিজগৃহে তাদের গ্রামের নরসুন্দর লোকনাথ শীলের কাছে। তিনি তাকে ‘বর্ণবোধ’ ও ‘আদর্শলিপি’ পাঠ দিতেন। এরপর তিনি পড়েন তাদের ডাক্তার নিবারণচন্দ্র সাহার কাছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি একবারে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ঝিটকা আনন্দমোহন উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং সাংবাদিকতায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন জার্মানির বার্লিনস্থ ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনসটিটিউট ফর জার্নালিজম’ থেকে।

ছাত্রজীবনে আবুল মকসুদ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ও বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একাত্তরের ২৫ মার্চের পরে মস্কোপন্থি ন্যাপের নেতা ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরীর গঠিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত আবদুল মান্নান সম্পাদিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠাতেন।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ সরকারের ইনফরমেশন সেল-এ যোগদান করেন। বাহাত্তরের জানুয়ারি থেকে বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনালে (সাবেক পিপিআই) যোগ দেন, যা পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সঙ্গে অঙ্গীভূত করা হয়। বাসস-এ ছিলেন বার্তা সম্পাদক ও উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে।

সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনে তিনি ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইরান, চিন, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, আমেরিকা, তুরস্ক, মালায়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। তার বন্ধু হুমায়ুন আজাদকে আহত করা নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখার জন্য বিএনপি-জামায়াত সরকার থেকে লেখা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ায় প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ৯ মার্চ তিনি বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

সৈয়দ আবুল মকসুদের সাহিত্যচর্চা শুরু স্কুলজীবন থেকে কবিতা লেখার মাধ্যমে। বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে তার আবির্ভাব ষাটের দশকে। কবি আহমদ রফিক সম্পাদিত নাগরিক সাহিত্যপত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে নিজেই প্রকাশ করেন সময় এবং আরও পরে সত্তরের দশকের শেষে অস্তিত্ব। প্রথম থেকেই তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখেন। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ভ্রমণকাহিনি জার্মানীর জার্নাল (১৯৭৯) যা প্রকাশের পর পরই পাঠকপ্রিয়তা পায়। তার প্রথম প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থ গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি (১৯৮১) এবং প্রথম কবিতার বই বিকেলবেলা (১৯৮১)।

একজন গবেষক হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ বহু মৌলিক আকরগ্রন্থের প্রণেতা- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (১ম খণ্ড ১৯৮১ এবং ২য় খণ্ড ১৯৮৩), মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৯৯৪), পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রন্নেসা খাতুন (১৯৯২), হরিশচন্দ্র মিত্র: ঢাকার সাহিত্য ও সাময়িকপত্রের পথিকৃৎ (১৯৯০) প্রভৃতি। তিনি শুধু মওলানা ভাসানীর পূর্ণাঙ্গ জীবনীই রচনা করেননি, মওলানার ওপর লিখেছেন পাঁচটি বই।

বাংলাদেশে মহাত্মা গান্ধী বিষয়ে গবেষণার পথিকৃৎ সৈয়দ আবুল মকসুদ। Gandhi, Nehru and Noakhali (২০০৪) এবং Gandhi Camp: A Chrinology of Noakhali Events 1947-49 (২০১৪) নোয়াখালীতে গান্ধীর কার্যক্রম সম্পর্কে নতুন দিক উন্মোচন করেছে। গান্ধী বিষয়ে তিনি আরও সম্পাদনা করেছেন Pyarelal's Unpublished Correspondence: The Noakhali Peace Mission of Mahatma Gandhi (২০০৬) এবং নোয়াখালী গান্ধী মিশন ডায়েরী (২০১১)। গান্ধী প্রচারিত চিন্তাচর্চা ও গবেষণার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন মহাত্মা গান্ধী স্মারক সদন।

গবেষণায় আবুল মকসুদের আরেকটি অনন্য অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা (২০১৬), স্যার ফিলিপ হার্টগ (২০১৬), সলিমুল্লাহ মুসলিম হল (২০১৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয়ে চর্চায় অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠেছে।

২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের প্রতিবাদে তিনি ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সত্যাগ্রহ শুরু করেন এবং বর্জন করেন পাশ্চাত্য পোশাক ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। ‘ইরাকে হামলার প্রতিবাদে’ এই সত্যাগ্রহ যতটা ঠিক ততটাই সেটা ছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমি সংস্কৃতি, ভোগবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এই চার অপশক্তির বিরুদ্ধে। এসময় তিনি বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় প্রচারাভিযান চালান তার সত্যাগ্রহের সমর্থনে। আমৃত্যু তিনি এই পোশাক পরিধান করেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন বাংলাদেশে পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও মানবাধিকার কর্মী। বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সমাজে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী- নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী- যেখানেই আক্রান্ত হয়েছে তিনি শুধু বলিষ্ঠ কণ্ঠে তার প্রতিবাদই করেননি, নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। একজন সক্রিয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সমাজের সর্বস্তরে গৃহীত হন।

সাহিত্যচর্চা ছাড়াও সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন একজন জনপ্রিয় কলাম লেখক। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন। প্রথম আলো পত্রিকায় তার সহজিয়া কড়চা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে জনপ্রিয় কলামগুলোর অন্যতম।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বিভিন্ন পদক ও সন্মানে ভূষিত হয়েছেন- সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৫), মহাত্মা গান্ধী স্মারক পুরস্কার (ভারত) (২০১৭), মওলানা ভাসানী জাতীয় পুরস্কার, ঋষিজ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক।

২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিজবাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর