বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অজয় রায়: সাম্য ও সম্প্রীতির সাধক

  •    
  • ১৭ অক্টোবর, ২০২১ ১৫:১২

অজয় দাকে অনেক ব্যাপারেই আমার মনে পড়বে। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নিপীড়নের ঘটনা দেশে ঘটতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রতিবাদী সোচ্চার কন্ঠ ছিলেন।

এবার বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে পারেনি। কুমিল্লা শহরের একটি পূজামণ্ডবে হনুমানের কোলে কে বা কারা একটি কোরআন রেখে যায়। কোনো হিন্দু এটা করতে পারে না। কারণ পূজা অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের গ্রন্থ রাখা পূজার পবিত্রতার সঙ্গেই যায় না। আবার কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানও তার পবিত্র গ্রন্থ পূজামণ্ডবে রাখতে পারেন না। এাটও তার বিশ্বাসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। তাহলে কে রাখল পূজামণ্ডপে কোরআন?

মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে যারা দেশে দাঙ্গাফ্যাশাদ বাধিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায় তাদের মাথা থেকেই এই নষ্ট ও দুষ্ট বুদ্ধি বের হয়েছে। কোরআনের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করার গুজব ছড়িয়ে দেশের কয়েকটি স্থানে পূজাস্থলে আক্রমণ হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে এবং হিন্দুদের কিছু বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা, ভাঙচুর হয়েছে। দুএক জায়গায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার খবর শুনে আমার একজন মানুষের কথা খুব মনে হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই ফোন করতেন এবং কিছু একটা করার জন্য ছটফট করতেন। তিনি অজয় রায়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন অগ্রণী যোদ্ধা। মানুষে মানুষে সাম্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তার জীবন নিবেদিত ছিল। আজ ১৭ অক্টোবর অজয় রায়ের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালে তার প্রয়াণ হয়।

অজয় রায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৩ সালের দিকে। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়ে তার নিজের জেলা ময়মনসিংহ থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢাকা আসার পর। তবে তার সম্পর্কে জানি আরও আগে থেকে।

আমি যেহেতু স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম এবং রাজনৈতিক বইপুস্তিকা পড়ার অভ্যাস ছিল, সেহেতু অজয় বায়ের ‘বাংলা ও বাঙালী’ পড়া হয়েছিল। তাছাড়া কারাগারে ও আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকেও আমি অজয় রায় সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ছিলাম তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের আগেই।

তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন, জেলে বসে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেছেন, তার বাবাও ছিলেন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চার ভাষায় পণ্ডিত– এসব তথ্য জেনে একদিকে যেমন তাকে নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে, অপরদিকে তেমনি কমিউনিস্ট হওয়ার ঝোঁকও প্রবল হয়েছে। কমিউনিস্টরা সব অসাধারণ মানুষ, তারা একদিকে ধীমান, অপরদিকে আত্মত্যাগী– এগুলোই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তত্ত্বকথা তার পরের বিষয়। রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি সব বিষয়ে অজয় রায়ের জ্ঞানের কথাও তার সঙ্গে পরিচয়ের আগেই জানা।

অজয় দাকে বাইরে থেকে দেখে একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হলেও বাস্তবে তিনি তা ছিলেন না। তার মতো অমায়িক মানুষ খুব বেশি দেখিনি। তার সঙ্গে সহজেই মেশা যেত, কথা বলা যেত, তর্কাতর্কিও করা যেত। তার সঙ্গে আমার বয়সের অনেক ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণই করতেন। আমার ধারণা অন্যদের সঙ্গেও তাই। কারণ এটাই ছিল অজয় দার বৈশিষ্ট্য।

অজয় দার মধ্যে পাণ্ডিত্য জাহিরের কোনো ভাব ছিল না। অন্যের মত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না। পার্টির কোনো সিদ্ধান্ত আমার মনঃপূত না হলে অজয় দার কাছে গিয়ে তর্ক জুড়ে দিতাম। তার সঙ্গে অনায়াসে তর্ক করা যেত। যুক্তি পাল্টাযুক্তির লড়াই শেষ করতেন অজয় দা এভাবে : কমরেড, আপনার কথায়ও যুক্তি আছে। কিন্তু এখন পার্টির সিদ্ধান্ত তো মানতেই হইবো। আমাকেও রণে ভঙ্গ দিতে হতো। পার্টির সিদ্ধান্ত বলে কথা! তার কোনো নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই।

অজয় দা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। অর্থনীতি ও শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কমিউনিস্ট কিংবা কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন নন এমন কারো কারো সঙ্গেও অজয় দার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

তার সরলতা, জ্ঞান-বুদ্ধি অন্যদের সহজেই আকর্ষণ করত। কমিউনিস্ট পার্টি যে একটি বিশেষ কালপর্বে দেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাববলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল তার পেছনে অজয় দা’র মতো মানুষদের ব্যক্তিগত ভূমিকা একেবারে গৌণ নয় বলেই আমি মনে করি।

অজয় দা পার্টির সাপ্তাহিক মুখপাত্র ‘একতা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আমি একতায় কাজ করতাম। সেই সুবাদেও তার সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক ছিল। তিনি একতায় লিখতেন। তার লেখা সংগ্রহের জন্য ওয়ারীর বাসায় যেতে হতো। কখনও কখনও আমাকে বসিয়ে রেখেই লেখা শেষ করতেন। তাতে আমি একটুও বিরক্ত হতাম না। বরং দেরি হোক মনে মনে সেটাই চাইতাম, জয়ন্তী বৌদির সুস্বাদু চা-নাশতা পাওয়ার লোভে।

একতা সম্পাদক মতিউর রহমানের বাসাও ছিল ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে। মতি ভাইয়ের বাসায় প্রায় প্রতি সকালেই যেতে হতো। সুযোগ পেলে কখনও কখনও অজয় দা’র বাসায় ঢুঁ মেরে আসতাম। অজয় দার সঙ্গে কতদিন কত বিষয়ে কত কথা হয়েছে তার সব কিছু এখন মনেও নেই। যদি দিনপঞ্জি লেখার অভ্যাস থাকত তাহলে অজয় দাকে নিয়ে আমার লেখা আরও তথ্যপূর্ণ হতো।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর সিপিবির মধ্যেও আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অজয় দাকে যেহেতু পার্টির তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে দেখা হতো, সেহেতু আদর্শিক দ্বন্দ্বে তার অবস্থান কোনদিকে সেটা জানার আগ্রহ নিয়ে অজয় দার সঙ্গে আলোচনায় বসে বিস্মিত হলাম সংস্কারের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান দেখে! আমার ধারণা ছিল তার মতো একজন পুরোনো কমিউনিস্ট তার এতদিনের লালিত বিশ্বাস থেকে নড়বেন না। কারো কারো কাছে মার্কসবাদ যতটা না দর্শন, তারচেয়ে বেশি বিশ্বাস। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অন্ধ বিশ্বাস! আমার মনে হয়েছিল, অজয় দা তার এতদিনের বিশ্বাস আঁকড়ে থাকবেন।

মার্কসবাদী দর্শনকে অভ্রান্ত মনে করে কমিউনিস্ট পার্টি রক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে নামবেন। বাস্তবে তিনি বিপরীতটাই করলেন। আমাকে বললেন, শুধু তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে আর বাম আন্দোলন এগিয়ে নেয়া যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত দিয়ে, অসংখ্য কমিউনিস্টের আত্মত্যাগ, সংগ্রামের উদাহরণ দিয়েও যেখানে আমরা মানুষের ব্যাপক সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছি, সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর মার্কসবাদী তত্ত্বের সঠিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এখন নতুন ভাবনার বিকল্প নেই।

এই নতুন ভাবনার অংশ হিসেবেই দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেল। এই ভাঙনে অজয় দা পক্ষ নিলেন সংস্কারবাদীদের। তিনি ছিলেন নেতা, কাজেই বলা যায় তিনি পার্টি ভাঙনে আরও অনেককে নিয়ে নেতৃত্ব দিলেন। এরপর আমৃত্যু অজয় রায়ের কেটেছে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। কাজের ক্ষেত্র খুঁজেছেন, সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কতটুকু সফল হয়েছেন সে বিচার এখনই নয়।

তিনি ছিলেন চিন্তাশীল প্রগতিকামী সদাসক্রিয় মানুষ। মানবকল্যাণ, মানবমুক্তির যে স্বপ্ন নিয়ে কৈশোরকালেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন রাজনীতিতে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা থেকে কখনই বিরত থাকেননি। নানা ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন অজয় দা। শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন সামাজিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠনে। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী একটি জাতীয় মঞ্চ গড়ে তুলতেও তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন।

অজয় দা যে উদ্যোগই নিয়েছেন তাতে শামিল হওয়ার জন্য আমাকে ডাকতেন। তার ডাকে সাড়া না দিতে পেরে খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমার মনে হতো, এভাবে হবে না। আবার কীভাবে হবে সে সম্পর্কে আমার নিজের কোনো স্পষ্ট ধারণাও নেই। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে জড়িত না হওয়ার ব্যাপারে আমি দৃঢ়মত। অজয় দার বয়স হয়েছিল।

যখন তার অবসর কাটানোর কথা তখন তিনি নানা ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সভা ডাকছেন, মানববন্ধন করছেন। রক্তে তার মিশেছিল অন্যায় অনাচার অসাম্যের বিরোধিতা করা। চোখের সামনে এসব ঘটতে দেখলে তিনি কি নিশ্চুপ থাকতে পারেন? পুরোনো বন্ধুদের তিনি পাশে চাইতেন। খুব সাড়া পেতেন না। কিন্তু তিনি হতোদ্যম হতেন না। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’… অজয় দা যেন শেষ জীবনে এই নীতি নিয়েই অগ্রসর হয়েছেন।

অজয় দা পার্টি ত্যাগের পর যদি আর কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে না জড়িয়ে লেখালেখিতে অধিক মনোযোগী হতেন, তাহলে সেটাই বেশি ভালো হতো বলে আমি অন্তত মনে করি। অজয় দা বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বই অনেকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। সময় দিয়ে তিনি যদি লেখালেখি চালিয়ে যেতেন তাহলে আমরা আরও কিছু মননশীল বই পেতে পারতাম। শেষদিকে রোগশয্যায় শুয়েও তিনি একটি বই লিখে গেছেন। রাজনীতি নয়– বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চাই ছিল অজয় রায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র।

অজয় রায়– ‘কমরেড’ তকমা নাম থেকে মুছতে পারেননি। আবার অন্য পরিচয়ও তার ওপর বেশি আলো ফেলতে পারেনি। তবে এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্যই ছিল তার জীবন উৎসর্গীকৃত। অসাম্প্রদায়িক-বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি বিরামহীন শ্রম দিয়েছেন। কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা নয়- নিজে দেশ ও সমাজকে কী দিতে পারছেন সেটাই ছিল তার জীবনসাধনা।

অজয় রায় আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। রেখে গেছেন কর্মনিষ্ঠার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যারা সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাস করেন, যারা অসাম্প্রদায়িক দেশের জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের কাছে যদি অজয় রায় প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হন তাহলে তার জীবনসাধনা বিফল বলে মনে হবে না। অজয় দাকে অনেক ব্যাপারেই আমার মনে পড়বে। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নিপীড়নের ঘটনা দেশে ঘটতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রতিবাদী সোচ্চার কন্ঠ ছিলেন।

পরিণত বয়সেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর– এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অজয় রায় এ দেশের রাজনীতি-সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানবকল্যাণে বড় অবদান রেখেছেন। প্রগতির পথ রচনায় তার অবদানের কথা আমাদের মনে করতেই হবে।

অজয় দার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর