বিশ্বের প্রতি আটজনে একজনের স্তন ক্যানসার! আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার- আইএআরসি’র হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৩ হাজারেরও বেশি নারী নতুন করে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যান ৬৭৮৩ জন। নারী ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ১৯% ভোগেন স্তন ক্যানসারে! তথ্যগুলো মোটেও সুখকর নয়।
এর ওপর আছে ক্যানসার চিকিৎসার নানা বিড়ম্বনা। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সঙ্গে সঙ্গে দেশে ক্যানসারের সব ধরনের চিকিৎসা বিদ্যমান থাকলেও তার সুব্যবস্থাপনা নিয়ে আছে বিস্তর প্রশ্ন। এছাড়াও ব্যয়বহুল এসব চিকিৎসায় হিমশিম খেতে হয় মধ্যবিত্ত থেকে নিন্মবিত্ত মানুষের। তার উপর সত্যিকার অর্থেই কোথায় ভালো একটু চিকিৎসা পাবেন সেই তথ্য নিয়েও আছে হাজারও বিভ্রান্তি। আর এসব বিবেচনায় ক্যানসার মানেই ভোগান্তির এক দীর্ঘ অধ্যায়।
আর সে কারণেই একটু নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশে ক্যানসার প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনো সুখকর উপায় নেই। শরীরের ভেতরের ক্যানসারগুলো তো বুঝতে সমস্যা হয় কিন্তু স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলো উঁকি দেয় শরীরের বাইরেই। শুধু চাই একটু সচেতনতা, আর একটু সতর্কতা।
আর এই সতর্কতা চাই নারী পুরুষ সবারই! অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ, পুরুষরাও এখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। নারী-পুরুষ মিলে তা ৮.৩%। স্তন ক্যানসার সচেতনতা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর উদ্যোগে ২০১৩ সালে সচেতনতার কাজ শুরু হয়। বেসরকারিভাবে ১০ অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস পালন শুরু করে।
চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে, যেকোনো নারীই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। নারীদের মাঝে এই রোগটিকে এড়িয়ে যাওয়ায় লজ্জা প্রাধান্য পেলেও পুরুষদের অনেকেই নিজেদের স্তন ক্যানসার হয়েছে সেটা বিশ্বাসই করতে নারাজ। এমন অভিজ্ঞতার কথা অহরহই শোনা যায় ক্যানসার চিকিৎসকদের কাছে।
আপনি কি জানেন স্তন ক্যানসার যদি প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে পুরোপুরি এর নিরাময় সম্ভব? আর সেজন্য বাড়িতে বসে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করতে পারবেন। আর ২০ বছর বয়স থেকেই নিজে স্তন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। আজকাল ইউটিউবে কীভাবে সেটি করবেন তার দেশ-বিদেশের নানান ভিডিও আছে বিস্তর। নিজের মুঠোফোন দেখেই সেটি সম্ভব। কিন্তু তারপরও নিস্তার কই! আমাদের তো অনেক লজ্জা! কখনও নিজের কাছে লজ্জা, কখনেও পরিবার-পরিজন, কখনও সমাজ কতজনের জন্য যে আমাদের লজ্জা বরাদ্দ তার ইয়ত্তা নেই।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই যদি বলি, আমার মা মারা গেছেন ওভারিয়ান ক্যানসারে। ওভারিতে ছোট্ট একটা সিস্ট ছিল আর সেটিই একসময় পরিণত হয়েছে ক্যানসার টিউমারে। প্রথম কয়েকমাস তো লজ্জাতেই বলেননি কাউকে। তারপর সেটি চিকিৎসকের কাছে ধরা পড়লে চলে আরও দুই মাস মেডিসিনে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তাই হয়েছে, টিউমার পরিণত হয়েছে ক্যানসারে। সেটি ফেলেও রক্ষা হয়নি। সাড়ে তিন বছরের অবর্ণনীয় লড়াই শেষে অকালেই তিনটি সন্তানকে এতিম করে চলে যেতে হয়েছে চিরতরে।
জীবন থেমে থাকেনি। আমরা ঠিকই পথ চলছি। কিন্তু মাথার উপর থেকে ছায়াটাই শুধু হারিয়ে গেছে। শতপ্রাপ্তির মাঝেও আমাদের কোথায় যেন একটা শূন্যতা সবকিছু গ্রাস করে ফেলে। আর তাই সবার কাছে করজোরে মিনতি করি- কিছু বিষয়ে লজ্জা করতে নেই। নিজে স্তন পরীক্ষা করুন। স্তন ক্যানসার থেকে দূরে থাকুন। পরিবার পরিজন নিয়ে একটি নির্মল সুন্দর জীবন কাটান।
লেখক: ক্যনসার সচেতনতা-বিষয়ক সংগঠক, গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।