বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ এখানে পড়তে আসেননি!

  •    
  • ৫ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:২৯

এমনিতেই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং দেখলে লজ্জায় আমরা মুখ লুকানোর জায়গা পাই না। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেয়ার এই ঘটনা আমাদের লজ্জাকে আরও বাড়াবে শুধু। ছেলেদের চুল ছোট থাকবে, মেয়েদের চুল বড়; এই নিয়ম কে করেছে জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের সাসাজিক বাস্তবতায় ছেলেরা চুল বড় রাখলে তার দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকায়। আবার মেয়েরা চুল ছোট রাখলেও তাকে নানা কথা শুনতে হয়। কিন্তু চুল বড় রাখবে না ছোট, ছেলে হোক বা মেয়ে; এটা একজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার।

খবরটি দেখে আমার প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছি ফেসবুকে নানারকম ট্রল হয়, মজা হয়; এটা বুঝি তেমন কিছু। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দিয়েছেন, এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য! কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে খবরটি যখন জায়গা করে নিল মূলধারার গণমাধ্যমে, তখন আর অবিশ্বাস করার উপায় রইল না। অভিযুক্ত শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন যতই অস্বীকার করুন, ঘটনাটি তার স্বীকার-অস্বীকারের জায়গায় নেই আর। ঘটনার পেছনের ঘটনা যা-ই হোক, গত ২৬ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় একে একে ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার চুলের সামনের অংশ কেটে দিয়েছেন তিনি, এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কারণ পরীক্ষার হলে আরও শিক্ষার্থী ছিলেন, ছিলেন অন্য শিক্ষকরাও। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। সত্যাসত্য তারা বের করবেন। তবে যেটুকু জানা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের অনেকের পরীক্ষার রুটিন নিয়ে আপত্তি ছিল। তারা রুটিন বদলানোর দাবিতে স্মারকলিপি তৈরি করছিল। এই খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে থাকবেন ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন। তাতে তার রাগ পড়ে শিক্ষার্থীদের চুলের ওপর।

এমনিতেই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং দেখলে লজ্জায় আমরা মুখ লুকানোর জায়গা পাই না। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেয়ার এই ঘটনা আমাদের লজ্জাকে আরও বাড়াবে শুধু। ছেলেদের চুল ছোট থাকবে, মেয়েদের চুল বড়; এই নিয়ম কে করেছে জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের সাসাজিক বাস্তবতায় ছেলেরা চুল বড় রাখলে তার দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকায়।

আবার মেয়েরা চুল ছোট রাখলেও তাকে নানা কথা শুনতে হয়। কিন্তু চুল বড় রাখবে না ছোট, ছেলে হোক বা মেয়ে; এটা একজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার। অভিযুক্ত ফারহানা ইয়াসমিন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক। তদন্ত কমিটি কী খুঁজে বের করবে জানি না। কিন্তু তিনি যদি সত্যি শিক্ষার্থীদের চুল কেটে থাকেন, তাহলে মানতেই হবে, আর যা-ই হোক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ বিভাগের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।

বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা যা-ই হোক, পুরুষের বড় চুল রাখা এ অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্যের অংশ। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের অনেকের চুলই লম্বা। লালনের লম্বা চুল ছিল। শামসুর রাহমান তার বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’তে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে চিত্রিত করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা।’

সবচেয়ে বড় কথা হলো, আলোচিত বিশ্ববিদ্যালয়টি যার নামে, সেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চুলও লম্বা ছিল। যতই লম্বা চুলের ঐতিহ্য থাকুক, এখনও এ অঞ্চলে ছেলেদের লম্বা চুল সমাদৃত নয়। ক্যাডেট কলেজে লম্বা চুল রাখা বারণ। অন্য অনেক স্কুলেও লম্বা চুলের জন্য ছেলেদের নানা কথা শুনতে হয়। কিন্তু তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে! আসলে আমার ধারণা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেই কোনো ধারণা নেই। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গীতি আরা নাসরিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যতই অবাক হই না কেন, নবীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের কেশকর্তন কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কথা বলার জন্য খনার জিভ কেটে দেওয়ার মতো, ভিন্ন চিন্তা করলে নম্বর কেটে দিয়ে, গেস্টরুমে “সহবত” শিক্ষা দিয়ে, প্রশ্ন না করে মান্য করার পরিবেশ তো দিনের পর দিন তৈরি হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত যেভাবে নাজেহাল হন, তা নিয়ে হাতেগোনা দু-একজন শিক্ষক কথা বললে রোষ তাদের ওপরও এসে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার বিকাশক্ষেত্র হওয়ার কথা ছিল, তার বদলে কীভাবে চিন্তার বিনাশক্ষেত্র হবে- তার আয়োজনই তো সর্বত্র।’ এটাই মূল কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, চিন্তার বিনাশের সকল আয়োজন সম্পন্ন করে আমরা বসে আছি সর্বনাশের আশায়। শাহজাদপুর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলেঙ্কারি ঝড় এখনও থামেনি, এরই মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম দিনাজুপরের হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে লুঙ্গি পরে অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অপরাধে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনলাইন পরীক্ষা কেন, লুঙ্গি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেও কোনো বাধা নেই। অন্তত বাধা থাকার কথা নয়। বাস্তবতা হলো, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ডে কিছু টোল বানিয়ে রেখেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন করা অপরাধ, প্রতিবাদ করা অন্যায়। এভাবে চলতে থাকলে, আসলে চলছেই তো, আমরা একটি নতজানু, চিন্তাহীন শৃঙ্খলিত প্রজন্ম পাব।

শুরুতে যেমন বলেছি, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দিয়েছেন, এটা আমার বিশ্বাস হয়নি। অভিযুক্ত শিক্ষক বার বার বলছেন, তিনি এটা করেননি, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তবে তদন্ত হওয়ার আগেই তিনি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ, সহকারী প্রক্টর ও প্রক্টোরিয়াল বোর্ডের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পরে অবশ্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। শিক্ষার্থীরা তার স্থায়ী বরখাস্তের দাবিতে আন্দোলন করছিল।

শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে তারা আন্দোলন কিছুটা শিথিল করেছেন। তবে আমি মনে করি নিছক শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে বলেই, একজন শিক্ষককে বরখাস্ত করা ঠিক হবে। একটি সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পরই স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যদি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে স্থায়ী বরখাস্ত তো বটেই ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ১৪ শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, একজনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। তবে নির্দোষ কেউ যেন পরিস্থিতি আর মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার না হন।

এই ঘটনায় আমার সবচেয়ে লজ্জা লাগছে বিশ্ববিদ্যালয়টি শাহজাদপুরে বলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি রবীন্দ্রনাথের নামে বলে। শাহজাদপুর রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তীকালে ১৮৮৯ সালের দিকে কবি এখানে জমিদার হয়ে আসেন। ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসেই রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, বৈষ্ণব কবিতা, দুইপাখি, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, হৃদয়, যমুনা, চিত্রা, চৈতালী ইত্যাদি। গীতাঞ্জলি কাব্যের কাজও শুরু করেন এখানে বসেই।

পোস্ট মাস্টার গল্পের ‘রতন’ চরিত্রও শাহজাদপুরে বসেই সৃষ্টি। চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীতে এবং চৈত্রালীর ২৮টি কবিতা, ছিন্ন পত্রাবলীর ৩৮টি, পঞ্চভূতের অংশবিশেষ এবং বিসর্জনের নাটক তিনি শাহজাদপুরে বসেই রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত মোট ৭ বছর জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে অবস্থান করেছেন। পূণ্যভূমি শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারত এ অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞানের, মুক্তচিন্তার বিকাশের অন্যতম স্থান। হতে পারত আমাদের গৌরবের জায়গা। কিন্তু আমরাই সেই গৌরবে কালিমা লেপন করেছি। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও পড়তে আসেননি। তাহলে হয়তো তাকেও ফারহানা ইয়াসমিনের কাঁচির মুখে পড়তে হতো।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর