আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম।
একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী কেমন হন? কেমন আবার! দেশে দেশে প্রধানমন্ত্রীরা যেমন হন, তেমনই। প্রধানমন্ত্রীশাসিত দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তো প্রধানমন্ত্রী। তিনি হবেন গুরুগম্ভীর। রাজ্যের চিন্তার ছাপ থাকবে তার চেহারায়। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্যরকম। অন্য আট-দশজন প্রধানমন্ত্রীর মতো নন।
তার পোশাক-আশাক, চলাফেরায় চিরাচরিত গাম্ভীর্যতা নেই, কিন্তু প্রবল ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি পোশাক আর গাম্ভীর্যতা দিয়ে নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে কখনও আড়াল করেননি। কেনইবা করবেন? তিনি যে বিশাল ব্যক্তিত্ববান জাতির পিতার কন্যা। পৈত্রিক সূত্রে পিতার বৈশিষ্ট্য তো তার চরিত্রে এমনিতেই রয়েছে। তার ওপর তিনি যদি নিজের চরিত্রের বিশালত্বকে সহজ-সরল ও স্বাভাবিক ভাবে নানাদিক থেকে মেলে ধরেন, তবে তো তিনি আট-দশজন প্রধানমন্ত্রী থেকে আলাদা হবেনই।
এই যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেন অন্যতম স্তম্ভ সাকিব আল হাসানের কথাই বলা যাক। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ স্ত্রী-কন্যাসহ সাকিব আল হাসান গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও সাকিব পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সাকিব কন্যার সঙ্গে দাদিময় আচরণ করেছেন। গান গেয়েছেন। গণভবনের লনে সময় কাটিয়েছেন। সাকিবপত্নী শিশিরের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছেন, জেনে নিয়েছেন শিশিরের প্রিয় খাবার সম্পর্কে।
ব্যস। তাতেই কিন্তু যথেষ্ট ছিল। কারণ কোনো প্রধানমন্ত্রী এতটা সময় এভাবে দেন না। কিন্তু তিনি যে শেখ হাসিনা। পরদিন তিনি সাকিবপত্নীর প্রিয় খাবারগুলো নিজেই রান্না করে পাঠিয়ে দিলেন সাকিবের বাসায়। পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান অল রাউন্ডার হয়েও সম্ভবত এতটা অবাক হননি সাকিব, যতটা অবাক হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর নিজহাতে রান্নাকরা পাঠানো খাবার দেখে। আর সেটা সাকিব আল হাসান তার ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছেন এভাবে- ‘পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌজন্যে আমি ভাষাহীন, তাঁর হাতের সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সুযোগ হলো, যা তিনি আজ সকালে নিজ হাতে রান্না করে আমার স্ত্রীর জন্য বাসায় পাঠিয়েছেন। কারণ গতকাল তাঁর বাসায় সাক্ষাৎ করতে গেলে শিশির বলেছিল এটি তার প্রিয় খাবার। ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারব না। এই স্মৃতি আমার হৃদয়ে সারা জীবন অমলিন থাকবে। আমরা সত্যিই আশীর্বাদপুষ্ট!’ (বণিকবার্তা: ২৬ জানুয়ারি, ২০২০)
রান্না করতে ভীষণ ভালোবাসেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীকালীন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে রান্না ঘরে ঢুকে রান্না করতে দেখা যায়। ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি একমাত্র ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্য নিজহাতে রান্না করেছিলেন মা শেখ হাসিনা। সে ছবি ফেসবুকে প্রকাশ হওয়ার পর ভাইরাল হতে বেশি সময় লাগেনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন এতিম শেখ হাসিনার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তারপর ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৩ সালে। প্রটোকল ভেঙে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য নিজহাতে রান্না করেছিলেন শেখ হাসিনা। রুই মাছের কালিয়া, তেল কই, চিতলের পেটি, সরষে দিয়ে ছোট মাছের ঝোল আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি। শেষ পাতের জন্য পায়েস। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের রাষ্ট্রপতির আতিথ্য গ্রহণ করে উঠেছিলেন রাইসিনা হিলে রাষ্ট্রপতি ভবনে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ত্রিশ কেজি ইলিশ মাছ। আর নিজহাতে রান্না করেছিলেন ভাপা ইলিশ।
দেশের অন্যতম বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফাকেও রান্না করে খাইয়েছেন বলে জানা যায়। একবার আহমদ ছফাকে ফোন করে দাওয়াত করেছিলেন খালেদা জিয়া। দাওয়াত পেয়ে বিনয়ে বিগলিত হননি ছফা। বরং তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন, ‘যেতে পারি এক শর্তে। আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে। শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন।’
জানা যায়, খালেদা জিয়ার রান্না করার সময়ও হয়নি, ছফাও যেতে পারেননি।
খালেদা জিয়াকেও রান্না করে খাইয়েছেন শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্ববধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তিনি বন্দি হন। দীর্ঘ ১১ মাস পর ২০০৮ সালের ১১ জুন জামিনে মুক্তি পান। সংসদ ভবনচত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে তিনি বন্দি।
বেগম খালেদা জিয়াও বন্দি। তাদের জন্য খাবার আসত জেলখানা থেকে। শেখ হাসিনা তার ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ বইয়ের নামীয় প্রবন্ধে জানিয়েছেন “...আমার খাবার আসতো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। মাঝে মাঝে খাবার আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো। আর খাবারের মেনু- যাক সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। আমাকে তো তিন বেলা খাবার দিচ্ছে কিন্তু কত মানুষ এক বেলাও খাবার পায় না।”
তখনও শেখ হাসিনা নিজে রান্না করতেন। মাঝে মাঝে নিজের রান্না করা খাবার তিনি খালেদা জিয়াকেও পাঠাতেন। কারামুক্তির পর অনেক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা নিজেই সে কথা জানিয়েছেন।
কেবল যে মানুষদেরই খাওয়াতে ভালোবাসেন তা নয়। পশু-পাখিদের খাওয়াতে ভালোবাসেন তিনি। বন্দি থাকার সময় নিয়মিত একটা বানরকেও খাওয়াতেন শেখ হাসিনা। ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’তে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘... একটা বানর ছিল হৃষ্টপুষ্ট। সে রোজ আসত আমার কাছে। কখনও সকাল দশটা এগারোটা, কখনও দুপুর আড়াইটায়। কলা ও অন্যান্য ফল খেতে দিতাম। একবার জ্বর হওয়ায় আমি খেতে দিতে পারিনি। কারারক্ষী মেয়েদের হাতে খেতে চাইল না। তখন একটা পেপে গাছে উঠে পেপে খেয়ে কারারক্ষী মেয়েদের ভেংচি কেটে চলে গেল।’
গণভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানেন, পশুপাখির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কী প্রগাঢ় ভালোবাসা। গণভবন চত্বরে যেসব ফলমূলের গাছ আছে, সেগুলোর ফল তিনি অনেক সময়ই পেড়ে আনতে দেন না। তিনি বলেন, ‘ওগুলো পেড়ে নিলে পশু-পাখিরা খাবার পাবে কোথা থেকে?’(সারাবাংলাডটনেট: ১ জানুয়ারি ২০১৮)
শুধু কি রান্না? ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর আরও দুটি ছবি অবাক করে দিয়েছিল নেটিজেনদের। গণভবনের বারান্দায় বসে চিরায়ত বাঙালি নারীর মতো কাপড় সেলাই করছেন প্রধানমন্ত্রী। যে টেবিলের ওপর তিনি সেলাই মেশিন রেখে কাপড় সেলাই করছেন, সে টেবিলটাও তার মতোই অতি সাধারণ। একই দিনে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি ছবি ভাইরাল হয়। গণভবনের পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বড়শিতে ঝুলছে বিশাল আকারের একটি তেলাপিয়া মাছ। (বাংলা টিবিউন: ২১ নভেম্বর ২০২০)
যেকোনো মানুষকে বুকে টেনে নিতে জানেন তিনি। তা সে যে ধর্মের বা যে বর্ণের মানুষই হোক না কেন। ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছেন কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ায়। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পর মঞ্চ থেকে নামার সময় প্রধানমন্ত্রী খেয়াল করলেন, এক বৃদ্ধা যেন তার কাছে আসতে চাইছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ঘেরাটোপ ভেঙে আসতে পারছিলেন না। তবে ব্যর্থ হওয়ার পরও বার বার চেষ্টা করতেই থাকলেন বৃদ্ধা। বৃদ্ধার ব্যর্থ চেষ্টা নজর কাড়ল প্রধানমন্ত্রীর। নিজেই বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গেলেন। বুকে টেনে নিলেন সে বৃদ্ধাকে। নাম তার করফুলা বেওয়া। প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে গীতও শোনালেন করফুলা বেওয়া- ‘মাগো আমার কোন দ্যাশে ছিলা? তুমি মা জননী, জগৎ তরণী। আলো পাইলাম, তোমায় পাইলাম।’ (সমকাল: ১৬ অক্টোবর ২০১৫)
২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। তৃতীয় লিঙ্গের একটি প্রতিনিধি দল জাতীয় সংসদে গিয়ে দেখা করল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। দলের নেতা আবিদা ইসলাম ময়ূরী। তৃতীয় লিঙ্গের ময়ূরী প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি আপনার সন্তানের মতো’। শেখ হাসিনাও পরম মমতায় ময়ূরীর গায়ে স্নেহের পরশ বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি আমার সন্তানের মতো।’ (ঢাকা টাইমস: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। সেসময় অনেক শিশুকেই দত্তক নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল উন্নত দেশগুলো। কিন্তু এই যুদ্ধ শিশুদের পিতৃপরিচয়? বঙ্গবন্ধুর কাছে খবরটা যেতেই তিনি বললেন, ‘বলে দাও ওদের পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আর বাড়ির ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২।’
বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি নিয়ে মাসুমা রহমান তানির পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘চল যাই’।
যেমন পিতা তেমন কন্যা। শেখ হাসিনা যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই প্রতিচ্ছবি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায়ই প্রটোকল ভাঙেন শেখ হাসিনা। সেটা দেশে বা বিদেশে যেখানেই হোক। ২০১৭ সালের মধ্যজুনে রাষ্ট্রীয় সফরে সুইডেনের স্টকহোমে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৬ জুন কর্মসূচি শেষে হোটেলে ফিরছিলেন। তাকে একনজর দেখার জন্য তখন হোটেলের উল্টোদিকের রাস্তার ওপারে বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি অপেক্ষা করছিলেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখে তার কী মনে হলো কে জানে। হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে সব প্রটোকল ভেঙে রাস্তা পেরিয়ে প্রবাসীদের কাছে দৌড়ে চলে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। অপেক্ষারত প্রত্যেক প্রবাসীর খোঁজখবর নিলেন।
প্রটোকল ভেঙে প্রবাসীদের দিকে প্রধানমন্ত্রীর ছুটে যাওয়ার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক মামুনুর রশীদ। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর এই ভিডিও লুফে নিয়েছিল নেটিজেনরা। এবং ভাইরালও হয়েছিল।
২০১৭ সালের ৭ মে। কক্সবাজার গিয়ে সব প্রটোকল ভেঙে খালি পায়ে সমুদ্রসৈকতে নেমে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। আর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া গিয়ে তো তিনি প্রটোকলের তোয়াক্কাই করেন না। এমনও হয়েছে আধা কিলোমিটার পথও তিনি হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন। কোন প্রধানমন্ত্রী এ যুগে একশ’ মিটার পথও হেঁটে পাড়ি দেন?
এই গোপালগঞ্জে গিয়ে একবার রাষ্ট্রীয় সুবিধা ছেড়ে চড়ে বসলেন ভ্যান গাড়িতে। ভ্যানে চড়ে ঘুরে বেড়ালেন নিজের গ্রাম। কোলে তার নাতি-নাতনি। ভ্যানে ঘুরে ঘুরে নাতি-নাতনিদের টুঙ্গিপাড়ার মাঠ-ঘাট দেখালেন। নিরাপত্তাকর্মীদের শত অনুরোধেও গাড়ি ব্যবহার করেননি। ঘটনাটা ২০১৭ সালের ২৭ জানুয়ারির।
প্রধানমন্ত্রী অবসর পান না। কিন্তু সেখান থেকেও কিছুটা সময় বের করে নেন। সেলাই করেন, রান্না করেন, বই পড়েন। বই তার নিত্যসঙ্গী। বই পড়ার অভ্যাস পেয়েছেন মা-বাবার কাছ থেকে। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে সেরকম কাছে পাননি। মাকে দেখেছেন। মায়ের পাঠাভ্যাস ছিল প্রবল।
১৯৯৫ সালের কথা। শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলের নেতা। মাগুরা ও মিরপুর উপ-নির্বাচনে নজীরবিহীন কারচুপির পর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। সরকারি বাসভবন ছেড়ে উঠেছেন ধানমন্ডির সুধা সদনে। একদিন তিন সাংবাদিক এলেন তার বাসায়। ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাদের একজন ছিলেন ইউএনবির সাংবাদিক শামীম আহমেদ। আগে থেকেই অ্যাপয়নমেন্ট করা ছিল। দোতলার সিঁড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের সামনে এলেন শেখ হাসিনা। হাতে মহাশ্বেতা দেবীর একটি বই। বইটা উঁচিয়ে জানতে চাইলেন, ‘শামীম এই বইটা পড়েছ?’
হতচকিত সাংবাদিক জবাব দিলেন, ‘না আপা।’
‘পূর্ব-পশ্চিম পড়েছ?’
ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে সাংবাদিক জানান দিলেন, পড়েননি।
এবার তৃতীয় বইয়ের নাম করলেন শেখ হাসিনা, ‘চাচা কাহিনী?’
এবারও না সূচক মাথা নাড়লেন সাংবাদিক। উষ্ণকণ্ঠে শেখ হাসিনা বললেন, ‘তাহলে পড়েছ কী?’ (বাংলাট্রিবিউন: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)
যেখানেই থাকেন, সেখানেই একটি লাইব্রেরি তৈরি করে ফেলেন শেখ হাসিনা। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গণভবনের প্রথম সকাল নিয়ে ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ বইয়ে লিখেছেন-
“...আগের বার যখন ছিলাম এই পূর্ব দিকের ঘরটা লাইব্রেরি করেছিলাম। এখন আর সেইসব বই নাই। সব বুকশেলফ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমার কাছে লাইব্রেরি হিসেবে এটা পরিচিত। একটা সেলফ বসানো হয়েছে। আরও একটা বসিয়ে আবার লাইব্রেরি বানানোর ইচ্ছা আছে।”
আরেকটি ঘটনা।
ঘটনাটা জানিয়েছেন একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুব স্মারক। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভা ডেকেছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদকর্মীরা আগেভাগে গিয়ে হাজির। গণভবনের নিচতলায় বিশাল ঘর। সভায় আগতরা দলের সভাপতির অপেক্ষায়। মাহবুব স্মারকের ভাষ্যে জানা যাক বাকিটা-
এসময় চোখে পড়ল একটি বিড়াল ঘুর ঘুর করছে আমাদের আশপাশে। ঝকঝকে, তকতকে পরিপাটি একটি রুমে বিড়াল! ঘুর ঘুর করার ভঙ্গিতে মনে হলো কারো চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়েছে এমনটা হবার কথা নয়। তবে, বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল, কোত্থেকে এলো এই বিড়াল?
এদিকে সে বিড়াল আবার সোফায়ও বসেছে। সোফায় বসা কোনো কোনো অতিথির কোলেও বসে পড়ছে। কেউ ওকে তাড়াচ্ছে না, বিরক্তও করছে না। ...হঠাৎ কী বুঝে ঝপ করে বিড়ালটি উঠে বসল আমার কোলে!... ঠিক তখুনি গণভবণের দোতলার আবাস থেকে নেমে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাই উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু আমি কিভাবে উঠে দাঁড়াব? আমার কোলে যে বিড়াল! এমনি সময় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি চলে এলেন আমার সামনে। আমি আধা বসে, আধা দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। বিড়াল তখনও আমার কোলে। নেমে যাবার চেষ্টা করছে না।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘খুব জ্বালাচ্ছে নাকি?’ আমি বললাম, ‘না, আপা।’
উনি বললেন, ‘না ও কোনো সমস্যা করবে না, খুব ভালো।’
এপর বিড়ালকাহিনি জানালেন প্রধানমন্ত্রী। এই বিড়ালটির মা তার সঙ্গেই ২০০৭ সালে সংসদভবনের সাবজেলে ছিল। তখন এ বিড়ালটির জন্ম হয় সেই জেলখানায়। সাবজেলের একাকী সময়টাতে বিড়ালগুলো তাকে সঙ্গ দিত। সাবজেলে জেল সুপার নিয়মিত আসতেন তার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি যখন জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন, বিড়ালগুলোও তার সঙ্গে যেত। রুমে ঢোকামাত্র জেল সুপার বা ডেপুটি জেল সুপার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন। অমনি টেবিল থেকে লাফ দিয়ে বিড়াল দুটি জেল সুপারের চেয়ারে গিয়ে বসত। শেখ হাসিনা তার নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়তেন। কিন্তু তার বিড়ালদের সরিয়ে নিজের চেয়ারে বসার সাহস ছিল না জেল সুপারের। তিনি দাঁড়িয়েই থাকতেন। শেখ হাসিনা জানিয়েছেন- “জেলে ছিলাম ১১ মাস। বিড়াল দুটির কারণে আমার সামনে কোনো দিন জেল সুপার চেয়ারে বসার সুযোগ পায় নাই। তারা দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। বিড়ালরা তাদের বসতে দেয়নি কখনো।”
বিড়ালকাহিনি জানানোর পর একটা তুড়ি বাজালেন প্রধানমন্ত্রী। আর মুখে বললেন, ‘এই চল!’
আর অমনি বিড়ালটি দিল এক লাফ। একলাফে প্রধানমন্ত্রীর পায়ের কাছে। দ্রুতপায়ে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেন প্রেসিডিয়াম মিটিঙের দিকে। বিড়ালটিও চলল তাঁর পায়ে পায়ে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শাড়ি পরেন। তবে তার শাড়ি কিন্তু দামি নয়। খুব সাধারণ সুতি শাড়ি পরেন তিনি। এবার প্রধানমন্ত্রী ও তার শাড়ি সম্পর্কে একটা মজার তথ্য দেয়া যাক। তথ্যটা প্রকাশিত হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকমে। মতামত বিভাগে লিখেছেন, আসিফ কবীর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির মিডিয়া কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এরকম দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে তার দেয়া তথ্য নিয়ে নিশ্চয়ই বিভ্রান্তি হওয়ার কথা নয়। তথ্যটা এই- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণত শাড়ির রং ম্যাচিং করেন বারের হিসেবে। অর্থাৎ তিনি সপ্তাহের একেকদিন একেক রঙের শাড়ি পরেন। শনিবারে নীল, রবিবারে সূর্যের মতো প্রভাময়, সোমবারে মেরুন, মঙ্গলবারে কমলা, বুধবারে সবুজ, বৃহস্পতিবারে হলুদাভ এবং শুক্রবারে উজ্জ্বল সোনালি বা রুপালি রং প্রধান শাড়ি পরে থাকেন।
রঙের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিত্বের একটা সম্পর্ক আছে। মনের ওপর রঙের প্রভাবও আছে। কিন্তু রঙের সঙ্গে মনের প্রভাব বুঝে দিনের হিসেব মিলিয়ে শাড়ি পরার মতো জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব কজন প্রধানমন্ত্রীর আছে?
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।