বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাংলাদেশ কি আফগানিস্তান হবে?

  •    
  • ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৮:১৮

আফগানিস্তান কি ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ও প্রযুক্তিতে উন্নত কোন দেশ? তা-ও নয়। তাহলে বাংলাদেশকে কেন আফগানিস্তান বানাতে হবে? কারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়? তারা কি ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ধারণ করে? কী মূল্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটি তারা জানে? প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ আর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিকাশের কোন পর্যায়ে আছে সেসম্পর্কে কি তারা ওয়াকিবহাল? নিশ্চয়ই বাংলাদেশ আফগানিস্তানের চেয়ে শতগুণ উন্নত ও সন্তোষজনক জায়গা।

মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর নজিরবিহীন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তালেবান বাহিনী আফগানিস্তান দখল করে নেয়ায় বিশ্ব হতবাক! এদের এত হিম্মত! ৩ থেকে ৪ লাখ আফগান সরকারি বাহিনী প্রতিরোধ করতে পারেনি ৮০ থেকে ৯০ হাজার তালেবানকে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আফগান বাহিনী তাদের প্রতিরোধের চেষ্টাও করেনি! লক্ষ্য ও গন্তব্য ঠিক না থাকলে, আদর্শিক শক্তিতে তাকত না থাকলে সংখ্যার আধিক্য, অস্ত্র-শস্ত্র ও বিদেশি সমর্থন দিয়ে যে যুদ্ধ করা যায় না, সেটি তালেবানরা প্রমাণ করে দিল। তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর সারা বিশ্বে নানা ধরনের আতংক ও উৎকন্ঠা শোনা গেছে। যা এখনও চলমান- দৃশ্যমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাষ্ট্রনেতাদের বক্তব্যে।

তালেবানদের নৃশংসতা ও সম্ভাব্য প্রতিহিংসার আতংকে হাজারো মানুষকে বিমানে করে কাবুল ত্যাগ করতে দেখা যায়। হুড়োহুড়ি করে বিমানে উঠতে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় কজন হতভাগ্য মানুষের। তালেবান সদস্যদের স্টাইলই অন্যরকম। মাথায় আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী শেরওয়ানী বা পাগড়ি, পরনে পাজামা ও পাঞ্জাবী এবং হাতে স্বংয়ক্রিয় রাইফেল, গ্রেনেড বা রকেট। বিবিসি, সিএনএন, ও আল-জাজিরার কল্যাণে একদম লাইভ মহড়া ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার দৃশ্য দেখা যায়।

ভয়ে লোকজন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। স্থল সীমান্ত দিয়ে লাখো মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে গেছে। আফগানিস্তানের সাধারণ লোকজন উৎকন্ঠার মধ্যে আছে। সবচেয়ে আতংকে নারীরা। পড়াশুনা ও চাকরি-বাকরির জন্য ঘরের বাইরে যেতে পারবে কি না, আপাদমস্তক বোরখাবন্দি হয়ে তাদের চলাফেরা করতে হবে কি না- সেটি নিয়ে শুধু আফগানিস্তানের নারীই নয়, জাতিসংঘ, বিশ্বসম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উৎকন্ঠিত। নতুন সরকার গঠন করার পর নারী মন্ত্রণালয় বন্ধ করে দিলেও, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পুনরায় গঠন করার ঘোষণা দিয়েছে তালেবান সরকার।

আফগানিস্তানের তালেবানি উত্থান সারা বিশ্বে কেন এত গুরুত্ব পাচ্ছে? গুরুত্ব পাওয়ার কারণ এর বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, ও রাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাব। কেননা, তালেবানি উত্থানে আল-কায়েদা, আল-শাবাব ও আইএস-এর মত জিহাদী সংগঠনের যোদ্ধারাই শুধু উজ্জীবিত হয়নি, নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম, পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি), ভারতের কাশ্মিরভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহম্মদ। তালেবানদের বীরত্ব অনেক মুসলিম দেশের সিভিল ও জঙ্গী সংগঠন যারা কট্টরপন্থী ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়েছে।

আফগানিস্তানের বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের জন্যও চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, কাতার, ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আছে নানা হিসাব-নিকাষ। একদিকে এ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অন্যদিকে নতুন দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করে গড়ে তোলা এবং বিশ্বব্যাপী ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নানা জঙ্গিসংগঠনের ওপর তালেবানদের প্রভাব ও যোগাযেগের ফলে সারা বিশ্ব আফগানিস্তানের ক্ষমতার পালা বদলকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। মার্কিনিদের হটিয়ে আফগানিস্তানে তালেবানদের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সেটি নিয়েও হচ্ছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ।

দশক ২ আগে আমরা শ্লোগান শুনেছি– ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন সরাসরি যোগাযোগ, বিরোধ বা মিতালির ঘটনা আমাদের জীবদ্দশায় দেখিনি, যেমনটি দেখেছি ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। দূর অতীতে আফগানিস্তানের শাসকরা বাংলা শাসন করেছিল এইটুকু শুধু ইতিহাসে পড়েছি। এর পরের কাহিনি হচ্ছে, আশির দশকে আফগানিস্তানের মুজাহিদদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে জিহাদিরা গিয়েছিল। এরপর আরও কটি দল তালেবানদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য গেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে দেখেছি।

তবে, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’- শ্লোগানটির মধ্যে ভাবনার খোরাক যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক প্রশ্ন। যেমন- বাংলা কেন আফগান হবে? আফগানিস্তান কি খুব সম্পৎশালী, গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র? যেখানে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ সাগ্রহে অপেক্ষা করবে? বাংলাদেশের মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা ইউরোপের কোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চায় ওসব দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে।

তাছাড়া আফগানিস্তান কি ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ও প্রযুক্তিতে উন্নত কোন দেশ? তা-ও নয়। তাহলে বাংলাদেশকে কেন আফগানিস্তান বানাতে হবে? কারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়? তারা কি ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ধারণ করে? কী মূল্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটি তারা জানে? প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ আর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিকাশের কোন পর্যায়ে আছে সেসম্পর্কে কি তারা ওয়াকিবহাল?

নিশ্চয়ই বাংলাদেশ আফগানিস্তানের চেয়ে শতগুণ উন্নত ও সন্তোষজনক জায়গা। তাহলে ‘বাংলাকে আফগান’ বানানোর শ্লোগানটি যেমন অর্বাচীন, ধারণাটি আরও পশ্চাদপদ।

বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তা হয়নি বরং আরও ‘বেশি বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আফগানিস্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও বাংলাদেশে রক্ষণশীল ভাবধারার গোঁড়া ধার্মিকদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প-সাহিত্য ও গণমাধ্যমগুলোতে মুক্তজ্ঞান চর্চা কমেছে। মুক্ত জ্ঞানচর্চার কথা আমি একটু জোর দিয়ে বলতে চাই কেননা এর বেশি চর্চা যেমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে দেয় আবার মুক্ত জ্ঞানচর্চা কমে গেলে একটি রাষ্ট্রের অস্থিতিশীল হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যাহোক বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা, সম্ভাবনা, ঘাটতি ও অর্জনকে বিবেচনায় রেখে বলা যায়, নানা কারণে বাংলাদেশের আফগানিস্তান হওয়ার সম্ভাবনা শুধু শূন্য নয়, জোড়া শূন্য।

প্রথমত, বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বহুত্ববাদী রাজনীতি বলা চলে। কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মধ্যপন্থী, বামপন্থী, ডানপন্থী, আলট্রা ডান, আলট্রা বাম- সবই আছে। যদিও মানুষ এ পর্যন্ত মধ্যপন্থী দলগুলোর ওপরই ভরসা রেখেছে।

বাংলাদেশের মানুষ সশস্ত্র বামপন্থাকে যেমন পছন্দ করেনি, তেমনি সশস্ত্র ডানপন্থা বা জঙ্গীবাদকেও পছন্দ করেনি। যেকোনো পরিস্থিতিতে এটিকে আমার বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির বটম লাইন, বর্ডার লাইন বা চূড়ান্ত সীমারেখা বলে মনে হয়। বাংলাদেশে যারাই রাজনীতি করুক না কেন, যারাই রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিরোধী দলে থাকুক না কেন, এই বাস্তবতা তাদের মাথায় রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও পহেলা বৈশাখখে যে বিপুল পরিমাণ মানুষের ঢল নামে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সাধারণ বাংলাদেশি বাঙালি। উত্তাল তরঙ্গের মত বহমান এই মানুষের সম্মিলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের শেকড়ের কথা, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য ও উৎসবের কথা।

এটি সত্য যে, বৃটিশ আমলে ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ পলিসির মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়কে বিভাজন করা হয়। এরপরে হিন্দু সংরক্ষণশীলদের কারণে হোক অথবা জিন্নাহর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণে অথবা উভয় কারণের সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে হোক, ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মের ভিত্তিতে দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় এবং হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় লাখো মানুষ খুন হয়।

আবার এটিও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ছিল বৃটিশ শাসকদের সঙ্গে ‘নেগোশিয়েসন’ বা দর-কষাকষির ফল কিন্তু বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ করে যে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তার চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে নারী শিক্ষা যতটা এগিয়েছে এবং নারী ক্ষমতায়ন যতটা হয়েছে, সে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা কঠিন হবে বলে মনে হয়। এ কারণে ‘নারী অধিকার’ পরিপন্থী কোন শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসাটা দুঃসাধ্য। মোদ্দা কথা হচ্ছে, এমন কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় আছে, যে বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে কোন শক্তি বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না। ক্ষমতায় আসা তো দূর কল্পনা।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর