বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভুতুড়ে গণমাধ্যম

  •    
  • ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৫:৪২

গণমাধ্যমের দ্রুত বিকাশের সঙ্গে কিছু ধান্দাবাজও তৈরি হয়েছে। কেউ গণমাধ্যমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে, কেউ ব্যবসায়িক স্বার্থে। আবার অনেকে আছে নিজেই মালিক, সম্পাদক ও রিপোর্টার।

সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে এখন কোনটা সংবাদ বা অপসংবাদ, কোনটা তথ্য বা গুজব— তা অনেক সময় ঠাওর করা যায় না। অনেক কথিত অনলাইন পোর্টাল ও আইপি টিভি সংবাদের ভাষা আর কনটেন্ট দেখে মনে হতে পারে, সাংবাদিকতা বুঝি অশিক্ষিত লোকের পেশায় পরিণত হয়েছে। অথচ হওয়ার কথা উল্টো। যে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বলে স্বীকার করা হয়, সে গণমাধ্যম কাদের হাতে চলে যাচ্ছে, কারা সাংবাদিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আসছে এবং তারা কী করছে— তা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই।

এমন বাস্তবতায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়- ১০টি দৈনিক পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে। দীর্ঘদিন প্রকাশনা বন্ধ থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এরপর ২৩ সেপ্টেম্বর তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহ্‌মুদ জানান, যেসব পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয় না, সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, ২১০টি পত্রিকা, যেগুলো সচরাচর ছাপা হয় না বা চোরাগুপ্তা ছাপে— এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আরও বলেন, “এই পত্রিকাগুলো মাঝেমধ্যে কোথা থেকে ছাপা হয় কেউ জানে না। এগুলো থাকার দরকার নেই। গণমাধ্যমের দ্রুত বিকাশের সঙ্গে কিছু ধান্দাবাজও তৈরি হয়েছে। কেউ গণমাধ্যমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে, কেউ ব্যাবসায়িক স্বার্থে। আবার অনেকে আছে নিজেই মালিক, সম্পাদক ও রিপোর্টার।”

এর কয়েক দিন আগে ১৪ সেপ্টেম্বর আরেকটি অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী জানান, দেশে প্রায় ৪০০টি পত্রিকা অনিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি এগুলোকে ‘ভূতুড়ে পত্রিকা’ বলেও মন্তব্য করেন।

তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ নেই, বরং একমত হয়ে বলা যায়, ভূতুড়ে (অনেক সময় যেগুলোকে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাও বলা হয়) পত্রিকা বন্ধের এ উদ্যোগ আরও আগেই নেয়া উচিত ছিল। গণমাধ্যমের পেশাদারি বজায় রাখার স্বার্থেই তথ্যমন্ত্রীর ভাষায় এসব ‘ধান্দাবাজের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

ইন্টারনেট তথা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির লোক আইপি টিভিতে লোাক নিয়োগের নামে যে ধরনের বাণিজ্য করছে এবং এসব টিভিতে সংবাদ প্রচারের নামে যেসব কর্মকাণ্ড করছে, তা দেশবাসীর অজানা নয়।

১৯ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি জানায়, ৫৯টি অবৈধ ও অনিবন্ধিত আইপি টিভি বন্ধ করা হয়েছে। টেলিভিশনে প্রচারিত কনটেন্ট ইন্টারনেট প্রটোকল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সম্প্রচার করার প্রক্রিয়া হলো আইপিটিভি। বিটিআরসি শুধু লাইসেন্সধারী আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইপিভিত্তিক ডাটা সার্ভিসের (স্ট্রিমিং সেবা, আইপিটিভি, ভিডিও অন ডিমান্ড) অনুমোদন দেয়।

নিয়ম অনুযায়ী বিটিআরসির কাছ থেকে আইপিটিভি সেবার অনুমোদনপ্রাপ্ত আইএসপি অপারেটররা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার শুধু তাদের গ্রাহকদেরই দেখাতে পারবে। তবে প্রতিটি চ্যানেলকে প্রোগ্রাম বা কন্টেন্ট প্রচারে প্রয়োজনীয় চুক্তি, অনুমোদন বা ছাড়পত্র প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বিটিআরসি বলছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে ডোমেইন কিনে বা ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে জনগণকে আইপি টিভি প্রদর্শন করছে, যার কোনো অনুমোদন নেই। অনুমোদন ছাড়া সম্প্রচার অনৈতিক এবং টেলিযোগাযোগ আইনের লঙ্ঘন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ যেদিন ১০টি পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের খবর আসে, সেদিনই অননুমোদিত ও অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। বিটিআরসির চেয়ারম্যান ও প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়। অননুমোদিত ও অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর কার্যক্রম বন্ধ চেয়ে করা সম্পূরক এক আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

নির্দেশনা বাস্তবায়ন বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। শুধু তা-ই নয়, সংবাদপত্র, সংবাদ এজেন্সি এবং সাংবাদিকদের জন্য নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না এবং নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়নে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। এর পরদিনই সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহ্‌মুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‌'দেশে এত বেশি অনলাইনের প্রয়োজন নেই। থাকা সমীচীনও নয়।' নিউজ পোর্টালের পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেল ও আইপি টিভিও রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার কথা জানান তিনি।

অনেকে তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলে, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ ভালো, কিন্তু নিবন্ধনের নামে যেন নিয়ন্ত্রণ করা না হয়। অনেকে মনে করে, নিবন্ধন না নিয়েও কেউ যদি ‘অনিবন্ধিত মিডিয়া’ হিসেবে থাকতে চায়, সে সুযোগ দেয়া উচিত। বিশেষ করে এসব অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল যদি সাংবাদিকতার নামে অন্যায় ও অন্যায্য কিছু না করে, তাহলে তাদের প্রকাশিত হতে দেয়া সংবাদমাধ্যম ও বাক্‌স্বাধীনতার অংশ বলেও মনে করে তারা।

যারা অনিবন্ধিত পোর্টাল বন্ধের বিপক্ষে, তাদের মত হলো- মূলধারার গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত অনেক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও টেলিভিশন সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা পরিপন্থি কাজ করে। কিন্তু এসব যুক্তিতে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল ও আইপি টিভি চলতে দেয়া যায় কি না— সেটি বিরাট তর্ক। কারণ শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত বিশ্বের সাংবাদিকতা নিয়েও সেসব দেশের জনগণের অসন্তুষ্টি আছে।

গণমাধ্যম যে কারণে গণমাধ্যম, তা অনেক সময় উপেক্ষিত হয়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও সে গণমাধ্যমকে উপেক্ষা করে। করপোরেট পুঁজির স্বার্থরক্ষা, রাজনৈতিক ভয়ভীতি এবং নানাবিধ রাষ্ট্রীয় ও সেলফ-সেন্সরশিপের কারণেও গণমাধ্যম অনেক সময় গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে কারণে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বাইরে গিয়ে যে কেউ নিজের খেয়াল-খুশি মতো একটি অনলাইন পোর্টাল খুলে বা আইপি টিভি চালু করে সেটিকে গণমাধ্যম বলে দাবি করলে সেখানে অপসাংবাদিকতাই মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে এ ক্ষেত্রে একটা ‘নিয়ন্ত্রণ’ থাকা বাঞ্ছনীয়।

অস্বীকার করার উপায় নেই, হাতে গোনা কিছু অনলাইন সংবাদ পোর্টাল বাদ দিলে বাকিদের অধিকাংশই কপি-পেস্ট করে। এদের একটি অংশ উদ্ভট সব শিরোনাম দিয়ে ভুয়া ও হাস্যকর সংবাদ প্রকাশ করে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এসব কথিত গণমাধ্যমের কারণে প্রশ্নের মুখে পড়ছে মূলধারার গণমাধ্যম।

যার সাংবাদিক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই, সেসব লোক যখন সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়, তখন প্রকৃত সাংবাদিকরা লজ্জিত হন। সাধারণ মানুষ তখন এসব ভুয়া ও ভুঁইফোঁড় সাংবাদিকের সঙ্গে প্রকৃত সাংবাদিকদের গুলিয়ে ফেলে। সম্প্রতি পুরো গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের যে অনাস্থা-অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে, তার পেছনে বড় কারণ এসব ভূতুড়ে গণমাধ্যমের দৌরাত্ম্য।

অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে, কারা সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন এবং এত মানুষ কেন সাংবাদিক হতে চান? তা ছাড়া রাজধানী থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম তো বটেই, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন, তাদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেকে এ ইস্যুতে দ্বিমতও পোষণ করেছে।

অযোগ্যরা কথিত পত্রিকা বা আইপি টিভির আইডি কার্ড সংগ্রহ করে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ঘুরে বেড়াবে তা মানা যায় না। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক থাকাকালে প্রখ্যাত সাংবাদিক শাহ আলমগীর একাধিকবার বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের যেকোনো সাংবাদিকের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হওয়া উচিত ডিগ্রি পাস। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করার ওপর তিনি জোর দেন। তার মৃত্যুর পরে এ নিয়ে আর তেমন কোনো কথাবার্তা শোনা যায় না।

২০১৫-এর ১৫ নভেম্বর সেই সময়ের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জাতীয় সংসদে বলেন, সাংবাদিকতার ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রচলিত আইন বা নীতিমালায় সাংবাদিকতার ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড নেই। তবে অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও পেশার প্রতি দায়বদ্ধ। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ সংশোধন করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি যশোরে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক পাস হওয়া উচিত। দেশের সাংবাদিকদের ডাটাবেজ তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডাটাবেজের আওতায় আনতে পারলে অপসাংবাদিকতা বন্ধ হবে।

উল্লেখ্য, অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে, সাংবাদিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় দুটি আইন হচ্ছে। এর একটি জাতীয় সম্প্রচার আইন আরেকটি গণমাধ্যমকর্মী সুরক্ষা আইন। বলা হচ্ছে, এ দুটি আইন পাস হলে হুটহাট করে কাউকে চাকরিচ্যুত করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আইন দুটি পাস হচ্ছে না।

সুতরাং অপসাংবাদিকতা বন্ধে ভূতুড়ে পত্রিকা, অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল ও আইপি টিভি বন্ধের উদ্যোগ যেমন সাধুবাদযোগ্য, তেমনি প্রকৃত সাংবাদিকের স্বার্থ সুরক্ষা এবং দেশের গণমাধ্যমে পরিপূর্ণ পেশাদারত্ব গড়ে তুলতে সম্প্রচার আইন এবং গণমাধ্যমকর্মী সুরক্ষা আইন দ্রুত পাস করার পাশাপাশি আইন দুটির খুঁটিনাটি স্পষ্টীকরণের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিধিমালা করাও জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর