বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দায়মুক্তির অধ্যাদেশ: মানবতাবিরোধী অপরাধ

  •    
  • ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:০৯

১৯৭৯ সালে সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ২৬ সেপ্টেম্বরের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ৫০ অতিরিক্ত সংযোজনী হিসেবে ৬ এপ্রিল পাস করা হয়। এদের বিচার সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। যারা ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সকল অপরাধ, অপকর্মের সুবিধাভোগী তারা তাদের স্বার্থে খন্দকার মোশতাকের অবৈধ অধ্যাদেশকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান ও চরিত্রকেই কলঙ্কিত করেছিল। এই কলঙ্ক যারা বহন ও ধারণ করেছে তারা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাতা হতে পারে না। তারা এর বিরোধী শক্তি। রাজনীতির এই পাঠ যারা বোঝেন না কিংবা গুলিয়ে ফেলেন তারাও ঘাতকদেরই অনুসারী।

১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবৈধ সরকারপ্রধান খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন নিরপরাধকে রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করেছিল তাদেরকে বিচারের আওতা থেকে মুক্ত রাখার জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে। এই অধ্যাদেশটি দুটি অংশে বিভক্ত।

দুই অংশের এই অধ্যাদেশের প্রথম অংশে লেখা হয়-

“১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।”

দ্বিতীয় অংশে বলা হয়-

“রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হল। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।”

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের এবং নিকট আত্মীয়স্বজনদের যারা হত্যা করেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাত্রা শুরু করছিল সেটিকে মৌলিক আদর্শ থেকে সম্পূর্ণরূপে উল্টোপথে পরিচালিত করা। এজন্য তারা সামরিক বাহিনীর ট্যাঙ্ক, বন্দুক, গোলাবারুদ ব্যবহার করে। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের সবাই ছিল সামরিক বাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তা এবং অধস্তন সেনাসদস্য। এদের একটি অংশ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ছিল, অন্য অংশটি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিল।

সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ বেশিরভাগ কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডের গোপন কোনো ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সামান্যতম অবহিত ছিল না। তবে ধারণা করা হচ্ছে- সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা উচ্চাভিলাষী কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা গোটা ষড়যন্ত্রের পূর্বাপর প্রস্তুতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। নতুবা ট্যাঙ্কের মতো সাঁজোয়া বাহিনী সেনানিবাসের বাইরে এভাবে আগে থেকে বের হওয়ার কোনো সামরিক বিধানমতে থাকার ন্যূনতম কারণ ছিল না। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর জুনিয়র কিছু কর্মকর্তার ইচ্ছাতেই সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে কেউ কেউ বা কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা সামরিক অস্ত্রের নির্বিচার ব্যবহার করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল তারা সবাই অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ঘাতক চরিত্রের অধিকারী ছিল।

সে কারণে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু, শেখ মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাত পরিবারের সদস্যদের অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং বাড়িতে থাকা অন্য সবাই তারা ভয়ানক আক্রোশ নিয়ে হত্যা করে। অন্য দুটি পরিবারেও আক্রোশের মাত্রা প্রায় একই রকম ছিল। দুচারজন শিশু সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার বাইরে আরও অনেকেই ছিল যারা বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের প্রহরা বসিয়েছিল। তাদের হাতেই নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দিন আহমেদ বা কর্নেল জামিল নামে পরিচিত মিলিটারি সেক্রেটারি।

এছাড়া সাভারে ১১জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকেও নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরা বেতার ভবন দখল এবং গণভবনে ১৫ তারিখ থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। কোনো ধরনের আইন, বিধিবিধান, সামরিক-বেসামরিক সৌজন্যতাবোধ তারা তাদের কর্ম ও আচরণে দেখায়নি। এমনকি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও তারা ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে দ্বিধা করেনি। তাদের আচরণে অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেও প্রাণভয়ে কেউ মাথা তুলতে পারেননি। রাষ্ট্রের কোথায় কে কী করবেন, কাকে বসানো হবে, কাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে সবকিছু তারা খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে একের পর এক বাস্তবায়ন করতে থাকে। খন্দকার মোশতাক অসংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে বসার পেছনে ছিল এসব হত্যাকারী ও ঘাতকদের পূর্বপরিকল্পনা। সংবিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব আপনাআপনি উপরাষ্ট্রপতি তথা সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি অর্পিত হওয়ার কথা। খন্দকার মোশতাক কোনো আইনেই রাষ্ট্রপতি পদে বসার কারণ ছিল না।

তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের অধীন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। সুতরাং তার রাষ্ট্রপতি পদ ছিল দখল করা, কোনোভাবেই সাংবিধানিকভাবে বৈধ পন্থায় নয়। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে থাকেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার মানেই হচ্ছে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। এটি দুর্জনের কুযুক্তি। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুহত্যার পর সরকার গঠনের কোনো সুযোগ পায়নি। খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগ করলেও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যেহেতু তার ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্তি ছিল তাই মোশতাক ছিলেন একজন ষড়যন্ত্রকারী, ঘাতক ও ক্ষমতালোভী ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধু কিংবা আওয়ামী লীগের আদর্শের ধারক ছিলেন না।

তিনি যে একজন বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী এবং ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন সেটি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন না যে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতায় বসার জন্য আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ইচ্ছার কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছিল। সেই সুযোগ তখন কারো ছিল না।

সাংবিধানিকভাবে উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বগ্রহণের পথ যারা রুদ্ধ করেছিল তারা প্রমাণ দিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ পরিচালিত হবে তাদের ইচ্ছায়, সংবিধান বা জনপ্রতিনিধিদের কোনো দায়দায়িত্ব রাখার সুযোগ দেয়া হয়নি। সুতরাং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল বঙ্গবন্ধুর বৈধ সরকারকে সম্পূর্ণরূপে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা নিজেদের ইচ্ছেমতো দখল করা। সেকারণেই ঘাতকরা ১৫ আগস্টের রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে তাদের নরঘাতকদের চরিত্র সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন করে সবাইকে হত্যা করেছিল। তারা কাউকেই জীবিত থাকতে দেয়নি- যারা রাষ্ট্র-রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন।

শুধু তাই নয়, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ গুরুত্বপূর্ণ সব নেতৃবৃন্দকে প্রথমে গৃহবন্দি করে রাখে, পরে জেলখানায় বিনা অপরাধে আটকে রাখে। তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজনের ওপর শারীরিকভাবে নির্যাতনও করা হয়। খন্দকার মোশতাককে সরকারপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার অধীনে সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। যারা তাতে সম্মতি দেননি তাদের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এখন অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বিকাল ৪টায় মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণ করেন। যারা বিষয়টিকে এত সহজভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন তারাও ১৫ আগস্টের ঘাতকদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সমর্থক, মানসিকভাবে ক্ষমতা-রোগাক্রান্ত, রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পশ্চাৎ গমনেরই অনুসারী।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল তারা রাষ্ট্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী এবং রাষ্ট্রের সকল প্রকার প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসকারীও ছিল। এদের অপকর্মের কোনো তুলনা হয় না। কোনো স্বাভাবিক সমাজে এমন অপরাধীর বসবাস হতে পারে না। রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী হচ্ছে সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীর অস্ত্র ব্যবহার করে তারা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ এত সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকেই শুধু হত্যা করেনি, রাষ্ট্রক্ষমতা শুধু দখল করেনি, সংবিধানই শুধু লঙ্ঘন করেনি, সেনাবাহিনীকেও তারা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটে নিক্ষেপ করে।

১৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে যেসব বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছিল। তার ফলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে যায়। অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আত্মাহুতি দেন, এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া ঘটে। গোটা সেনাবাহিনী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য মর্যাদায় ফিরে আসতে অনেক সময় নিয়েছিল। এর ফলে সেনাবাহিনী হারিয়ে ছিল অসংখ্য মেধাবী চৌকষ দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাকে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে উগ্র রাজনৈতিক হঠকারী মতাদর্শের বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়।

সেনাবাহিনীর জন্য এটি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন একটি পর্ব। যা পার হতে সেনাবাহিনীকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, সময়ও নিয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। রাজনৈতিক ময়দানে সুবিধাবাদী, ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতির উত্থান ঘটে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে এবং বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থায়। অথচ এমন এক কলঙ্কজনক এবং ইতিহাসের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের অপরাধকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য খন্দকার মোশতাক ২৬ সেপ্টেম্বর এই অধ্যাদেশ জারি করে যা ছিল অবৈধ, সংবিধানবিরোধী এবং মানবতাবিরোধীও।

সেকারণেই খন্দকার মোশতাক এই অপরাধীদের দ্বারা ২ নভেম্বর দিবাগত রাত তথা ৩ নভেম্বর জেলখানার অভ্যন্তরে ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করার জন্য জেলের ভেতরে বেয়নেট এবং অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। এরপরে ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড, অবৈধ ক্ষমতা দখল, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বিনষ্ট এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এতসব অপরাধ সংগঠনের অপরাধীদের বিনাবিচারে দেশ থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে করে দেয়া হয়। তাদেরকে বিমানে সপরিবারে ব্যাংককে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন এক অপরাধ সংগঠনের ঘটনা যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সেই সময়কার ক্ষমতা দখলকারী এবং পরবর্তী সময়ে যারা এই অপরাধের উত্তরাধিকারী হন তাদের জন্য। এদেরকে শুধু খন্দকার মোশতাকই নয় সামরিক শাসক জিয়া, সাত্তার, এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া এবং চারদলীয় জোট সরকার বিদেশে দূতাবাসে চাকরি প্রদান, দেশে তাদের শাসনামলে অবাধে আসা-যাওয়া করার সুযোগ দেয়া, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করারও ঘটনা ঘটেছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা এই সরকারগুলো নেয়নি। অধিকন্তু ১৯৭৯ সালে সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ২৬ সেপ্টেম্বরের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ৫০ অতিরিক্ত সংযোজনী হিসেবে ৬ এপ্রিল পাস করা হয়। এদের বিচার সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।

যারা ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সকল অপরাধ, অপকর্মের সুবিধাভোগী তারা তাদের স্বার্থে খন্দকার মোশতাকের অবৈধ অধ্যাদেশকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান ও চরিত্রকেই কলঙ্কিত করেছিল। এই কলঙ্ক যারা বহন ও ধারণ করেছে তারা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাতা হতে পারে না। তারা এর বিরোধী শক্তি। রাজনীতির এই পাঠ যারা বোঝেন না কিংবা গুলিয়ে ফেলেন তারাও ঘাতকদেরই অনুসারী।

সংবিধানে এমন মানবতাবিরোধী আইন আমাদেরকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বহন করতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের মাধ্যমে সংবিধানে থাকা মানবতাবিরোধী কালো আইনটি রহিত করার উদ্যোগ নেয়। বিএনপি জামায়াতসহ কয়েকটি দল এর বিরোধিতা করে, সংসদে অনুপস্থিত থাকে। ১২ নভেম্বর সংসদে আইন পাসের দিন তারা হরতাল ডাকে।

তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ৫ম সংশোধনীর কালো আইনটি রহিত করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশ এবং এর সংবিধান মুক্তি পায় অপরাধী ও দায়মুক্তির আইন থেকে। এরপরে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার বিচার শুরু হয়। উচ্চ আদালতের রায়ে কয়েকজনের সাজা কার্যকর করা হয়। কয়েকজন দণ্ডপ্রাপ্ত বিদেশে পালিয়ে আছে। ইতিহাসে এরা মানবতাবিরোধী অপরাধী, এদের সহযোগীরা রাজনীতিতেও ১৫ আগস্টের হত্যাকারী এবং তাদের অনুসারী হিসেবে চিরকালের জন্য চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

লেখক: অধ্যাপক-গবেষক।

এ বিভাগের আরো খবর