আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করবে পুলিশ! এজন্য গত ১ সেপ্টেম্বর news.police.gov.bd নামে একটি নিউজপোর্টাল যাত্রা শুরু করেছে। পোর্টালের উদ্বোধন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেছেন, দেশ-বিদেশে পুলিশের অর্জন ও পজিটিভ বাংলাদেশকে তুলে ধরতে কাজ করবে এই নিউজপোর্টাল। এর জন্য থাকবে আলাদা রিপোর্টিং টিম, যারা সবাই পুলিশ সদস্য।
পোর্টালে দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক নিউজ ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অর্জনগুলো দ্রুততম সময়ে তুলে ধরা হবে। আইজিপি জানান, পুলিশ নিউজে মূলত পুলিশ সদস্যরাই নিউজ করবেন। পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিউজগুলো অনুমতিসাপেক্ষে ক্রেডিট দিয়ে ছাপানো হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, জনগণের পয়সায় পরিচালিত রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাংবাদিকতা করার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? অ্যাকাডেমিক্যালি ‘সাংবাদিকতা’ বলতে যা বোঝায়, তা কি কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পক্ষে আদৌ করা সম্ভব?
https://www.police.gov.bd/ নামে পুলিশের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে; যেখানে মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশের ভূমিকার কথা জানাতে আলাদা বিভাগ রয়েছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেশ ও শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশের যেসব সদস্য নিহত হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে জানাতে ‘স্যাক্রিফাইস ইন অ্যাকশন’ নামেও একটি বিভাগ রয়েছে। এই ওয়েব সাইটেই পুলিশের বিভিন্ন সাফল্যের খবর প্রকাশের জন্য ‘সাকসেস স্টোরি’ নামে একটি বিভাগ খোলা যেত।
সুতরাং নিজেদের সাফল্যের খবর প্রকাশ করতে আলাদা একটি নিউজপোর্টালের কেন প্রয়োজন পড়ল? যে কাজ বাহিনীর নিজস্ব ওয়েব সাইটেই করা সম্ভব, সেই কাজটি করার জন্য একটা নতুন জিনিস চালু করে কেন সমালোচনার ভাগীদার হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী?
এই সমালোচনা ও বিতর্কের মূল কারণ তাদের সদ্য চালু করার সাইটে ‘নিউজ’ শব্দটি থাকার কারণে। নিউজ বা সংবাদ মানেই সেখানে কিছু নিয়ম-নীতি ও পেশাদারত্বের বিষয় থাকে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যাদের মূল কাজ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—তাদেরকে কেন সেই কাজের বাইরে এমন একটি কাজে যুক্ত করা হবে যে কাজটি তাদের নয়?
নিউজ বা সংবাদ পরিবেশন যারা করেন, তাদের পরিচয় তারা সাংবাদিক অথবা সংবাদকর্মী। রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী যদি এই কাজটি শুরু করে, তাহলে তাদের পরিচয় কী হবে? তারও চেয় বড় প্রশ্ন, দেশে আরও অনেক বাহিনী রয়েছে, তাদের কেউ নিজেদের খবর প্রকাশের জন্য নিউজপোর্টাল চালু করেনি। পুলিশের এটি কেন প্রয়োজন হলো? ভবিষ্যতে এই বাহিনীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য কোনো বাহিনীও যদি এরকম নিউজপোর্টাল চালু করে এবং দাবি করে যে, তারাও সাংবাদিকতা করবে—সেটি কি খুব অন্যায় হবে? ন্যায়-অন্যায়ের চেয়েও বড় প্রশ্ন, এটির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
প্রশ্ন হলো, ‘সাংবাদিক’ পুলিশরা কি শুধু তাদের সাফল্যের গল্পগুলোই তাদের পোর্টালে তুলে ধরবেন নাকি সোহেল রানা, আকসাদুজ্জামান, রাশেদ ও প্রদীপের মতো অফিসাররা কীভাবে ডাকাতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে গেলেন, সেই খবর ও অনুসন্ধানও প্রকাশ করবে? যদি সেটা না হয়; যদি এই নিউজপোর্টালের উদ্দেশ্য হয় শুধু পুলিশ বাহিনীর সাফল্য তথা গুণগান গাওয়া, তাহলে তাকে সাংবাদিকতা বলার সুযোগ নেই। কারণ সাংবাদিকতা মানে সেখানে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য থাকবে।
অনুসন্ধান থাকবে। সুতরাং, এই পোর্টাল যদি সত্যিই সংবাদ প্রকাশ করতে চায় বা করে তাহলে তারা নিশ্চয়ই পুলিশ বাহিনীতে এরকম সোহেল রানা ও প্রদীপের সংখ্যা কত; তারা কী করে একটি বিরাট বাহিনীর নিয়ম কানুনের ভেতরে থেকেও মনস্টারে পরিণত হলো, সেই অনুসন্ধানও করতে হবে।
পুলিশের মতো একটি বাহিনী—যার সদস্যদের প্রতিনিয়ত নাগরিকের নিরাপত্তায় কাজ করতে হয়, তাদের সাংবাদিকতা করার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি মনে করছে যে, তাদের সফলতার বিষয়গুলো গণমাধ্যমে আসছে না বা যা আসছে সেটি পর্যাপ্ত নয়?
জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী নাগরিকদের নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে—এটিই স্বাভাবিক। এর ব্যত্যয় হলে সেটি সংবাদ হবে। কারণ পুলিশ ভালো কাজ করবে এজন্যই তাদের বেতন দেয়া হয়। অতএব যখন তারা নাগরিকদের হয়রানি করবে, ঘুষ না দিলে নিরপরাধ লোককে ফাঁসাবে এবং ঘুষ নিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দুর্বল রিপোর্ট দেবে বা তাদের ধরবেই না— তখন এসব ঘটনা জানলে সাংবাদিকরা রিপোর্ট করবেন, এটিও স্বাভাবিক। পুলিশের সাংবাদিকতা সরকারি চাকরি বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
বরং এসব ঘটনা যদি গণমাধ্যম আড়াল করে সেটি সাংবাদিক হিসেবে তাদের অপরাধ। অস্বীকার করার উপায় নেই, পুলিশ অনেক ভালো কাজ করে। কিন্তু সেই ভালো কাজ জানান দেয়ার জন্য পুলিশ বাহিনীকে সাংবাদিকতা করতে হবে কেন? রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীর কাজ তো এটি নয়।
পুলিশিং ও সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়। দুটি আলাদা পেশা। আলাদা কাজ। পুলিশের কর্মকাণ্ডও সাংবাদিকরা তুলে ধরেন। ভালো- মন্দ উভয়ই। কিন্তু এখন পুলিশ যদি মনে করে যে, তাদের কাজটা তারা নিজেরাই করবে তাহলে সাংবাদিকরা তাদের অবহেলা করবেন কি না বা পুলিশের ভালো দিক বা ইতিবাচক খবরগুলো সাংবদিকরা তুলে আনবেন কি না—তা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে।
এক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে সাংবাদিকদের যে পেশাগত সম্পর্ক, সেটিও ক্ষুণ্ন হতে পারে। কারণ সাংবাদিকরা যদি পুলিশকে উপেক্ষা করা শুরু করেন এবং পুলিশ যদি নিজেদের সাংবাদিক ভাবতে থাকেন, তখন রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি পেশার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
পুলিশের এই সংবাদ পোর্টাল শেষমেষ যে তাদের নিজেদের সাফল্য প্রচারের মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহৃত হবে, সে কথা বাহিনীর তরফেই স্পষ্ট করা হয়েছে।তার মানে এটি ওই অর্থে সাংবাদিকতা নয়। আবার এও ঠিক যে, অনেক বাহিনীই তাদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য মাঝেমধ্যে নিউজলেটার প্রকাশ করে থাকে—যেগুলোকে সংবাদ বা সাংবাদিকতা বলা হয় না। সুতরাং পুলিশের এই নিউজপোর্টালটি যদি সেরকম নিউজলেটারের মতো ব্যবহৃত হয়, সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু তারা যদি বলে যে, তারাও সাংবাদিকতা করবে, তাহলে এটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে।
অস্বীকার করা যাবে না, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীরা যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন; জনগণের সঙ্গে তাদের যে দূরত্ব বেড়েছে— সেখান থেকে গণমাধ্যমকে টেনে তোলা তথা জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা খুব কঠিন। কাজটি অধিকতর কঠিন করে তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়া, একশ্রেণির অনলাইন পোর্টাল, আইপি টিভি এবং ইউটিউব চ্যানেল।
সুতরাং গণমাধ্যমের জন্য একটি বড় সংকটকালে এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না, যাতে মানুষ সাংবাদিকতা বিষয়টি নিয়ে নতুন করে হাসাহাসির সুযোগ পায়। মনে রাখা দরকার, সাংবাদিকের কাজ যেমন পুলিশিং করা নয়, তেমনি পুলিশের কাজও সাংবাদিকতা করা নয়। প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট এবং আলাদা। বরং এই দুই বাহিনী পরস্পরের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
পুলিশ তথ্য না দিলে সাংবাদিকদের পক্ষে অপরাধের তথ্য পাওয়া কঠিন। আবার সেই তথ্য সাংবাদিকরা প্রকাশ না করলে পুলিশের কাজ সম্পর্কেও মানুষ জানবে না। সুতরাং এই দুই পেশার মধ্যে যে পেশাগত ভারসাম্য রয়েছে; দুটি পেশার মানুষের মধ্যে যে হৃদ্যতা রয়েছে, সেটি যেন কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়; পুলিশ যেন মনে না করে যে তারাও সাংবাদিক; আবার সাংবাদিকরা যেন মনে না করেন যে, পুলিশ যেহেতু সাংবাদিকতা করছে অতএব তারাও পুলিশিং করবেন— এই পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সবারই সতর্ক থাকা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।