বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিশুরা কি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেল

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৭:২৫

মহামারি কাটিয়ে ওঠার পর হয়ত দেখা যাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা টিকিয়ে রাখতে পারছে আর বাকিদের জন্য পড়ে রয়েছে অন্ধকারের ভবিষ্যৎ। সচ্ছল শিশুদের জন্য এক রকম সমস্যা সমাধানের লোভ দেখাচ্ছে অনলাইন দুনিয়া। অভিভাবকেরা দৌরাত্ম্য সামাল দিতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন। মহামারিতে সেই অভ্যাস বহু গুণ বেড়েছে।

দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি হতে চলেছে। ৫৪৩ দিন বা এক বছর ৫ মাস ২৪ দিন বন্ধের পর খুলল স্কুল-কলেজ। আজ খুলল এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে শুরুতেই পুরোদমে সব খুলছে না। চলতি ও পরবর্তী বছরের এসএসসি-এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ক্লাস করবে আর বাকিরা করবে সপ্তাহে একদিন। এদিকে স্কুল খোলার জন্য এতদিন শিশুরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছে।

মহামারির বন্দিজীবনে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ছিল শিশুরা। গ্রামের শিশুদের ওপর করোনার প্রভাব কিছুটা কম হলেও শহর আর শহরতলির শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এখনও হচ্ছে প্রতিদিন। কখনও আচরণে স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, কখনও ক্ষয় চলছে নিঃশব্দে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না, মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতেও তাদের অনীহা। তিন-চার বছরের বাচ্চার অস্থিরতার শেষ নেই, ঘরবন্দি থাকতে থাকতে তাদের অসহিষ্ণুতা চরমে।

শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিশুরই স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। সম্প্রতি ব্রিটেনে ৪-১৬ বছরের প্রায় ২৬৭৩ জন শিশুকে নিয়ে একটি আচরণগত পর্যালোচনা জরিপ পরিচালিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে এই মহামারিকালে তাদের মধ্যে অতিচঞ্চলতার হার বেড়েছে ২০%, নেতিবাচক ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৩৫%। নিউইয়র্কে পরিচালিত আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই পরিস্থিতিতে প্রতি তিন কিশোরীর একজন এবং পাঁচ কিশোরের একজন দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতার শিকার। ভারতের ত্রিশটি শহরে পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রায় ৬৫% শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। তাদের মধ্যে ৫০% শিশু আধঘণ্টার বেশি ফোন ছেড়ে থাকতেই পারে না!

বাংলাদেশে এমন ধরনের কোনো গবেষণার খবর চোখে পড়েনি। তবে এখানকার শিশুদের আচরণও উল্লিখিত সমীক্ষার ফলাফলের চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কথা নয়। করোনায় বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ঘরবন্দি শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা বাইরে বের হতে পারছে না, বের হলেও নাক-মুখ ঢেকে বাইরে যেতে হচ্ছে। কারো সঙ্গে মিশতে পারছে না। বন্ধ হয়ে গেছে প্রিয় স্কুলে যাওয়া। প্রিয় বন্ধু সহপাঠীদের সঙ্গে খুনসুটি বা আনন্দ করতে পারেনি। এভাবে থাকতে থাকতে শিশুদের ভেতরে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা তারা গুছিয়ে বলতেও পারছে না। দৈনন্দিন জীবনে শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই শূন্যতা একটা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশুদের বদলে যাওয়া জীবনযাপনে নানা সমস্যা ও সংকট দেখা দিচ্ছে।

চার দেয়ালবন্দি শিশুর অপরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং ডিজিটাল ডিভাইসে মগ্ন থাকায় স্থূলতা বাড়ছে। যা অসুস্থতার পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে শিশুদের। দীর্ঘদিন স্কুলের মাঠে বা ফাঁকা জায়গায় বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে ছোটাছুটি নেই। খেলাধুলার তেমন কোনো সুযোগ নেই। টেলিভিশন, ভিডিও গেম আর মোবাইল-ল্যাপটপে সময় কাটায়। খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম আর শারীরিক পরিশ্রমের অভাব শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে স্থূলতার দিকে। বর্তমানে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই স্থূলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেক শিশু বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা আঁশযুক্ত খাবার, শাকসবজি, ফলমূল খেতে চায় না। ফাস্টফুড, চকোলেট, কোমলপানীয়, ফলের রস বেশি খায়। এতে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে।

ওরা যে ছোটাছুটির রুটিন থেকে হঠাৎই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে পড়েছিল চার দেয়ালের খোপে। প্রাকৃতিক আলোর মধ্যে প্রচুর খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ ছিল স্বাভাবিক জীবনের অঙ্গ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের (যা বিভিন্ন আচরণের হোতা) পর্যাপ্ত ক্ষরণ হয়, ছোটরা প্রাণবন্ত থাকে। গত দেড় বছর খেলাধুলার সুযোগ, নিয়মিত সূর্যের আলোটুকু গায়ে লাগানোর অভ্যাস নেই। ফলে সেরোটোনিনের ক্ষরণ কমেছে। অশান্ত, আগ্রাসী মনোভাব, ঘুম ও খিদের অভাব বেড়েছে।

আরও বিপদের কথা, স্কুলে যাওয়ার মজাটা কেড়ে নিয়ে পড়াশোনার প্রতি উৎসাহে ঘাটতি এনেছে মহামারি। স্কুলের প্রস্তুতি, বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, স্কুল ভ্যান বা স্কুলবাসে ওঠা, ক্লাস শুরুর আগে বন্ধুদের সঙ্গে হুড়োহুড়ি, পিরিয়ডের ফাঁকে গল্প, দুষ্টুমি, টিফিনে ঝটপট খেয়েই দৌড়ে খেলার মাঠে, স্কুলের ঘণ্টা বাজলে আবার হই হই আর খুনসুটি করতে করতে বাড়ি ফেরা— এই গোটা পদ্ধতির মধ্য দিয়েই চলত পড়াশোনা। একসঙ্গে বোর্ডে কাজ করা বা শ্রুতিলিখন, সবার আগে ছুটে গিয়ে শিক্ষকের কাছে খাতা জমা দেয়া, রংপেনসিল আনতে ভুলে গিয়ে বকা খাওয়া— এ সবের মধ্য দিয়েই কচি মনের বিভিন্ন স্তরের গঠন সম্পূর্ণ হতো।

কদিন আগেও ওদের অনেকে মুখ না ধুয়ে ঘুমচোখেই বিছানা বা ঘরের এককোণে বসে পড়েছে মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে। নেটসংযোগ ঠিকঠাক থাকলে ভিডিওতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখতে পাচ্ছে। না হলে, তাদের কথা শুনেই পড়াশোনা চলছে। এতে লেখাপড়া থেকে মন বিমুখ হচ্ছিল। এখন আশা করছি এসব নেতিবাচক দিকগুলো ধীরে ধীরে কেটে গেলেই সবার জন্য মঙ্গল। অবকাঠামোর অভাবে অনেকেই নতুন পদ্ধতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে দিনের একটা বড় অংশ তারা বইখাতা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। তাদের শেখার, অনুশীলনের বা বিশ্লেষণের ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত।

মহামারি কাটিয়ে ওঠার পর হয়ত দেখা যাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা টিকিয়ে রাখতে পারছে আর বাকিদের জন্য পড়ে রয়েছে অন্ধকারের ভবিষ্যৎ।

সচ্ছল শিশুদের জন্য এক রকম সমস্যা সমাধানের লোভ দেখাচ্ছে অনলাইন দুনিয়া। অভিভাবকেরা দৌরাত্ম্য সামাল দিতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন। মহামারিতে সেই অভ্যাস বহু গুণ বেড়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওরা মোবাইল স্ক্রিনে ডুবে থেকেছে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে পা দিয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং বা অনলাইন গেমের মোহে। আসক্তি বাড়লেই জীবনযাত্রা এবং ব্যবহারে স্পষ্ট ছাপ দেখা দিচ্ছে।

পড়াশোনা অবহেলিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের বিনোদন একাই উপভোগ্য। তাই অনেক সময়ই বয়সোচিত না হলেও শিশুর কাছে তা সহজলভ্য। ক্রমে বিনোদনের প্রতি ওরা তীব্র টান অনুভব করছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটারটির ক্ষরণ হচ্ছে। ফলে লেখালিখি, অঙ্ক করা বা নিবিষ্ট মনে পড়াশোনার কাজ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ মস্তিষ্ক তখন শুধুই লঘু বিনোদনমূলক বিষয়ের দিকে আগ্রহী থাকে। বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। সেটুকু শ্রমেও মস্তিষ্ক নারাজ। ক্রমে তারা ইন্টারনেটেই বেশির ভাগ সময় দিয়ে দেয় তারা। নষ্ট হতে থাকে জ্ঞান আহরণ বা সামাজিক হয়ে ওঠার গুণাবলি। এ নেতিবাচক দিকগুলো দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। এমনকি কিশোর-অপরাধের প্রবণতাও অলীক নয়।

তিলে তিলে একটা প্রজন্মকে পুরোপুরি অন্ধকার গ্রাস করছে। ওদের সম্ভাবনা ফুরিয়ে যেতে বসেছে। যত শিগগির সম্ভব স্কুলগুলোর শিক্ষাকার্যক্রম ও শ্রেণিশিক্ষণ পদ্ধতি পুরোপুরি চালু করা উচিত। টিকাকরণে গতি এনে শিশুদের শিক্ষাঙ্গনগুলো পুরোপুরি চালু করা হোক সবার আগে।

উন্নত দেশগুলো বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে বিভিন্ন উপায় ভাবছে। ব্রিটিশ প্রশাসন অভিভাবকদের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে বলেছে। খেলা ও শখের সময় আলাদা করা, সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত করা, দৈনিক একঘণ্টা শারীরিক কসরত, নিয়ম মেনে ঘুম, পুষ্টিকর খাবারের দিকে লক্ষ রাখা। অভিভাবকেরাও শিশুদের স্বার্থে নিজেদের কাজের পদ্ধতি বদলানোর চেষ্টা করছেন।

শিক্ষাঙ্গন খুললেও মহামারির প্রকোপ সহসা যাচ্ছে না। শিক্ষাঙ্গন ঝুঁকির বাইরে নয়। তাই আমাদেরও এভাবেই উদ্যোগী হতে হবে। বাড়িতে সুস্থ পরিবেশে ওদের বড় করে তুলতে উদ্যোগী হতে হবে। ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, ওদের সময় দিতে হবে, সার্বিক বিকাশে নজর দিতে হবে। আর গ্যাজেটমুক্ত পারিবারিক সময় কাটানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। জীবনযাত্রায় একটু সারল্য আর নিয়মের ভারসাম্যে শিশুদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে, হয়তো মহামারির বয়ে আনা সমস্যাগুলো থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে।

কিন্তু অশিক্ষা, অসচেনতা, দারিদ্র্যঘেরা আমাদের সমাজে শিশুদের জন্য তেমন অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করা কঠিন কাজ। আমাদের যে অধিকাংশ পরিবারে নুন আনতে পানতা ফুরায় দশা। শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের সময় কাটানো তো দূরের কথা, অভাব ঘোচাতে অনেক শিশুকে উপার্জনমূলক কাজে পাঠানো হয়। বাবা রুজির জন্য বাইরে যায়। মা-ও চেষ্টা করে কোনো কাজ করে কিছু চাল-ডালের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এদিকে ওই পরিবারের সন্তান যথাযথ পরিচর্যা ও মনোযোগের অভাবে আশপাশের ছিন্নমূল শিশুদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। অনেকে সঙ্গদোষে একটু একটু করে বখে যায়।

এমন শিশুদের যদি অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরোপুরি ব্যস্ত রাখা না যায়, তাহলে আগামী প্রজন্মের একটা বড় অংশ সত্যিকার অর্থেই গোল্লায় যেতে পারে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর