বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নাইন ইলেভেনের দুই দশকপূর্তিতে উদ্বেগ

  •    
  • ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৫:০৯

সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানগোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করার পর বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের উল্লাস নজরে পড়ার মতো। কেউ কেউ তো আফগানিস্তান থেকে ‘তালেবান যোদ্ধাদের’ এনে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোতে ছেড়ে দেয়ার দাবিও তুলেছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট- রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে তালেবানি প্রশিক্ষণ পেয়ে মিয়ানমারে ‘ইসলামি বিপ্লব’ করবে। আরেকজন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ শিক্ষক খোয়াব দেখছেন- সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন বাংলাদেশে তালেবানি শাসন কায়েম হবে এবং তারপর বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের অনুসারীরা সব পালিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের টুইন টাওয়ার নামে পরিচিত সুউচ্চ ভবনটি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় গুড়িয়ে যায়। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি বিমান আঘাত হানে দুটি টাওয়ারে। মৃত্যু হয় শত শত নারী-পুরুষ-শিশুর। এ তালিকায় বাংলাদেশেরও কজন ছিলেন।

কাছাকাছি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং আরও একটি স্থানে এ ধরনের হামলা হয়। সুপরিকল্পিতভাবে কটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে পরিচালিত এ হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আল কায়দা নামে পরিচিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতা ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করেন। সৌদি আরবের রাজপরিবারের প্রভাবশালী এ সদস্য সে সময় আফগানিস্তানে তালেবান শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে চলেছেন।

বলা হয়ে থাকে, কট্টর ধর্মান্ধ ভাবধারায় কাজ করছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বের সর্বত্র সন্ত্রাসের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় ‘ইসলামি শাসন’ কায়েম তার লক্ষ্য। ইসলাম বাদে অন্য ধর্মের প্রতি আল কায়দার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। তাদের সমূলে বিনাশ চায় তারা। কিংবা অন্তত চরমভাবে দমিয়ে রাখা চাই ‘বিধর্মীদের’।

যে তালেবানগোষ্ঠী আল কায়দাকে আফগানিস্তানে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, চার দশক আগে রাশিয়া আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করার পর তাদেরই সামরিক প্রশিক্ষণ ও সর্বাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করার দায়িত্ব পালন করে সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। তাকে সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক। নিজদেশেও তিনি কট্টর ইসলামি শাসন কায়েমে তৎপর ছিলেন। বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের খুব পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

কথায় আছে, ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। যুক্তরাষ্ট্রের মদদে শক্তিশালী হয়ে ওঠা তালেবানগোষ্ঠী ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তনের ক্ষমতা দখল করে। এরপর সেখানে ‘ইসলামি শাসন’ কয়েম হয় এবং ‘ইসলামি বিপ্লব’ রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। আল কায়দা এবং আরও পরে গড়ে ওঠা ভয়ংকর সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএস বা ইসলামি স্টেট তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তালেবান শাসকদের কাছে দাবি করেন ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে বিচারের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই এতে সাড়া মেলেনি।

বাংলাদেশে সে সময় (১ অক্টোবর, ২০০১) সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই এ সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করার দিনেই তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনি মাঠে দুর্বল করে ফেলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এ কাজে বিশেষভাবে সহায়তা মেলে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরে থাকা একাত্তরে পাকিস্তানের গণহত্যার ঘৃণ্য দোসর জমায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের তরফ থেকে। আফগানিস্তানে তালেবানি শাসকদের মতাদর্শ তাদের অনুপ্রেরণা।

ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল তালেবানের পক্ষে মিছিল করে। বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের জেএমবি এবং হরকাতুল জেহাদের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্ফালন তখন চরমে। বাংলাদেশে আফগান স্টাইলে বিপ্লব করার অপচেষ্টা তারা শুরু করে। ২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী তালেবানগোষ্ঠীকে পরাজিত করে পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু ওসামা বিন লাদেন থেকে যান নাগালের বাইরে। কোথায় তিনি? জর্জ বুশ ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট।

তার শাসনামলেই ২০১১ সালের ২ মে ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের একটি এলাকায় হত্যা করা হয়। এই ভয়ংকর সন্ত্রাসী পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে সংসার পেতেছেন, সেটা পাকিস্তানের কোনো সরকারই স্বীকার করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা অনুসন্ধান সফল হয়। কমান্ডো হামলা পরিচালনা করে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে তার লাশ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়া হয়। বারাক ওবামা পুরো অভিযানটি দেখেন বিশেষ ব্যবস্থায় স্থাপিত ডিজিটাল পর্দায়। পাকিস্তান সরকার তখন কেবল একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে এটা জানার জন্য যে, টানা ৯ বছর লুকিয়ে থাকা ব্যক্তির সন্ধান কেন তারা পায়নি। আর কেনইবা যুক্তরাষ্ট্র তাদের না জানিয়ে তাদেরই ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান পরিচালনা করল?

আফগনিস্তানে তালেবানি দুঃশাসন বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের অন্য জোট সঙ্গীদের উৎসাহিত করেছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ গোটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার অপচেষ্টা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের প্রায় ৫শ’ স্থানে একসঙ্গে বোমা হামলা, ঝালকাঠি-চট্টগ্রাম-গাজীপুর-নেত্রকোণাসহ অনেক স্থানে বোমা ও গ্রেনেড হামলা- এসব তালেবানি সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহী মহলের কাজ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনেও এ অপশক্তি।

পরবর্তী সময়ে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামীর ভাবাদর্শও তালেবান-আলকায়দা-ইসলামি স্টেট। এরা কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের নামে। কাজের ধারাতেও কিছু পার্থক্য আছে। কিন্তু মূল লক্ষ্য এক- ধর্মান্ধ রাষ্ট্র কায়েম, যেখানে নারীর অধিকার থাকবে না। অন্য ধর্মের অনুসারীদের দমিয়ে রাখা কিংবা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। বাংলাদেশের ভেতরে কেবল নয়, অন্য দেশেও সন্ত্রাসে উৎসাহ দেয়া হবে। এটাও লক্ষণীয় যে, এসব প্রতিটি গোষ্ঠীই বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী-হেফাজতে ইসলামীর খুব পছন্দের- একেবারে ঘরের লোক, কাছের মানুষ।

সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানগোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করার পর বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের উল্লাস নজরে পড়ার মতো। কেউ কেউ তো আফগানিস্তান থেকে ‘তালেবান যোদ্ধাদের’ এনে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোতে ছেড়ে দেয়ার দাবিও তুলেছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট- রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে তালেবানি প্রশিক্ষণ পেয়ে মিয়ানমারে ‘ইসলামি বিপ্লব’ করবে। আরেকজন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ শিক্ষক খোয়াব দেখছেন- সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন বাংলাদেশে তালেবানি শাসন কায়েম হবে এবং তারপর বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের অনুসারীরা সব পালিয়ে যাবে।

তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, তার লক্ষণ ইতোমধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভয় নারীদের, মুক্তবুদ্ধির মানুষদের, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্তদের। বাংলাদেশে এদের সমর্থক আছে। এরা চিহ্নিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের সহযোগী ছিল, তাদের অনুসারী-উত্তসূরিরাই বাংলাদেশে তালেবানি ধাঁচের সরকার চায়। দেখা যাক, বাংলাদেশের জনগণ তাদের খোয়াব পূর্ণ করে কিনা! নাইন ইলেভেনের দুই দশক বাংলাদেশের জন্যই উদ্বেগের বৈকি।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর