মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত চেতনাকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়েই যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠতে হয়। মানুষ হওয়া সহজ নয়। মানুষের পরিচয়ে জন্ম হলেও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। এই প্রক্রিয়ার যাত্রাপথের শুরুতেই আছে প্রকৃত শিক্ষা। সেই শিক্ষাই মানুষকে তাড়িত করে অনেকগুলো মৌলিক উপাদান আত্মস্থ করতে।
শিক্ষা ও মনন তৈরিতে সবার আগে প্রয়োজন বই। এখনও পৃথিবীখ্যাত বইয়ের প্রতি আছে সুশীল সমাজের তীব্র আকর্ষণ। আরও আছে জানার অসীম কৌতূহল, আগ্রহ, সৌজন্যবোধ, অনুপাত জ্ঞান, মায়া-মমতা, নম্রতা, ভদ্রতা এবং আরও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জড়িয়ে আছে তা হলো সাংস্কৃতিক বোধ।
সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত আচরণ ও পরিশ্রুত জীবনধারা। উৎকর্ষ অর্জনের বাসনা থেকে সংস্কৃতি গতিশীল হয়। আর এই সংস্কৃতি বহতা নদীর মতোই প্রবহমান।বিশ্বায়নের এই কালে একদিকে পশ্চিমা উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থেকে, অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই ঢুকে পড়ছে ভিন্ন ভিন্ন জীবনধারা, অভ্যাস, রুচি, আচরণ। এই অভ্যাস, রুচি, আচরণ, জীবনধারাকে একত্রিত করে নিয়তই রূপান্তর ঘটছে সামাজিক কাঠামোয়।
ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটোর সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া বৈচিত্র্যময় এবং কিছুটা বিদঘুটে সংস্কৃতির কারণে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্র এবং জীবনধারাও বদলে যাচ্ছে। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিচিত্রতর জীবনধারায় কে না প্রবেশ করতে চায়। তাইতো এই যে সংস্কৃতির রূপান্তর, মানুষের বদলে যাওয়া মনোজগত; এতে সমাজের কতটুকু লাভক্ষতি হয়েছে, তারচেয়েও বড় কথা বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণে অপরিহার্যভাবে আমাদের সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে।এই সময়ের সামাজিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াটা আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে আর মিলে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে জনপ্রিয়তা অর্জনের সহজ পথ খোঁজে অনেকেই, পেয়ে যায় তারচেয়েও দ্রুততার সঙ্গে। সহজেই যদি জনপ্রিয় হওয়া যায় তাহলে আর কষ্টকর প্রক্রিয়ায় কে যেতে চায়!সাহিত্য রচনার জন্য দেশ-বিদেশের সাহিত্য পড়ার আর প্রয়োজন বোধ হয় না। সংগীত শিল্পী হওয়ার জন্য সাধনার সময়টুকু অযথা ক্ষেপণ মনে করে, সাংবাদিকতার মানদণ্ড না জেনেই একেকজন সাংবাদিক হয়ে সংবাদ প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষাদানের মৌলিক বিষয়গুলো আত্মস্থ না করেই একেকজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন। অভিনয় না জেনেও যদি কোটি মানুষকে আকৃষ্ট করা যায় তাহলে আর অভিনয়ের কলাকৌশল রপ্ত করার প্রয়োজনটা কী?
এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ শর্টকাট পথ খুঁজছে, পেয়েও যাচ্ছে। পরিবর্তন ঘটছে রুচির। তথাকথিত জনপ্রিয় বিষয়গুলোই সাধারণ মানুষকে টানছে। তাই তো শহর-বন্দর, নগর-পাড়া, মহল্লা-গ্রামে চায়ের দোকানে প্রায় সবখানেই সন্ধ্যা হলে ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখার জন্য টেলিভিশনের সামনে ভিড় জমে যায়। ঘরে ঘরে আলোচনা চলে পরদিনের পর্বে নতুন কী কী কূটকৌশল অপেক্ষা করছে। ইউটিউবের মানহীন কিন্তু আকর্ষণীয় সস্তা মিউজিক ভিডিও, নাটক, টিকটক বা অন্য কোনো কন্টেন্টে মানুষ বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।মেধা ও ইতিবাচক শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে পারেনি বলে মানহীন বিষয়গুলো আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তথাকথিত মোটিভেশন বই বেস্ট সেলার হয়, চটুল নৃত্যগীত ছন্দে রচিত নাটক বা সিনেমা নামের জিনিসগুলো লাখ লাখ দর্শক টানে, আর সব কিছুকে পেছনে ফেলে চাকরির বাজারে বিশেষ পর্যায়ে পাস করা ওঠে সবচেয়ে দামি এবং মর্যাদাপূর্ণ চাকরি। আমাদের প্রতিভা আছে, মেধা আছে কিন্তু শ্রম দিয়ে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর রুচি, সময় এবং ইচ্ছা কোনোটিই নেই। নেই গবেষণাকর্মের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কারের উদ্যম, উদ্দীপনা, উন্মাদনা।যাত্রাশিল্প, পালাগান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি কিংবা লোকজ সংস্কৃতি কবেই মাঠে মারা গেছে। মঞ্চ নাটক আর দর্শক টানে না। চলচ্চিত্রের অবস্থাও করুণ। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, জহির রায়হান, আলমগীর কবির কিংবা তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র এখন আর বিনোদনের জন্য আবেদন জাগায় না। সত্তর, আশি, নব্বই কিংবা দুহাজার দশকের অসাধারণ মনোমুগ্ধকর সুরেলা সংগীত এখন আর হৃদয়ে অনুরণন তোলে না। রবীন্দ্রনাথকেও জাদুঘরে ঠেলে পাঠানোর কত কায়দা কৌশল চলছে, যদিও রবিঠাকুর স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছেন মাথা উঁচু করে। তবে দায় শুধু সাধারণ মানুষের নয়, শুধু দর্শকের নয়, শুধু শ্রোতার নয়; দায় সম্মিলিতভাবে সবারই। বিশেষ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তাদের দায় সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আমাদের আদি এবং অকৃত্রিম সংস্কৃতিকে অবাধ তথ্যপ্রবাহের মহাসড়কে সংযুক্ত করতে পারিনি। আবহমান সংস্কৃতিকে ধারণ করার জন্য আমাদের জনগণকে সুশিক্ষা দিতে পারিনি, আলোকিত করতে পারিনি, শেকড় সন্ধানী হওয়ার জন্য ঔৎসুক্য তৈরি করতে পারিনি। বরং শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। দেশীয় সংস্কৃতিকে মুঠোফোনের বাটনে আনতে যে উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল, সেটিও কারো মাথাতেই ঢোকেনি।সংস্কৃতির রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় অপসংস্কৃতি সব কালে, সব যুগেই ছিল, কিন্তু বর্তমানে প্রবলভাবে স্থান করে নেয়ায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর সুস্থ জীবনধারা বিকাশ নিদারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর এই অপসংস্কৃতি যাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে তাদের মনুষ্যত্ব বিকাশে মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত চেতনা জাগ্রত হয়নি। তাইতো বার বার আমরা হোঁচট খাই, মুখ থুবড়ে পড়ি, আবারও দাঁড়াতে চেষ্টা করি। অপসংস্কৃতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া রোধ করতে না পারলে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটা অংশটি কখনোই মানসিকভাবে উন্নততর জীবনধারায় প্রবেশ করতে পারবে না।দেশের প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি, শেকড়ের প্রতি আমাদের আবেগ, অনুভূতির স্থানটা সাধারণ মানুষের মননে ঢোকাতে হবে। বাঙালির সেই আদি অকৃত্রিম চেতনা সাধারণের মাঝে স্ফুরিত করতে হবে। সব ধরনের প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, প্রয়াস দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের শেকড়ে ফেরার নতুন যুদ্ধে নামতে হবে। তবে কীভাবে সেই যুদ্ধ শুরু হবে, সেটাই প্রশ্ন।আমরা যতই কর্পোরেট কালচারে উদ্বুদ্ধ হই না কেন সেই সোঁদা মাটির গন্ধ, শীতের রাতে যাত্রা দেখে বাড়ি ফেরার রোমাঞ্চ, সেই কৃষানের জন্য কৃষানির পরম মমতায় খেতে খাবার নিয়ে যাওয়ার চিরচেনা চিত্র, সেই টিনের চালে বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ, সেই গ্রামীণ জনপদের সকালের সোনা জড়ানো রোদের দৃশ্যকল্প আমাদের দৃষ্টিসীমাকে বহুদূরে নিয়ে যায়। আমাদের দাঁড় করায় সেই শৈশবের মুখোমুখি, যে শৈশব আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে না পারলেও জীবনকে মোহময়, মায়াময়, কাব্যময় করে ভাবনার বাসনা দিয়েছে। যে শৈশব থেকে খুঁজে পাই কঠিনতম বাস্তবতার মাঝেও আনন্দময় জীবনের রসদ। ‘দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ’... এই সেই গন্ধ যা মদিরতা মাখানো শৈশব থেকে আহরিত। এটা ইউটোপিয়ান ড্রিম বা ‘কাল্পনিক স্বপ্ন’ নয়, এটা অতীতাশ্রয়ী মধুরতম অনুভূতি। সংকটের এই সময়ে সেই মধুরতম অনুভূতি দ্বারাই উন্নততর সাংস্কৃতিক বোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে সভ্যতার সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষক-প্রাবন্ধিক।