বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লক্ষ্য হোক আফ্রিকা

  •    
  • ২৮ আগস্ট, ২০২১ ১৬:৪০

সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ার সব থেকে ধনী দেশ চায়নাও আফ্রিকার অনেক দেশে তাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়িয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। চায়না তাদের বেশি বিনিয়োগ করছে রাস্তা, ব্রিজ এবং পোর্ট তৈরিতে। তবে তারা কৃষিতেও বিনিয়োগ করছে। ২০১৯-এর হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, চায়না বিদেশে কৃষিতে যে বিনিয়োগ করে, ওই মোট বিনিয়োগের ১২% তারা আফ্রিকার দেশগুলোতে করছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি আফ্রিকার সুদান ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেছেন। এই অতিমারিকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আফ্রিকার এই দুটি দেশ সফর নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি যে আফ্রিকার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন, এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য বা সর্বোপরি অর্থনীতির জন্য তা একটা ভালো দৃষ্টিভঙ্গি। আফ্রিকার প্রতি বাংলাদেশের আরও আগ্রহী হওয়া উচিত, এ কথা নানান স্টাডি ফোরামে দীর্ঘদিন থেকে বলা হচ্ছে। সব থেকে আশ্চর্য লাগে, বাংলাদেশ ও আফ্রিকার মানুষের গায়ের রং, আচার-আচরণ বা পারিবারিক, সামাজিক কাঠামো ও রীতিনীতি একই রকম। তার পরেও বাংলাদেশে ইউরোপীয় যতগুলো দেশের দূতাবাস আছে, আফ্রিকার ততগুলো নেই; বা ওইভাবে অন্য যোগাযোগও বাড়ানো হচ্ছে না আফ্রিকার সঙ্গে।

অথচ অন্যান্য এশীয় দেশ ইতোমধ্যে অনেক যোগাযোগ বাড়িয়েছে আফ্রিকার সঙ্গে। যেমন এ সপ্তাহেই এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ সিঙ্গাপুর আফ্রিকায় তাদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য আরও বাড়ানোর জন্য চুক্তি করেছে। সিঙ্গাপুর আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশের মধ্যে ৫০টিতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য করছে। এ দেশটি মূলত আফ্রিকার দেশগুলোতে কৃষি, সাধারণ শিল্প, কৃষি-শিল্প ও ব্যবসা, সাধারণ ব্যবসায় এবং তেল ও গ্যাসে বিনিয়োগ করছে।

সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ার সব থেকে ধনী দেশ চায়নাও আফ্রিকার অনেক দেশে তাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়িয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। চায়না তাদের বেশি বিনিয়োগ করছে রাস্তা, ব্রিজ এবং পোর্ট তৈরিতে। তবে তারা কৃষিতেও বিনিয়োগ করছে। ২০১৯-এর হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, চায়না বিদেশে কৃষিতে যে বিনিয়োগ করে, ওই মোট বিনিয়োগের ১২% তারা আফ্রিকার দেশগুলোতে করছে।

চায়না ও সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগের মধ্যে পার্থক্য হলো চায়নার অধিকাংশ বিনিয়োগ সরকারি, অপরদিকে সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ সবই প্রাইভেট সেক্টরের। প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ হওয়াতে ওই বিনিয়োগ অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করছে আফ্রিকার অনেক বিজনেস অ্যানালিস্টরা।

কারণ, চায়নার বিনিয়োগ নিয়ে ইতোমধ্যে জমি গ্রাস করা ও ঋণের ফাঁদে ফেলার অভিযোগসংক্রান্ত বেশ কিছু রিপোর্ট বিভিন্ন মিডিয়া প্রকাশ করেছে। যদিও জন হফকিনস ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে, রিপোর্টগুলো চায়নার আগ্রাসন সম্পর্কে বেশ বাড়িয়ে বলেছে। রিপোর্টগুলো যেখানে ৬ লাখ একর জমি গ্রাসের কথা বলছে, এটা ২ লাখ একরের কিছু বেশি হবে। অপরদিকে কেনিয়াকে যে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে চায়না, তা শোধ করতে পারছে না দেশটি। আর এ সুযোগে কেনিয়ার রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে আরও প্রভাব বাড়িয়েছে চায়না। তারা সেখানে কৃষির থেকে এখন এনার্জি ও ট্রান্সপোর্ট অবকাঠামো গড়ে তোলার দিকে বেশি নজর দিয়েছে। সেখানে নিজস্ব কমার্শিয়াল ব্যাংক স্থাপন করে চায়নিজ ফার্মগুলোকে ঋণ দিচ্ছে।

চায়নার এই রাস্তা, পোর্ট ব্রিজের অবকাঠামো গড়ে তোলাকে দুভাবে দেখা হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছে, এর ফলে আফ্রিকার বাণিজ্য বাড়বে। সমগ্র আফ্রিকার ৭০ ভাগ মানুষ যেখানে কৃষিকাজ করে, তাদের কৃষিপণ্য সরবরাহে এই রাস্তা ও পোর্ট সহায়তা করবে। তাতে কৃষিপণ্যের জন্য অনেক বেশি সুবিধা হবে। তবে আফ্রিকার বাণিজ্য ও ভবিষ্যৎ গবেষণার অনেক প্রতিষ্ঠান মনে করছে, এই অবকাঠামো তৈরির লক্ষ্য শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। চায়না এ কাজ তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই করছে।

এশীয় দেশ সিঙ্গাপুরের মতো ভারতও আফ্রিকাতে তাদের নানা ব্যবসার সঙ্গে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। সেগুলো করছে তাদের প্রাইভেট কোম্পানিগুলো। ভারতের সঙ্গে আফ্রিকার অনেক দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অতীত থেকেই চলমান। কিছু শুরু হয়েছে ব্রিটিশ-ভারত আমল থেকে আর কিছু তারও আগে থেকে। যে কারণে আফ্রিকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেখানে বাস করছে।

২০১০ সালের একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ৮০টি কোম্পানি আফ্রিকায়। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, সেনেগাল ও মোজাম্বিকে কৃষিতে ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অর্থনৈতিক পলিসি ফোরামের তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, আফ্রিকার কৃষিতে ভারতের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আরও অনেক বেড়েছে।

তারা আফ্রিকায় অনেক জমিও কিনেছে। মূলত আফ্রিকায় ৮০৭ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমির তিন মিলিয়ন হেক্টরের মতো এখন চাষাবাদ হচ্ছে। ভারত তাই কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ ছাড়াও সেখানকার কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আর এ কারণে ভারত সরকার আফ্রিকায় ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের আওতায় তাদের দেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগ করতে সহায়তা করছে।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাবমতে, ২০৩০-এর মধ্যে আফ্রিকায় যে খাদ্য উৎপাদন হবে তার মূল্য দাঁড়াবে এক ট্রিলিয়ন ডলার। যা ২০৫০ সালের মধ্যে হওয়ার কথা সেই লক্ষ্যে আফ্রিকার দেশগুলো ২০৩০-এর মধ্যে পৌঁছানোর পথে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মনে করে, আফ্রিকার কৃষি উৎপাদন ও কৃষি-শিল্পে ছোট আকারে বিনিয়োগ যথেষ্ট লাভজনক। যার ফলে আফ্রিকা তাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আগামী ২০৬৩-তে পৌঁছে যাবে। আর এ লক্ষ্যে কাজ করার জন্য আফ্রিকার অনেক দেশে ভারতসহ অনান্য দেশ তিন দেশীয় পার্টনারশিপে কাজ করছে। তারা ইউরোপ ও আমেরিকার ফান্ড প্রোগ্রামগুলো থেকে সহজশর্তে ঋণ নিচ্ছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্প্রতি এই আফ্রিকার দুটি দেশ সফরের পরে তাই স্বাভাবিকই এ বিষয়টা সামনে আসে, বাংলাদেশ কেন আফ্রিকার কৃষিতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের অন্যান্য সুযোগ নেবে না? কারণ এটা তো সত্য, পরবর্তী পৃথিবীর অর্থনীতির বড় অংশ যেমন এশিয়ার হাতে থাকবে, তেমনি আফ্রিকাও এই শতকের মধ্যভাগে গিয়ে অর্থনীতির একটি বড় অঞ্চল হবে। কারণ ইতোমধ্যে পৃথিবীর যে বারোটি দেশের প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়ছে, তার ভেতর ছয়টি আফ্রিকান দেশ; এই সংখ্যা দ্রুত বাড়বে।

ইথিওপিয়া ইতোমধ্যে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। আফ্রিকার অন্যান্য দেশও দ্রুত এগোবে- কারণ সেখানে বিদ্যুৎ ও শ্রম সস্তা। তাই বাংলাদেশকে আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দেয়া এখন একটি অনিবার্য বিষয়। যেমন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সুদান ঘুরে এলেন, সুদান বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য বিশেষ করে গানিব্যাগ রপ্তানির একটি অন্যতম গন্তব্য। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, বাংলাদেশের পাট রপ্তানির সঙ্গে এমন কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রুপ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যার ফলে সুদানের বাজারে যে পরিমাণ পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করা সম্ভব, তা হয় না।

অপরদিকে বাংলাদেশকেও এখন মনোযোগ দিতে হবে আফ্রিকার কৃষি উৎপাদন ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের দিকে। আর এ কাজে অবশ্যই বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর ও ভারতের পথেই হাঁটতে হবে। বাংলাদেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলো যাতে সেখানে ডাইরেক্ট বিনিয়োগ ও ত্রিপক্ষীয় বিনিয়োগ করতে পারে, তার সুযোগ বাংলাদেশ সরকারকে করে দিতে হবে। কৃষিতে বাংলাদেশ অনেক ভালো করবে আফ্রিকায় বিনিয়োগ করলে। কারণ, আফ্রিকার প্রতিটি কৃষিপণ্যের ওপর এখন গবেষণা করা দরকার। যাতে তার প্রতিটি কৃষিপণ্যের ফলন বাড়ে। কৃষিতে গবেষণায় বাংলাদেশের জ্ঞান অনেক সমৃদ্ধ। এটাকে সেখানে কাজে লাগনো যাবে। এই জ্ঞান শুধু মূল খাবারগুলোর ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য কৃষিপণ্যে কাজে লাগালে সেগুলো রপ্তানির পাশাপাশি একটা অংশ বাংলাদেশেও আনা সম্ভব হবে।

যার ফলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার যে মূল খাদ্যের পাশাপাশি অন্য খাদ্য দরকার, তা পূরণে সহায়ক হবে। কিন্তু এ কাজে বাংলাদেশের মোটেই উচিত হবে না সরকারি বিনিয়োগে যাওয়া। কারণ, চায়না সরকারি বিনিয়োগে গিয়ে যেভাবে লাভ করতে পারে, বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। চায়নার সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিপরায়ণ অন্য দেশে। তারা নিজের দেশের স্বার্থে অন্য দেশের প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রশাসনের দুর্নীতির চরিত্র হলো, প্রশাসনের লোকজন ব্যক্তিগত স্বার্থে দুর্নীতি করে।

কৃষির পাশাপাশি বাংলাদেশের বাস্তব অভিজ্ঞতাসহ সব ধরনের জ্ঞান রয়েছে টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পে। ভারত, চায়না ও ভিয়েতনামের থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত অনেক বেশি। এ সেক্টরগুলো ভালো করবে আফ্রিকাতে। তাদেরও ধৈর্যসহকারে আফ্রিকাকে পরবর্তী উৎপাদন স্থান হিসেবে নিতে হবে। সরকার নিঃসন্দেহে তাদের সহায়তা করবে।

এ বিভাগের আরো খবর