প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একজন শিশু জন্মগ্রহণ করে। অবস্থা ও অবস্থান বিবেচনায় নানারকম ঘটনা প্রক্রিয়ার মধ্যে সেই শিশুটি বিকশিত হয় ও বেড়ে ওঠে। যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ ও দক্ষতা অর্জনের উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সেই শিশুটিই প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার মাধ্যমে নিজের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পরিবারের ও দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করার মাধ্যমে সমাজ ও সভ্যতাকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আর একটি দেশের কর্মক্ষম হিসেবে বিবেচিত জনসংখ্যার মোট পরিমাণ কর্মক্ষম নয়, এমন জনসংখ্যার (শিশু ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী) তুলনায় বেশি হলে তখন সেই অবস্থাটাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতিক লভ্যাংশ বলে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি)-এর ওয়ার্ল্ড পপুলেশন স্টেট অনুসারে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের কর্মক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ যদি কর্মক্ষম হয় তাহলে দেশটি জনমিতিক বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ পাওয়ার অবস্থায় রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এই অবস্থাকে ইংরেজি ভাষায় ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলা হয়ে থাকে। আর ‘লভ্যাংশ’, শব্দটির সঙ্গে সাধারণভাবে টাকা-পয়সা আয়-উপার্জনের বিষয় জড়িত রয়েছে বলেই আমরা জানি। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ অর্জনের পর্যায়ে রয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের দেশে কর্মক্ষম লোকের পরিমাণ ছিল মাত্র মাত্র ২০/২২ শতাংশ। স্বাধীনতার প্রায় ৩৬ বছর পরে ২০০৭ সালে আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬১ শতাংশের বয়স এই সীমার মধ্যে উপনীত হয় বর্তমানে যা প্রায় ৬৮ শতাংশ। কর্মক্ষম মানুষের এই আধিক্য ২০৩৮ সালের পর থেকে কমতে থাকবে। এ এক অপার সম্ভাবনা যা কোনো জাতির জীবনে একবার কিংবা কয়েকশ বছরে একবার আসে। চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া- এসব দেশ এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের যে স্বপ্ন তা অনেকটাই নির্ভর করছে এই সময়টিকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ আর তার কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সেক্টরগুলোতে আমাদের যে বিনিয়োগ তারই ফসল এটি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা, জমি ও জনসংখ্যার মধ্যে সমতা রাখা, জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা ইত্যাদি বিষয়ে নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমা এবং পরিবার ছোট রাখার আগ্রহের কারণে গড় ফার্টিলিটি রেট কমা। মানুষ এখন ভালো থাকতে চায় এবং পরিবারের সদস্যদের ভালো রাখতে চায়। এরই ফলে বিশ বছর আগে যে শিশুরা জন্মগ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে মারা গেছে কম। আবার বাবা-মা, পরিবার তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে তাদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। সে এখন পরিপূর্ণ একজন কর্মক্ষম মানুষ।
জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশের এই ফসল ঘরে তুলতে হলে এই মহামারিকালে আমাদের দরকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশকে স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি জাতীয় কর্মসূচি।
আমরা জানি করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব! পিছিয়ে নেই আমরাও। করোনার প্রথম ধাক্কার পর বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও বিশ্বের কোথাও কোথাও দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ পার হয়ে চতুর্থ ঢেউয়ের ধাক্কা চলছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ জরিপ অনুযায়ী, করোনার এক বছরে দেশের ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬০ লাখ ধরলে করোনার প্রভাবে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার ফলে এ হার আবারও বাড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রি আছে এমন বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ দরিদ্র ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের বেতন কমেছে ৩৭ শতাংশ। ঢাকায় বেতন কমেছে ৪২ ও চট্টগ্রামে ৩৩ শতাংশ। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৬৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। দেশের ২০ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। ৬৯ শতাংশ চাকরিজীবী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, যারা দেশের অর্থনীতিতে ৪৯ শতাংশ অবদান রাখেন। করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরিমাণ ৮৭ শতাংশ কমে ১৩ শতাংশ হয়েছে। অপরদিকে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ হয়েছে।
বাস্তবিকপক্ষে এই জনমিতিক লভ্যাংশ পেতে হলে আমাদের তো দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির দিকে মনোযোগী হতে হবে। একবিংশ শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে হবে।
আজকে সারা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন উন্নত দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ঋণাত্মক অভিমুখী। জাপানে আজ কর্মক্ষমতাহীন লোকের সংখ্যাই বেশি। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাধ্যতামূলক এক সন্তান নীতি আর জনমিতিক লভ্যাংশ এই দুই মিলিয়ে চীন এখন অন্যতম সেরা অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে কিন্তু চীনেও ধারাবাহিকভাবে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমছে যেটা তাদের এখন এক জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ আমাদের দেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধির যে হার স্থিতিশীল রয়েছে তার অন্যতম কারণ- এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অক্লান্ত শ্রম ও ঘামের বিনিয়োগ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এই যে দীর্ঘ অতিমারির প্রায় দেড় বছর সময় আমরা অতিবাহিত করছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক দূরত্ব বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠান সবই বন্ধ। এই সময়ে সঠিক পরিকল্পনা বা রোডম্যাপের অভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি তো দূরের বিষয় বরং জ্ঞান ও দক্ষতা যা ইতঃপূর্বে অর্জিত হয়েছিল তার থেকেতো আমরা পিছিয়ে পড়েছি।
এপ্রিল ২০২১ সময়ে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্চ ১৭, ২০২০ থেকে দেড় বছরাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে এর প্রভাব পড়েছে ৩৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী আর প্রায় ১ মিলিয়ন শিক্ষকের উপর।
সরকারের মূল সাড়া ছিল টিভি-ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে। স্কুল বন্ধ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে এটি স্পষ্ট ছিল যে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
২০২০ সালের মে মাসে বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রেড ৯ এ উপবৃত্তিপ্রাপ্তদের প্রায় ৫৫ শতাংশেরই টিভি ব্যবহারের সুযোগ নেই। ব্যাংকের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০২০ সালের জুন মাসে প্রায় ৩৪ শতাংশ পরিবারের পক্ষ হতে সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে তারা বাধ্য হয়েছেন কিশোর-কিশোরীদের খাবার হ্রাস করতে। উপরন্তু, প্রায় অর্ধেক কিশোর-কিশোরীরা রিপোর্ট করেছে যে তারা লকডাউনের আগে শিক্ষার চেয়ে কম সময় ব্যয় করছে, ৯৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরীরা জানান, তারা গৃহস্থালির কাজ বা চাইল্ড কেয়ারে সময় বাড়িয়েছেন। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক যে তথ্য তা হচ্ছে ২৫ শতাংশ মায়েরা উদ্বিগ্ন যে স্কুলগুলো পুনরায় চালু হলে কিশোর-কিশোরীরা স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না বা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়বে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তবে কি আমাদের আশায় গুড়েবালি! নাকি আমরা এই পরিস্থিতি উত্তরণে নতুন কোনো পথের সন্ধান করব।
জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ অর্জনের সুযোগ আমরা তখনই নিতে পারব, যদি আমাদের দেশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষভাবে কিশোর-কিশোরী এবং তরুণদের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করে। লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের উন্নতি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যে বিষয়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন।
ডেমোগ্রাফিক ডিফিডেন্ডের সুফল পেতে আমাদের এখন যা করতে হবে- প্রথমত যত দ্রুত সম্ভব অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে টিকা গ্রহণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
দ্বিতীয়ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট যত দ্রুত সম্ভব খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। করেনাকালে শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় আমাদের শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশ যতটুকু পিছিয়ে পড়েছে তা পুনরুদ্ধারে যথাযথ বিনিয়োগ ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ হতে পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ৮ ভাগ বরাদ্দের পরামর্শ বিবেচনায় নিতে হবে।
তৃতীয়ত, করোনাকালে যেহেতু প্রচুর শ্রমজীবী মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন সেই জন্য শহুরে ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে আলাদা করে যুগোপযোগী, বাস্তবভিত্তিক ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
চতুর্থত, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে শ্রমিকদের পুষ্টিহীনতা দূর করতে এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরসনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নীতিমালা যথাযথ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পঞ্চমত, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজশর্তে একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে মূলধন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ষষ্ঠত, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করার পাশপাশি তাদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সপ্তমত, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি রোধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা