১৯৪১ সালের ১২ আগস্ট। ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনের অধিবেশনের প্রধান অতিথি হিসেবে এলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার সঙ্গে আরও আসেন অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, মুহম্মদ শামসুল হুদা চৌধুরী ও আবদুর রউফ। আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ হুমায়ুন কবীর। যদিও প্রশাসন থেকে ১৪৪ ধারা জারি করায় সে অধিবেশন হয়নি। আর সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন-
...“কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।”... (পৃ. ১৫-১৬)
তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স ছিল ২১ বছর। এরপর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন তিনি। বার বার কারারুদ্ধ হতে লাগলেন। কারাবন্দি থাকার সময় কাজী নজরুলের কবিতা ‘বিদ্রোহী’, ও গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’সহ নানা সৃষ্টিকর্ম তাকে অনুপ্রাণিত করেছে নিঃসন্দেহে। কারণ ১৯৫৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালিত হয়। এ উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ওই সময় করাচিতে থাকায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেই প্রবন্ধটি পাঠ করেন মোশারফ হোসেন চৌধুরী। দেশের সে সময়কার পরিস্থিতিতে বিদ্রোহী কবির বিপ্লবী জীবনাদর্শ ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষের কতখানি প্রয়োজন- প্রবন্ধের উপসংহারে সেটাও জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৪২ সাল থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার মন্ত্রী থাকা অবস্থায় অসুস্থ কবি কাজী নজরুলকে কলকাতায় দেখতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজী নজরুল তখন থাকতেন টালাপার্কের মন্মথ দত্ত রোডের দোতলার একটি ফ্ল্যাটে। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ও সন্দেশের একটি প্যাকেট নিয়ে কবির বাসায় যখন বঙ্গবন্ধু যান, কবি তখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কবিকে হাত উঠিয়ে সালাম জানিয়ে রজনীগন্ধাগুচ্ছ তুলে ধরেন। কবিও হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করেন।
কাজের দিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে মিল ছিল। বাঙালির স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সেটা করেছেন রাজনীতির মাধ্যমে আর কাজী নজরুল করেছিলেন কবিতা, গান, প্রবন্ধের মাধ্যমে। তার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে। সীমাহীন দরিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছেন কবি। মসজিদের মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে রুটির কারিগরসহ করেছেন নানা রকম কাজ। ১৯১৭ সালের শেষদিকে সেনাবাহিনীতে নাম লেখান নজরুল। প্রায় আড়াই বছরের সৈনিক জীবনে সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এখানে থাকতেই ফারসি ভাষা শেখেন।
বলা যায় নজরুলের সাহিত্যের হাতেখড়ি শুরু হয় করাচি সেনানিবাসে থাকার সময়ই। প্রথম মহাযুদ্ধে সৈনিক হিসেবেও নাম লিখিয়েছিলেন নজরুল। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন। ৩২ নং স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করলেন। এ সমিতির কর্তা ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ। আর এখান থেকেই শুরু হয় নজরুলের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জীবন। পরিচয় হয় কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সঙ্গে। বিভিন্ন সাহিত্যিকদের আড্ডায় যাতায়াতের সুবাদে কলকাতার বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় কাজী নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। কবিতাটি প্রকাশের পর পর পুরো ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন কাজী নজরুল ইসলাম। তারপর একের পর এক কবিতা লিখতে শুরু করলেন নজরুল ইসলাম। শোষণ-বঞ্চণার বিরুদ্ধে কবিতা। বাঙালি জাগরণের কবিতা। সঙ্গে গান। কবিতা ও গান দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে আলোড়ন তুললেন কবি। প্রমাদ গুনল ব্রিটিশ শাসকেরা। নানান ছুতোয় কবিকে কারাবন্দি করতে শুরু করল। কবির সতেরোটি কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করল। এতে দেশের মানুষের মনে কবির জায়গা বরং আরও পাকাপোক্ত হলো। কারণ কাউকে দমিয়ে রাখা যায় না। ঠিক যেরকমটি ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর বেলায়। মুক্তির আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর কাজী নজরুল পড়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে।
এ দুজনের মতের মিল যেখানে অবিশ্বাস্য, সেখানের মনের মিল তো ঘটবেই। কিন্তু দুজন কখনও দুজনার সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেননি। কারণ কবি যে সেই ১৯৪২ সাল থেকে অসুস্থ। এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে, কথাও বলতে পারতেন না। চিকিৎসার জন্য কবিকে কয়েকবার নানান দেশে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আজীবনের জন্য বাকরুদ্ধই থেকে যান কবি।
এদিকে ততদিনে পূর্ব বাংলার নাম বদলে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালির ভাষা, স্বাধিকার, মৌলিক চাহিদা-সব কিছুর ওপর শোষণ চালাতে লাগল পশ্চিম পাকিস্তান। এসময় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনে আরেক কবির উদয় হলো। তবে সে কবি সাহিত্যের জন্য কবিতা লেখেন না। সুর দেয়ার জন্য গান রচনা করেন না। পাকিস্তানের শোষণ থেকে বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করেন সে কবি। কারণ তিনি যে রাজনীতির কবি। এই রাজনীতির কবির দেখানো স্বপ্নের হাত ধরেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জন করল বাঙালি।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এলেন সেই রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আরোহণ করেও কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভুললেন না কাজী নজরুল ইসলামের কথা। বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা করা হলো কাজী নজরুল ইসলামকে। কবির লেখা ‘চল চল চল’ গানটিকে বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে মর্যাদা দেয়া হলো। শুধু তাই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবহেলিত কবিকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগও নিলেন বঙ্গবন্ধু; এবং দ্রুততার সঙ্গে। যাতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭৩তম জন্মদিনের উৎসব ঢাকায় পালিত হতে পারে অতি সাড়ম্বরে।
১৯৭২ সালের ২৪ মে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় কবিকে। কবির সঙ্গে তার দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। সঙ্গে কবির দুই নাতনীও ছিলেন-খিলখিল কাজী ও উমা কাজী।
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০ নম্বর বাড়িটি কবিকে বরাদ্দ দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু নিজেই কবির বাসভবনের নামকরণ করেছিলেন ‘কবিভবন’। সেদিন বিকেলেই কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে কবিভবনে হাজির হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হলো। পরদিন কবির জন্মবার্ষিকী পালিত হলো মহা-আড়ম্বরে।
দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় বাকরুদ্ধ কবির শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবির স্বাস্থ্যের অবনতি হলো ভীষণভাবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পিজি হাসাপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে স্থানান্তর করা হলো কাজী নজরুল ইসলামকে। তবে পিজি হাসপাতালে কবিকে ভর্তি করানোর এক মাসও পেরোয়নি। তার আগেই ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ও আত্মীয়-পরিজনসহ হত্যার শিকার হলেন রাজনীতির কবি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আর কাজী নজরুল ইসলাম পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন একবছর এক মাস আট দিন। হাসপাতালে তার অবস্থার উন্নতি না হয়ে দিন দিন অবনতি হচ্ছিল। তিনি ব্রনকোলিমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ ১২ ভাদ্র তারিখে তার শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি অতিক্রম করল। চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
যে মানুষটার সঙ্গে কবির মনের মিল মতের মিল ছিল, তার অভাব বড্ড প্রকট হয়ে গেল কবির মৃত্যুতে। কবিকে কোথায় সমাহিত করা হবে, সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগল তখনকার ক্ষমতাসীনরা। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয় কবিকে। তার আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে রাখা হয়েছিল কবিকে। এরপর বিকেল সাড়ে চারটায় রমনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। আর বিকেল পাঁচটায় কবিকে দাফন করা হয়। এম আর আখতার মুকুল তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ বইতে জানিয়েছেন-
“জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের লাশ নিয়েও কিছু গোপন রাজনীতি হয়ে গেল। পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী কলকাতা থেকে প্লেনে সন্ধ্যায় যখন ঢাকায় এসে পৌঁছলেন, তখন কবর দেওয়া হয়ে গেছে। বেচারা পিতার মুখ শেষবারের মতো দেখতে পেলেন না। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে গেলেন।” (পৃ. ১৩০)
অথচ কবিভবনে বঙ্গবন্ধুর আসা প্রসঙ্গে কাজী নজরুলের নাতনী খিলখিল কাজী লিখেছেন-
“তিনি প্রায়ই দাদুকে দেখতে চলে আসতেন ধানমণ্ডির কবিভবনে। মাকে খুবে স্নেহ করতেন, মাকে নাম ধরে ডাকতেন ‘উমা’ বলে। মায়ের কাছে খোঁজ খবর নিতেন-দাদুর স্বাস্ব্য, খাওয়া-দাওয়া। সব বিষয়ে তাঁর নজর ছিল প্রখর। এতো সুন্দর বাগানওয়ালা বাড়ি পেয়ে দাদুও খুব খুশিতে বিভোর থাকতেন। আমাদের ছোটদের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু কথা বলতেন ‘কেমন লাগছে এই দেশে? এখান থেকে যাবা আর যাবা না ভারতে? যখন তিনি আসতেন দাদুকে দেখতে আমরা তাঁকে ঘিরে থাকতাম। মাঝে মাঝে আমরা, মা বাপি সবাই বঙ্গবন্ধু ও দাদুর সামনে গান গাইতাম, তিনিও মাঝে মাঝে গলা মেলাতেন। তাঁর আগমনে আমাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। তিনি সবসময় আমাদের পরিবারের একজন অভিভাবকের মতন ছিলেন। মায়ের সাথে দাদুর সবরকম আলোচনা করতেন। তাঁর ব্যবহারে কোনোদিন রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে পাইনি, অসামান্য আন্তরিকতা ছিল তাঁর ব্যবহার।” (বিদ্রোহ কবি ও বঙ্গবন্ধু, সম্পাদনা নূরুল হুদা, নজরুল ইনস্টিটিউট, ২০১৪)
বাঙালির মুক্তির মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু উজ্জীবিত হতেন কাজী নজরুল পাঠ করে। সুযোগ পেলেই নজরুল রচনাবলী পড়তেন। তার প্রিয় গানগুলোর একটি নজরুলের ‘নমঃ নমঃ নমঃ, বাংলাদেশ মম’। কাজী নজরুল লিখেছিলেন- “বাংলা বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।”
রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু এখান থেকেই নিয়েছেন বাঙালির মুক্তির স্লোগান, ‘জয় বাংলা।’ (বঙ্গবন্ধু ও নজরুল, অনুপম হায়াৎ, সময়ের আলো ২৭.৩.২০২০)
আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কবি আমাদের জাতির পিতা কিংবা বাংলাদেশের জাতীয় কবি- কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু বাঙালির মনে পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন-বাঙালির মুক্তি, বাঙালির স্বাধীন ভূখণ্ড বাংলাদেশ আর ‘জয় বাংলা।’
বাংলাদেশের জাতীয় কবির প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও কলাম লেখক