বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যানজট রোধে বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবনা জরুরি

  • রাজন ভট্টাচার্য   
  • ২৬ আগস্ট, ২০২১ ১৮:২৬

একদিকে নগরকেন্দ্রিক যানজট নিরসনে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। অপরদিকে পাল্লা দিয়ে মানুষ বাড়ছে রাজধানী ঢাকায়। এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। যারা গ্রাম বা মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় আসছেন, তাদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্য চাকরি। আরেকটি অংশ আসছে উন্নত পড়াশোনার তাগিদে। নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে যে অংশটি রাজধানীতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে সেই সংখ্যা নগণ্য।

কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। এখন নামমাত্র কিছু বিধিনিষিধের মধ্যে সবকিছু কার্যত স্বাভাবিক। শহরের রাস্তা ফিরেছে পুরানো চেহারায়। সব সড়কেই এখন যানজট আগের মতোই। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে যানজটের ভয়াবহতা বেশি। কথা হলো- গেল ১২ বছরে রাজধানীর এই নাগরিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমে আসবে, এমন প্রত্যাশা ছিল সবার মধ্যে। এ সমস্যা সমাধানে গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেগুলো বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেছে তা দিয়ে কি প্রকৃত অর্থেই এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব?

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রশ্ন যে কারো হতে পারে। তেমনি বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। তারা যখন এই শহরে আসা মাত্রই যানজটের ভোগান্তিতে পড়েন তখন উৎসাহে কিছুটা হলেও ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক।

এসব বিবেচনায় প্রশ্ন উঠতেই পারে এটা কেমন শহর! যে শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটের কারণে বসে থাকতে হয়। সমস্যা সমাধানে শত ছাপিয়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া ছাড়া কি আর কোনো উপায় নেই? যে উপায় পরিস্থিতিকে অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। অবশ্যই আছে। বড় বিনিয়োগ ছাড়া যানজট কমাতে যেসব বিকল্প সামনে আছে, সেগুলো দীর্ঘদিন আলোচনার টেবিলেই সাজানো। এসব বিকল্পে সরকার, পরামর্শকসহ দাতা সংস্থার একেবারেই উৎসাহ কম তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সময়ের বাস্তবতা বলছে, বিপুল অর্থের প্রকল্প না নিয়ে যানজটরোধে বিকল্প ভাবনা অনেক কাজে দিতে পারে।

এক.

যানজট নিরসনে এখন রাজধানীতে মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণাধীন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি’র কাজও চলছে পুরোদমে। আরও কিছু সম্ভাবনাময় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোরেল নির্মাণের কথা রয়েছে। এই সময়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ আসবে রেল নেটওয়ার্কের আওতায়।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কটি উড়াল সড়কের কাজ শেষ হয়েছে রাজধানীতে। অথচ যানজটের মাত্রা কিন্তু কমেনি। বরং বাড়ছে। তবে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলো না হলে সমস্যা আরও বাড়ত এতে কোনো সন্দেহ নেই।

একদিকে নগরকেন্দ্রিক যানজট নিরসনে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। অপরদিকে পাল্লা দিয়ে মানুষ বাড়ছে রাজধানী ঢাকায়। এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। যারা গ্রাম বা মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় আসছেন, তাদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্য চাকরি।

আরেকটি অংশ আসছে উন্নত পড়াশোনার তাগিদে। নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে যে অংশটি রাজধানীতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে সেই সংখ্যা নগণ্য। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনে আরেকটি বড় অংশ এই শহরে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। আর বিভিন্ন অফিসের কাজে নিয়মিত আসা যাওয়া তো আছেই। আরেকটি অংশ আছে যাদের এই শহরে কোনো কাজ না থাকলেও অর্থ আছে, তাই উন্নত নাগরিক জীবন যাপনের প্রয়োজনে থাকেন। করোনা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এখন বাড়ছে হাতপাতা মানুষের সংখ্যা। সেইসঙ্গে একেবারেই প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাও কিন্তু গেল দেড় বছরে ঢাকায় নেহাত কম নয়।

দুই.

’৯০ দশক থেকেই রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ে বেশি আলোচনা। ২০০১ সালের পর তা আরও গতি পায়। যানজট কমাতে দেশি-বিদেশি কটি সেমিনারে অংশ নিয়ে পরামর্শকদের থেকে শুনেছি, উন্নয়ন প্রকল্পেই শুধু যানজট কমবে না। এজন্য সব ক্ষেএেই প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ। অর্থাৎ ঢাকামুখী মানুষের স্রোতে যদি কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে যানজট নিরসন একেবারেই সম্ভব হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো- একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও, বিকেন্দ্রীকরণে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই।

গত ১২ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কোনো তথ্য প্রকাশের খবর জানা নেই। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, ১৯৮৩ সালে গাজীপুর-নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইনের দুপাশ দিয়ে ওয়ানওয়ে রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এরপর উড়াল সড়কেরও প্রস্তাব আসে। কিন্তু নানা আপত্তির মুখে সম্ভাবনার এই প্রকল্পটি আর হয়নি। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলে ঢাকা আজ যানজটের মহাবিপর্যয়ের মুখে গিয়ে হয়ত না-ও দাঁড়াতে পারত।

একটি প্রকল্পের সুফল যদি কোটি মানুষের জন্য ধরা হয় তবে একটি প্রকল্প বাস্তবান করতে করতে নতুন করে এই শহরে আরও অন্তত ৫০ লাখ মানুষ এসে যুক্ত হয়। তারপর আরেকটি পরিকল্পনা শেষে অন্তত পাঁচ বছর পর তা বাস্তবায়ন শুরু হলে- শেষ হতে সময় লাগে মেয়াদের দ্বিগুণ। এই সময়ে আরও কত মানুষ শহরে আসে? এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে যানজট রোধ করা কি সম্ভব হবে?

ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলাচলের জন্য উপযুক্ত শহরের জন্য ২৫ ভাগ রাস্তার প্রয়োজন। আছে মাত্র আট ভাগ। এর মধ্যে দুই ভাগের বেশি থাকে দখলে। ছয় ভাগ সড়কে নিবন্ধিত ১৬ লাখ যানবাহন চলছে। এর বাইরে আরও রয়েছে অন্তত ১০ লাখ যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন। প্রতিদিন রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে অন্তত লক্ষাধিক যানবাহন এসে নগরে শামিল হয়। অথচ এই শহর তিন লাখ যানবাহন চলাচলের উপযোগী। সব মিলিয়ে যানবাহনের ভারে একেবারেই কাহিল অবস্থা শহরটির। মানুষ আর মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপে এই শহর এখন বেসামাল। অর্থাৎ নানা সূচকে বসবাসের অযোগ্য। তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে?। না।

তিন.

নগরবাসীকে যানজটের এই মহাদুর্ভোগ থেকে স্বস্তি দিতে সবার আগে জরুরি প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ। উদ্যোগ নিতে হবে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানাগুলোকে যেকোনো মূল্যে নগরীর বাইরে নেয়ার। নতুন করে শহরে কোনো শিল্প কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয়া না হলেও এখন সময়ের দাবি পুরানোগুলোকে মফস্বল শহরে নেয়া। এখন সারা দেশে খুব ভালো যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। তাই পণ্য আনা নেয়ায় কোনো সমস্যা হবে না। এতে ঢাকার ওপর অনেকটাই চাপ কমবে। শ্রমিকরাও মফস্বল শহরে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন।

রাজধানীর আশপাশের জেলায় নতুন কোনো শিল্প কারখানারও অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে। যদি কেউ শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হন তাহলে তা অবশ্যই মফস্বল শহরের জন্য অনুমতি দিতে হবে। বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসও বিভাগীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। অনলাইন-নির্ভর নাগরিকসেবা আরও বেশি বাড়ানো সম্ভব হলে মানুষ কম ঘর থেকে বের হবেন। তাছাড়া নাগরিক সেবায় ভোগান্তি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। নগরীতে যুক্ত হওয়া নতুন এলাকাগুলোতে যেন পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। সেসঙ্গে সরু রাস্তাগুলো আরেকটু প্রসারিত যেমন করা জরুরি তেমনি নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে পিছপা হওয়া যাবে না। বস্তিবাসীসহ ছোট ভাসমান বা মৌমুমি ব্যবসায়ীদের একটি অংশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজ এলাকায় পুনর্বাসন করা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো, ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে শুধু পুলিশ দায়িত্ব পালন করে থাকে। আর বাদবাকি রাস্তায় কী হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই। যেমন রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে থাকে। রাস্তা দখল করে পার্কিং, মালামাল রাখা, ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানো-নামানো, যাত্রীর জন্য বাসগুলোকে বসে থাকা, যেখানে সেখানে টেম্পো স্ট্যান্ডসহ নানা কারণে সড়কে যানজট লেগে থাকে। অর্থাৎ আইন না মানার প্রবণতা রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। তাই রাস্তায় পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি আরও বেশি স্থাপন করতে হবে সিসি ক্যামেরাও। কেউ আইন ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ট্রাফিক আইনভঙ্গের কারণে কোনো গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, চালকের পয়েন্ট কাটা গেলেই মানুষ আইন মানতে বাধ্য। এভাবে সবার মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই সচেতনতা সৃষ্টি হবে। তবেই নগরীর যানজট পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক করা হয়ত সম্ভব।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর