বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মদক্ষতা ও করণীয়

  • খন্দকার রাসেল হাসান   
  • ২৬ আগস্ট, ২০২১ ১৬:১২

কয়েক বছর যাবৎ লয়েডস প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ বড় কন্টেইনার পোর্টের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। বিশ্বের যেকোনো বন্দরের জন্যই এটি একটি বড় অর্জন। তবে, লয়েডস্ প্রকাশিত এ তালিকায় মূলত একক বন্দর হিসেবে আলোচ্য বছরে বন্দরটি দিয়ে কী পরিমাণ কন্টেইনার হ্যান্ডেল বা পরিবাহিত হয়েছে তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমুদ্র পরিবহনের গুরুত্ব সম্পর্কে কম বেশি অনেকেই জানে। প্রতি একক পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম হিসেবে এটি সর্বাধিক। বৈশ্বিক বাণিজ্যের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি পণ্য এ পরিবহন মাধ্যমেই পরিবাহিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিদিনই সুদৃঢ় হচ্ছে। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্য বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। তবে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের অংশীদারত্ব ধরে রাখতে হলে প্রতিনিয়ত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন এবং পণ্য উৎপাদন খরচ হ্রাসে উন্নতি করতে হবে। পণ্য উৎপাদন খরচে পরিবহন ব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই মূলত সমুদ্র পরিবহনকে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আনক্টাড) তাদের বার্ষিক প্রকাশনা রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০১৫-এ সমুদ্র পরিবহন বাণিজ্য ও ব্যয়ের সাতটি নির্ধারক চিহ্নিত করে; যার মধ্যে বন্দর, সমুদ্র পরিবহনে সার্বিক সংযুক্তি এবং সমুদ্র বাণিজ্যের সার্বিক কাঠামো উল্লেখযোগ্য।

কয়েক বছর যাবৎ লয়েডস প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ বড় কন্টেইনার পোর্টের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। বিশ্বের যেকোনো বন্দরের জন্যই এটি একটি বড় অর্জন। তবে, লয়েডস্ প্রকাশিত এ তালিকায় মূলত একক বন্দর হিসেবে আলোচ্য বছরে বন্দরটি দিয়ে কী পরিমাণ কন্টেইনার হ্যান্ডেল বা পরিবাহিত হয়েছে তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়।

বন্দর ব্যবস্থাপনার বহু সংখ্যক গবেষক বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং পরিমাণকে বন্দরের কর্মদক্ষতার পরিমাপক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সাধারণভাবেই যে বন্দর যত বেশি কর্মদক্ষ সেখানে তত বেশি পরিমাণ জাহাজ ও বন্দর ব্যবহারকারীরা যাবেন, ফলে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংও বেশি হবে। তবে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের বন্দর অবকাঠামো, ব্যবস্থাপনা ও এর অবস্থান। বন্দর অবকাঠামো, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, জাহাজের নিয়মিত রুটসহ অন্য অনেক কারণেই বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছে চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের একমাত্র পছন্দনীয়।

বিষয়টি ভিন্নভাবে বলা যায়, বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছে ভিন্ন কোনো তুলনামূলক কর্মদক্ষ বিকল্প না থাকায় দেশের মোট সমুদ্র বাণিজ্যের শতকরা ৯০ ভাগই এ বন্দরের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে থাকে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডেলিং পরিমাণ তার কর্মদক্ষতাকে কতটুকু উপস্থাপন করে তা পুনর্মূল্যায়নযোগ্য বলে ধরে নেয়া যায়। বন্দর ব্যবস্থাপনা ও কর্মদক্ষতার বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ এবং এর ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী দেশসমূহের তুলনামূলক অবস্থান এ বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করবে বলে আশা করা যায়।

সমুদ্র পরিবহন ও বন্দর কর্মদক্ষতার বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকের মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সূচক হচ্ছে জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আনক্টাড) প্রকাশিত বন্দর ও দেশভিত্তিক লাইনার শিপিং কানেক্টিভিটি ইন্ডেক্স, বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত দেশভিত্তিক লজিস্টিকস্ পারফরমেন্স ইন্ডেক্স, ডুয়িং বিজনেস ইন্ডেক্স ও বন্দরভিত্তিক কন্টেইনার পোর্ট পারফরমেন্স ইন্ডেক্স এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম প্রকাশিত বন্দর অবকাঠামো ইন্ডেক্স অন্যতম।

দেশভিত্তিক লাইনার শিপিং কানেক্টিভিটি ইন্ডেক্স মূলত বৈশ্বিক নিয়মিত (সময় নির্ধারিত) জাহাজ পরিষেবা (লাইনার শিপিং সার্ভিস) এ একটি দেশ কতটা সংযুক্ত তা নিরূপণ করে থাকে। একটি দেশ বা বন্দরে সপ্তাহে কী পরিমাণ নির্ধারিত সময়ে নিয়মিত জাহাজ ভিড়ে থাকে, বার্ষিক মোট কী পরিমাণ নিয়মিত জাহাজ ভিড়ে থাকে, নিয়োজিত জাহাজের বার্ষিক কন্টেইনার পরিবহন সক্ষমতা, পরিবহন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, কন্টেইনার পরিবহন সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়োজিত জাহাজের আকার এবং সরাসরি জাহাজ সেবার মাধ্যমে সংযুক্ত দেশ বা বন্দরের সংখ্যা ইত্যাদি ৬টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে এই সূচক পরিমাপ করা হয়।

দেশভিত্তিক লজিস্টিকস পারফরমেন্স ইন্ডেক্স মূলত একটি দেশ কতটুকু দক্ষতার সঙ্গে দেশের ভেতর ও বাইরে মালামাল পরিবহনে সক্ষম তা নিরূপণের চেষ্টা করে। উক্ত সূচকও মোট ৬টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিমাপ করা হয়। বিষয়গুলো হচ্ছে কাস্টমস, সময়ানুবর্তিতা ও সময়োপযোগিতা, অবকাঠামো, লজিস্টিকস্ পরিষেবার মান, ট্রেকিং ও ট্রেসিং এবং আন্তর্জাতিক শিপমেন্টের সহজলভ্যতা। দেশভিত্তিক ডুয়িং বিজনেস ইন্ডেক্স মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণে একটি দেশের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সীমাবন্ধতাসমূহ পর্যালোচনা করে থাকে। মোট ১২টি বিষয়কে এখানে বিবেচনায় নেয়া হয় যার মধ্যে ভিন্নদেশে আমদানি ও রপ্তানি মালামাল পরিবহনে একটি দেশের স্থল বা বিমান অথবা নৌ-বন্দর ব্যবহারের তুলনামূলক ব্যয় ও সময় অন্যতম।

উল্লেখ্য, উক্ত ব্যয় ও সময়ে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক ও অনিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মনীতি প্রতিপালনে প্রয়োজনীয় ব্যয় ও সময়ের হিসাবও বিবেচনায় নেয়া হয়ে থাকে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বন্দর অবকাঠামো ইন্ডেক্স মূলত একটি দেশের বন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামো তুলনামূলক কতটা বৈশ্বিক মানের তা পরিমাপ করে থাকে।

অপরদিকে বন্দরভিত্তিক লাইনার শিপিং কানেক্টিভিটি ইন্ডেক্সও দেশ ভিত্তিক উক্ত ইন্ডেক্সের অনুরূপ বৈশ্বিক নিয়মিত (সময় নির্ধারিত) জাহাজ পরিষেবা (লাইনার শিপিং সার্ভিস) এ একটি বন্দর কতটা সংযুক্ত তা নিরূপণ করে থাকে। বন্দরভিত্তিক কন্টেননার পোর্ট পারফরমেন্স ইন্ডেক্স বিশ্বব্যাংকের এটি নতুন সূচক। ২০২০ সালেই প্রথম এ সূচকটি গণনা করা হয়েছে।

দেশভিত্তিক বিভিন্ন সূচকে শুধু লজিস্টিকস পারফরমেন্স ইন্ডেক্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। অপরদিকে বন্দরভিত্তিক সূচকেও একমাত্র লয়েডসের সূচকটি ছাড়া অন্য যেকোনো সূচকেই চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

ভিয়েতনাম ও ভারতের একাধিক বন্দর এসব তালিকায় উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকলেও আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। লয়েডসের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ কন্টেইনারকে উপস্থাপন করে ৫৮তম অবস্থান অর্জন করেছে।

অপরদিকে ৮৫তম অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের করাচি বন্দর পাকিস্তানের মোট কন্টেইনার পরিবহনের প্রায় ৬৫.৫ শতাংশ উপস্থাপন করছে।

এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। প্রতি একক পণ্যের বিচারে এই ব্যয় হয়তবা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে সামগ্রিক পণ্য পরিবহনের হিসেবে যেকোনো সাশ্রয়ই অর্থনীতির জন্য লাভজনক।

চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোগত অসক্ষমতা সম্বন্ধে আমরা মোটামুটি অনেকেই অবগত রয়েছি। বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমানে মাতারবাড়ী টার্মিনাল এবং বে-টার্মিনালের নাম আলোচনায় রয়েছে। এ দুটি টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হলে চট্টগ্রাম বন্দর এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশের সংযুক্তি সূচক উন্নতি করবে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা নিরসন জরুরিভাবে প্রয়োজন। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতা বিবেচনায় বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘসূত্রতা বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য হতাশাজনক।

বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অসামান্য অর্জনকে টেকসই করতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পণ্যের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে অধিকতর রপ্তানিমুখী শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে পরিবহন ও লজিস্টিকস খাতে উন্নয়ন জরুরি। অন্যথায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমাদের পণ্যের টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাক খাতে ভিয়েতনামের কাছে আমরা আমাদের অবস্থান হারিয়েছি। পণ্য পরিবহন ও লজিস্টিকস ব্যয় হ্রাস করতে পারলে আমাদের পণ্যের গুণগত মান, পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও শ্রমিকের প্ররিশ্রম এবং সরকারের সহযোগী মনোভাব অবশ্যই বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ রপ্তানি সুযোগ তৈরি হবে যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: শিক্ষক

এ বিভাগের আরো খবর