বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই অভিযোগকে ক্ষমতাসীনদের ‘নতুন গীত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এই ‘গীত’ কি নতুন? এই ‘গীত’ কি আওয়ামী লীগ সামনে এনেছে? অবশ্যই না। খুনি ফারুক ও রশিদ জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে সর্বপ্রথম এই ‘গীত’ পরিবেশন করেছিল।
১৯৭৬ সালের ৩০ মে ‘দ্যা সান ডে টাইমস’-এ খুনি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে ফারুক রহমান দাবি করে-
“খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে ও আমার ভায়রা আব্দুর রশিদ প্রথমে আমার কাছে মুজিবকে সরিয়ে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে বসানোর প্রস্তাব দেন। আমি তাতে রাজি হই ও মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান করার প্রস্তাব দিই। মুজিবকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের পর মোশতাক ও জিয়া আমাদের পরিকল্পনায় সম্মত হন।”
তদুপরি, ওই বছরের আগস্টে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ ইংল্যান্ডের আইটিভি টেলিভিশনে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনাকালে সে সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন, তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গেই থাকবেন।
সাক্ষাৎকারের এ অনুষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য এবং বাইরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক নেভিলে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। সেই সাক্ষাৎকারে ম্যাসকারেনহাসকে তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় উপরের সহযোগিতা পেতে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার আশ্রয় এবং দিকনির্দেশনা দরকার ছিল তাদের। তাই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া জুনিয়র অফিসাররা তৎকালীন আর্মির উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বেছে নেয়। এ বিষয়ে অন্যতম খুনি কর্নেল ফারুক ম্যাসকারেনহাসকে ভিডিও সাক্ষাৎকারে আরও বলে, “আমাদের লিড করার জন্য জেনারেল জিয়াই ছিল মতাদর্শগতভাবে যোগ্যতম ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি।”
তাছাড়া হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জিয়ার সঙ্গে ফারুক-রশীদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে বহুবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের একটি বক্তব্য থেকেও। তিনি বলেন, “একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে জিয়া আরও বলেন- এটি যদি সফল হয় তবে আমার কাছে এসো, আর যদি ব্যর্থ হয় তবে আমাকে জড়িত করো না।”
তাছাড়া গতবছর আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ১৯৭৫: সেটিং দ্যা ক্লক ব্যাক’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন। আলোচনা সভায় তিনি বলেন-
“যারা হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল, তারা জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এগোয়নি। আর জিয়াউর রহমানের পেছনে ছিল আমেরিকা। এই পরম্পরা তদন্তের প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ও আমেরিকা দুই দেশের জনগণ মিলে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় গবেষণা করেছেন লিফশুলজ। ১৫ আগস্টের হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ে ‘An Unfinished Revolution’ নামে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বইও লিখেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ অনুসন্ধানের পর জিয়ার আমলে সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের বিচারের অনুসন্ধানও করেছিলেন এই সাংবাদিক। তখন বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাকে।
একটি মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ককে পরিবারের সব সদস্যসহ নৃশংসভাবে যেভাবে হত্যা করা হলো এবং এর পরের ঘটনাপ্রবাহগুলো বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়, কতটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং কারা কতটুকু সম্পৃক্ত ছিল। হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনকে জানান, “বেলা ১১টা পর্যন্ত অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ সাফল্যের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, ঢাকা বা বাইরে কোথাও কোনো গোলযোগ হয়নি। তবুও আমরা কিছু প্রতিরোধের আশঙ্কা এখনই নাকচ করে দিচ্ছি না। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। বেতার মাধ্যমে সেনা, নৌ, বিমান, বিডিআর ও পুলিশপ্রধানরা সরকারের প্রতি অনুগত থাকতে বিবৃতি প্রচার করেছেন।”
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটিও ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ভয়েস অব আমেরিকা থেকে প্রথম প্রচার করা হয়। অথচ তখনও বঙ্গবন্ধু জীবিত। এর কিছুক্ষণ পর ৬টার কিছু আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রায় ত্রিশ মিনিট আগেই মৃত্যুর খবর প্রচার করা হয়। তাহলে কি ভয়েস অফ আমেরিকা আগে থেকেই জানত ভোর সাড়ে ৫টায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনায় আমেরিকা এবং পাকিস্তানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল বলেই মনে করতেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও। আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরী কিসিঞ্জারের প্রাক্তন স্টাফ অ্যাসিসটেন্ট রজার মরিসও এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে ড. কিসিঞ্জার ও মার্কিন বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যে কিসিঞ্জারের একজন বিশ্বস্ত প্রবীণ সহকারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন।
উক্ত প্রবীণ সহকারী তখন তাকে বলেন, ‘কিসিঞ্জারের আমলে মার্কিন বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তিনটি ‘নেমেসিস’ (গ্রিক পুরাণের প্রতিহিংসার দেবী) ছিল। কিসিঞ্জারের ভাষায় বিদেশি শত্রুর তালিকায় ছিলেন তিন জন ‘সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি’। এই তিনজন হলেন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে, ভিয়েতনামের থিউ এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিব। এরা কিসিঞ্জারের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছেন। মরিসের মতে, ‘অপর দুজনের তুলনায় শেখ মুজিব ভিন্নপর্যায়ে পড়েন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয়ের শামিল ছিল বলে মনে করেন।’
অপরদিকে, হত্যাকাণ্ডের দিন হিসেবে ১৫ আগস্ট তারিখটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের অনুমোদনক্রমে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আর ভারতের সহযোগিতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়লাভকে তারা লজ্জাজনক পরাজয় হিসেবেই নিয়েছিলেন। তাই ভারতের স্বাধীনতা দিবসকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য নির্ধারণ করা হয় প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে। এর পাশাপাশি তারা ভারতকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছিল। সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক অরুণ ব্যানার্জি এ প্রসঙ্গে বলেছেন- নির্দিষ্ট করে এই ১৫ আগস্ট তারিখটা বেছেই নেওয়া হয়েছিল খুব সচেতনভাবে। ভারতের স্বাধীনতা দিবস ওটা, আর ক্যুর ষড়যন্ত্রকারীরা ভারতকেই একটা মেসেজ দিতে চেয়েছিল।
বার্তাটা ছিল এমন, তোমাদের এত খাতিরের লোক- আর তোমাদের বিশেষ দিনে দেখো এই তার অবস্থা। তাছাড়া তাদের আশঙ্কা ছিল, অন্য কোনো দিনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে, ভারত-বাংলাদেশের পঁচিশ বছরের শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। ভারত সামরিক অভিযান চালালে তা সামাল দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী ব্যস্ত থাকবে। এমন একটি দিনে তারা প্রতিবেশী দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তাই কৌশলগত কারণেই এই দিনটিকে চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র হয়েছিল কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট হো চি মিন সরণিতে বসেও। যদিও এই ষড়যন্ত্রের সদর দপ্তর ছিল ওয়াশিংটন ও রাওয়ালপিন্ডিতে। সরকারের বিরুদ্ধে এসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বিভিন্ন সময়ে জানানো হলেও বঙ্গবন্ধু এসবে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তিনি বিশ্বাস করেননি, কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে। এমনকি হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও ‘র’ এর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে অশোক রায়নার ‘ইনসাইড র দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’ গ্রন্থ থেকে আরও জানা যায়, ‘বেগম জিয়ার বাড়ির ট্রেস থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ক্যু-এর একটি স্ক্রাপ পেপার উদ্ধার করা হয়েছিলো হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে। কাগজটি গার্বেজ করা হলেও একজন গুপ্তচর গৃহভৃত্যের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য ‘র’-এর পরিচালক রামনাথ কাউ ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে বাংলাদেশে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করলেও বঙ্গবন্ধু সেটাকে যথারীতি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ওরা আমার সন্তানের মতো। কাউ হতাশ হয়ে দিল্লি ফিরে যান। সেই চিরকুটে জিয়াউর রহমান, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, জেনারেল ওসমানী এবং মেজর শাহরিয়ায়ের নাম ছিলো।
‘র’ ১৯৭৫ সালে সর্বশেষ আরেকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে দিল্লি থেকে ঢাকা পাঠায়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এই সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রই কেবল দেননি, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া ছাড়াও আর কারা কারা জড়িত তাদের নামও তার কাছে প্রকাশ করেন। কিন্তু ফলাফল এবারও একই। তবে বঙ্গবন্ধু জিয়াকে মার্চে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করেন এবং এটি নির্ধারিত হয় যে জিয়া কোনো একটি দেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে চলে যাবেন। কিন্তু অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার মাধ্যমে তার বদলির আদেশটি বাতিল করাতে সক্ষম হন জিয়া।
এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসাজশের আরও একটি অকাট্য প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কিছু সময় পরে ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কজন কর্মকর্তা নিয়ে দ্রুত বৈঠকে মিলিত হয়। নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন সভায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বলেন, ‘এটা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে আরও ভালো খবর পেয়েছি। তিনি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াশিংটনে আগেই কথা বলেছিলেন।
কিসিঞ্জারের ভালো খবর হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। তাছাড়া স্ট্যানলি উলপার্ট তার গ্রন্থে মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর জড়িত থাকার দলিলপত্রও হাজির করেছেন। ১৯৭৫ এর জুনে কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ভুট্টো বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ স্ট্যানলি উলপার্ট আরও লিখেছেন, দু’বছর যাবৎ ভুট্টো বাংলাদেশের কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তার গোপন ‘ স্বেচ্ছাধীন তহবিল’ থেকে অর্থ সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং আগস্ট (১৯৭৫) শেষ হওয়ার আগেই তিনি তার বিনিয়োগের ফল লাভ করেন। এ হত্যাকাণ্ডটি মূলত ছিলো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের একটি ধারাবাহিকতার সাফল্য।
তাছাড়া মার্কিন সাংবাদিক লিফশুলজ তার গ্রন্থে বহু দলিলপত্রভিত্তিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, লেডিস ক্লাবের তুচ্ছ ঘটনার জের হিসেবে শেখ মুজিব নিহত হননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, বহু আগেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুজিব হত্যাকারীরা যোগাযোগ স্থাপন করে। ওই গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভেতরে মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, এবিএস সফদার ছিলেন তখন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর মুখ্য এজেন্ট। সফদার যুক্তরাষ্ট্রে সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। খন্দকার মোশতাককে বিভিন্ন সময়ে তারা প্রলুব্ধ করেছেন।
লিফশুলজ ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সিআইএর তত্ত্বাবধানে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেন জিয়া। জিয়ার সহযোগিতা ছাড়া ওই হত্যাকাণ্ড ঘটতই না। জিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কর্নেল রশীদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন এবং রশীদকে সব সময় আশ্বস্ত করেন যে, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন।’ ১৯৭৭ সালে ইউরোপের একটি শহরে অভ্যুত্থানের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগ সম্পর্কে লিফশুলজকে লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ বলেন, জিয়াই আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে এবং অন্য কোনো তরফ থেকেও কোন বাধা আসবে না। এসব বিষয় জিয়াই দেখবেন বলে জানান রশীদ। কিসের ভিত্তিতে জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেন, এ প্রশ্নের জবাবে রশীদ বলেন, তিনি পরিষ্কার জানতে পেরেছিলেন যে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে জিয়ার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তবে তিনি ওই কর্মকর্তার নাম জানেন না।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর সম্পৃক্ততার আরেকটি প্রমাণ মেলে হত্যাকাণ্ডের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার একটি বাসায় সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরির সঙ্গে জিয়াউর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে। চেরির বিশেষ আগ্রহে তৃতীয় পক্ষের একজনের বাড়িতে হয় সেই বৈঠকটি। সেখানে একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন সস্ত্রীক জিয়াউর রহমান। উপর মহলের কারো সম্মতি না থাকলে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের কারো সঙ্গে ওই সময়ে চেরির বৈঠকে বসা কিংবা কথা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চেরি নিশ্চয়ই ওয়াশিংটন কিংবা ল্যাংলিতে সিআইএ সদর দপ্তরের নির্দেশমতো কাজ করছিল তখন। ওই দিনের ঘটনার বিবরণের ভিত্তিতে লিফশুলজ দাবি করেন, জিয়া এবং চেরি একে অপরকে আগে থেকেই চেনেন বলে মনে হচ্ছিল।
তার ভাষ্য মতে, সেই রাতে ডিনারের আগে এবং পরে দীর্ঘ সময় ধরে চেরি-জিয়ার মাঝে নিমন্ত্রণকর্তার বাসার বাগানে বসে আলাদাভাবে কথোপকথন চলে। ওই সময়ে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হতে পারে তা নিশ্চয়ই একজন সচেতন মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ, জিয়া-চেরির সেই ডিনার কোনো সামাজিকতা সৌজন্যতামূলক সাক্ষাৎ ছিল না। চেরি ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে হলে জিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। লিফশুলজ তার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মন্তব্য করেন যে, প্রমাণ ক্রমবর্ধমানভাবে এই ইঙ্গিত দেয় যে জিয়া অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন এবং খোন্দকার মোশতাক আহমেদের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
সোজা কথায়, হাজার হাজার মাইলের পথ দূর থেকে কিসিঞ্জার-ভুট্টো আর ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত বোস্টার এবং সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি মুজিব হত্যাকাণ্ড সরাসরি তদারকি করেছেন। এদের সহায়তায় কৌশলে পেছন থেকে মূল ভূমিকাটা পালন করে গিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া। তিনি বিরোধিতা করলে এই অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভবই ছিল না কোনোদিন। তা না করে উলটো তিনি অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া অফিসারদের বিভিন্ন সময়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। প্রকাশ্যে কিছু না করলেও মূলত তিনিই ছিলেন নাটের গুরু। তদুপরি, বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণও এটা নির্দেশ করে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ‘নতুন গীত’ নয়। এটা বহু আগে থেকেই দালিলিকভাবে প্রমাণিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।