বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে হামলা ও গুলির ঘটনায় পুলিশ এবং ইউএনও বাদি হয়ে যে দুটি মামলা করেছেন, তাতে মো. নাদের নামে একজনকে আসামি করা হয়েছে, যিনি মারা গেছেন অনেক বছর আগে। খোদ প্রশাসনের দায়ের করা মামলায় একজন মৃত ব্যক্তি কী করে মামলার আসামি হন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শুধু তাই নয়, ঘটনার সময় চিকিৎসার জন্য ঢাকায় অবস্থানকারী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাককেও আসামি করা হয়েছে পুলিশের মামলায়। একজন মৃত ছাত্রলীগ নেতার বাসায়ও পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা অব্যবহৃত ব্যানার, পোস্টার পরিষ্কার করতে ইউএনওর বাসায় গেলে তাদেরকে বাধা দেয়া হয়। এরপর ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করতে প্যানেল মেয়র সেখানে যান এবং বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ইউএনওর বাসায় হামলা চালানো হয়। পরে সেখানে উপস্থিত আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে। পরিচ্ছন্নতা অভিযানকে কেন্দ্র করে ইউএনওর সরকারি বাসভবনে একদল মানুষ হামলা চালায়। পরে এ নিয়ে মামলা হয় এবং পুলিশ একজন কাউন্সিলরসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে যারা মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী বলে পরিচিত।
এই ঘটনার জের ধরে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বরিশালের মেয়রের গ্রেপ্তারের দাবি জানায়। তবে অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে যে ধরনের আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।
জনকর্মচারীরা এরকম ভাষা ব্যবহার করতে পারেন কি না—তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, শুধুই কি পোস্টার সরানো নিয়েই প্রশাসন ও মেয়র মুখোমুখি হলেন নাকি এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধ এবং প্রশাসনের সঙ্গে তাদের অন্য কোনো বড় ধরনের ঝামেলা আছে—যার ফলে গোলাগুলি এবং খোদ সিটি মেয়রকে এক নম্বর আসামি করে প্রশাসনের তরফে দুটি মামলা দেয়া হলো?
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি থানার ওসি এবং ইউএনওর বাসভবনে দায়িত্বরত আনসার সদস্যসহ ৩০ থেকে ৪০ জনের নামে আদালতে দুটি মামলার আবেদন করার পরে দৃশ্যপট বদলে যায়। দুপক্ষকে নিয়ে সমঝোতায় বসেন বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার এবং তাদের মধ্যে মিটমাট হয়ে গেছে বলে জানানো হয়।
প্রশ্ন হলো, কী কী শর্তে এই ‘মিটমাট’ হলো এবং যদি মিটমাটই হবে, তাহলে ইউএনওর বাসায় হামলা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে গুলি ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? যেহেতু এখানে একাধিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে— ফলে এসব অপরাধের বিচার হবে কী করে? যদি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও এরকম ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারপর মিটমাট হয়ে যাবে। যার মধ্য দিয়ে আসলে মূল ঘটনা আড়ালেই থেকে যাবে। অপরাধের পথ বন্ধ হবে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না।
দুই.
দেশের পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া, বিশেষ করে মামলা, আটক, গ্রেপ্তার, জামিন এবং ক্ষমতাবানদের মামলা খোদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে প্রশ্নের অন্ত নেই। চিত্রনায়িকা পরীমনির জামিন ইস্যুতে যা হচ্ছে, তা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বাসায় কয়েক বোতল মদ পাওয়া গেছে— এই অভিযোগে গ্রেপ্তারের পরে তাকে একাধিকবার রিমান্ডে নেয়া হয় এবং তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে অনেক বড় বড় অপরাধীও জামিনে বেরিয়ে যান, সেখানে কয়েক বোতল মদ পাওয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় কেন পরীমনির জামিন হচ্ছে না?
উপরন্তু তাকে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার পথে যে বিশাল পুলিশের বহর দেখা যায়, যেভাবে তাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ কর্ডন করে নিয়ে যায়, সেই দৃশ্য দেখে যে কারো মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পরীমনি কোনো বড় মাপের সন্ত্রাসী কি না? পরীমনির মুক্তির দাবিতে জাতীয় জাদুঘরের সামনে শিল্পীদের একটি মানববন্ধন কর্মসূচিতে অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, বার বার রিমান্ডের নামে পরীমনির মতো একজন ‘সুন্দরীকে’ ছুঁয়ে দেখাও হয়তো কারো উদ্দেশ্য হতে পারে।
প্রশ্ন উঠেছে, পরীমনি কি রাষ্ট্রের কোনো এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী ব্যক্তির রোষানলে পড়েছেন অথবা তিনি কি তাদের সম্পর্কে এমন কোনো স্পর্শকাতর তথ্য দিয়েছেন, যা আরও বিস্তারিতভাবে জানা প্রয়োজন? রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশ কি পরীমনিকে জেলে রাখাই নিরাপদ মনে করছে?
পরীমনির বিরুদ্ধে আনীত অফিসিয়াল অভিযোগগুলো খুব গুরুতর নয়। বলা হচ্ছে যে, বাসায় মদ পাওয়া গেছে। প্রশ্ন হলো, তিনি কি মাদকের ব্যবসা করতেন বা তিনি কি জোর করে কাউকে মাদক সেবন করাতেন? সুতরাং, বাসায় মাদক পাওয়া গেছে—এই অভিযোগে করা মামলায় তার জামিন না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তাছাড়া তিনি একজন নারী এবং আদালতে বলেছেন যে, তিনি অসুস্থ। কিন্তু তারপরও জামিন হয়নি। তার বিরুদ্ধে কী এমন গুরুতর বা ঘোরতর অভিযোগ যে, তিন দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলো? রিমান্ডে কী হয়— তা দেশবাসী জানে। রিমান্ডের বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে তা থোড়াই কেয়ার করে, তাও দেশবাসীর অজানা নয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরীমনিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদনে বলেছেন, ‘পরীমনি মামলার বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাই তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখা প্রয়োজন। কারণ তাকে জামিন দিলে তিনি বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারেন ও পালিয়ে যেতে পারেন।’
প্রশ্ন হলো, জামিন পেলেই পরীমনি যদি পালাতে পারেন, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করবে? তিনি মামলার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলেই তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে রাখতে হবে এবং তিনি জামিনে বের হলে যে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই বিঘ্ন সৃষ্টির অর্থ কী? পরীমনির সঙ্গে রিমান্ডে এবং তার সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কী কী করেছেন, সেগুলো পরীমনি বলে দেবেন?
তিন.
পরীমনি কতটুকু অপরাধী এবং আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো কতটা প্রমাণ করা যাবে— তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটা ঠিক যে, রাষ্ট্রপক্ষ যে মামলার বাদী হয়, সেখানে আসামিপক্ষের সুবিধা-অসুবিধা দুটিই থাকে। যেমন যদি আসামি প্রভাবশালী হন, তাহলে মামলা থেকে আসামির অব্যাহতি পাওয়া সহজ। আবার যদি আসামি প্রভাবশালী না হন, কিংবা প্রভাবশালী হলেও তার চেয়েও প্রভাবশালী কেউ তার বিরুদ্ধে থাকেন, তাহলে তার পক্ষে অব্যাহতি দূরে থাক, জামিন পাওয়াও কঠিন। পরীমনির ক্ষেত্রে সম্ভবত এই ঘটনাটিই ঘটছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, পুরান ঢাকার আলোচিত সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিলেও এই মামলায় পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। প্রশ্ন হলো, কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে ইরফান সেলিমের বাসা থেকে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি, বিদেশি মদসহ ইরফানকে গ্রেপ্তার এবং তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজা দেয়ার পরেও এই মামলায় তাকে কী করে অব্যাহতি দেয়া হলো?
র্যাব তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সাজা দিয়েছিল কীসের ভিত্তিতে? র্যাবের অভিযানটি কি তাহলে সঠিক ছিল না বা যে অপরাধে সাজা দেওয়া হয়েছিল সেটি কি মিথ্যা? অভিযানের দিন যে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি ও বিদেশি মদ উদ্ধারের দাবি করা হলো এবং যেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলো, তা কি ভুল? তাহলে সেই অস্ত্র ও মাদক কার?
পুলিশ বলছে, মামলায় মাদক ও অস্ত্রে ইরফানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তথ্যগত ভুল ছিল। সে কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তার অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পুলিশের এই দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে ইরফানকে আড়াই মাস জেল খাটতে হলো কেন? সুতরাং ইরফান সেলিমকে অব্যাহতির পেছনে যে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো চাপ ছিল, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
আসামি নারী হোন আর সামাজিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই হোন, তাকে বার বার রিমান্ডেও নেয়া যায়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে আসলে কোন ঘটনার পেছনে কে আছেন এবং সেখানে টাকা ও ক্ষমতার প্রভাব কতটুকু কাজ করছে। ফলে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে যে সকল নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলা হয়েছে, সেটি নিতান্তই কেতাবি কথা কি না— সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।