বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সত্তরের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু

  • গোলাম শফিক   
  • ১৫ মার্চ, ২০২১ ১১:০৩

বঙ্গবন্ধুকে নিস্তার পার্কে নেয়ার পর উপস্থিত সবাই স্লোগানে ফেটে পড়লেন। স্লোগানটি ছিল অভিনব: নুহ্নে লায়াহে কিস্তি ওসমে সওয়ার হোকে আয়াহে শেখ মুজিব, অর্থাৎ নুহ্ (আ.)-এর কিস্তিতে চড়ে এলেন শেখ মুজিব।

মোহাম্মদ নূরুন্নবী ফেনীর সোনাগাজীর সন্তান। বর্তমানে মিরপুরের কালসিনিবাসী। স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সে সময় রেডিওর খুচরা যন্ত্রাংশের প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। মারীপুর এয়ারবেসের সামনে ছিল এর অবস্থান, যার সেকশন সুপারভাইজার ছিলেন আজকের এই ৭৭ বছরের নূরুন্নবী। তখন পশ্চিম পাকিস্তান শ্রমিক লীগের তিনি প্রচার সম্পাদক। একাত্তর সালে হন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা।

পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনি প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ বিষয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য সরবরাহ করলেন। তা ছাড়া তুলে ধরলেন সত্তরের নির্বাচনোত্তর ও স্বাধীনতাপূর্ব কিছু ঘটনা এবং সমাজ বাস্তবতার চিত্র। নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন, পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার কী রাজনৈতিক অবস্থান ছিল এবং বাঙালিদের সঙ্গেই-বা তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল। পাঞ্জাবি ছাড়া অপরাপর জাতিসত্তাসমূহ বাঙালিদের ভালোইবাসত। তারাও ছিল আমাদের মতোই শোষণের শিকার। সিন্ধি জুলফিকার আলী ভুট্টো একদা যেমন ছিলেন কিছু বাঙালির বন্ধু, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের পাঠান গভর্নর আজম খানও ছিলেন। তবে তিনি কেবল বাঙালিদের নয়, সকল মানুষকেই ভালোবাসতেন। পাঠানদের অধিকাংশই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান পাস্তুনখোয়া)-এর বাসিন্দা। পাঠান শেরখান পাঞ্জাবিদের ঘোরবিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতাও। একমাত্র ব্যতিক্রমী পাঞ্জাবি ছিলেন আইসিএস কর্মকর্তা ও প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব খোরশেদ, যিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। সত্তরের নির্বাচনে পাঞ্জাবের কোনো এক আসন থেকে লড়ে তিনি হেরে যান। উল্লেখ্য, ‘আওয়ামী’ শব্দটি উর্দু যার অর্থ ‘জনগণের’। তখন আওয়ামী লীগের একটি অফিস ছিল করাচির ভিক্টোরিয়া রোডে।

নূরুন্নবী জানালেন, সত্তরের নির্বাচনে মোট ১৩টি আসনে আওয়ামী লীগের নেতারা (কজন পশ্চিম পাকিস্তানিসহ) নির্বাচন করেছিলেন। কয়েকটি আসনে তাদের জেতার উজ্জ্বল সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু পিপিপির নেতারা তা ভণ্ডুল করে দেয়। সর্বত্রই বাঙালিদের বিরোধিতায় পাঞ্জাবিদের সহায়ক ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিহারি। তবে আইয়ুব খান পাঠান হলেও বাংলাবিরোধিতা তার মধ্যে ছিল।

বেলুচিস্তানের বালুচরা হয়তো ইচ্ছের বিরুদ্ধেই এদেশে যুদ্ধ করেছিল। তাদের মিথ্যা বলে, প্রলোভন দেখিয়েই পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। তবে একদল বালুচ সৈন্যের কাছে এ মিথ্যা ধোপে টেকেনি। তাদের বলা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে সব হিন্দু হয়ে গেছে, তোমরা গিয়ে ওখানে কোনো মুসলমান অবশিষ্ট পাবে না। কিন্তু দলটি ঢাকা বিমানবন্দরে এসে ভোর বেলায় শুনতে পায় আজানের ধ্বনি। তখনই সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাবে এবং কথিত যে, তাদের অধিকাংশই বিমানবন্দর থেকেই ফিরে গিয়েছিল। এভাবে অনেকের অস্বীকারের পরিপ্রেক্ষিতে পরে মিলিশিয়া বাহিনী প্রেরণ করা হয়। পাঞ্জাবি সৈন্যরা যেমন যোদ্ধা হিসেবে নাম কামিয়েছিল, তেমনি তাদের মিথ্যার বেসাতিও জগৎজোড়া কুখ্যাতি পেয়েছিল। এমনই এক জাতিগত বাস্তবতায় সত্তরের নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করায় অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।

এই যে সত্তরের নির্বাচন তাতে পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছিল, যেমন ছিল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-এর অংশগ্রহণ। তাতে কেবল নূরুল আমিনই পিপিপি থেকে একটি আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নিজে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচারণায় নেমেছিলেন। সেটি ছিল এক সুন্দর দিন যেদিন তিনি করাচি বিমানবন্দরে নেমে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়েছিলেন। ওখান থেকে গাড়িতে করে তাকে নিয়ে আসা হয় মেকলার রোডের হোটেল বিসলাক্সারিতে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহহিয়া খান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাকে রাখার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তার থাকা-খাওয়া ও যানবাহনের ব্যবস্থা করেছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু ইউসুফ হারুন। হোটেলটিও তারই ছিল। তিনি নাকি ২২ পরিবারের একজন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান। সেদিন নিস্তার পার্কে অনুষ্ঠিত জনসভায় আরও উপস্থিত হন ফেনীর কালীদহের ওলি মাহমুদ চৌধুরী যিনি ওই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের জন্য শেরশাহ্ কলোনি-গুলিমার এলাকার নির্বাচনি প্রার্থী হন (একই এলাকার জাতীয় পরিষদ প্রার্থী ছিলেন শেখ মঞ্জুরুল হক দিল্লিওয়ালা)।

বঙ্গবন্ধুকে নিস্তার পার্কে নেয়ার পর উপস্থিত সবাই স্লোগানে ফেটে পড়লেন। স্লোগানটি ছিল অভিনব: নুহ্নে লায়াহে কিস্তি ওসমে সওয়ার হোকে আয়াহে শেখ মুজিব, অর্থাৎ নুহ্ (আ.)-এর কিস্তিতে চড়ে এলেন শেখ মুজিব। সেদিন পুরো বক্তৃতাই বঙ্গবন্ধু উর্দুতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ বক্তৃতা সেদিনকার শ্রমিক লীগ নেতা, আজকের বয়োবৃদ্ধ নূরুন্নবীর মনে নেই। কিছু চমকপ্রদ প্রশ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিগুলো তিনি মনে করতে পারেন। মঞ্চে উপবিষ্ট কামারুজ্জামানকে বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন- কামারুজ্জামান, মাস্টার্ড ওয়েল কো ক্যায়া বোলতাহে (কামারুজ্জামান, সরিষার তেলকে কী বলা হয়)?

কামারুজ্জামানের জবাব ছিল: ‘ভাইয়া, হাম নেহি জানতা। খলিল আহমেদ তিরমিজী সে পুছলেতা।’ কামারুজ্জামান নিজে জবাবটি জানতেন না বিধায় তার পাশে বসা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ প্রার্থী (লান্ডি এলাকা) খলিল আহমেদ তিরমিজির কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন বলে জানালেন। অতঃপর তিরমিজির কানে কানে কিছু বলে তিনি মুখ খুললেন: তিরমিজি নে বোলা, সসসো কা তেল বোলতা (তিরমিজি বলছেন, এটাকে সরিষার তেল বলা হয়)।

তখনই বঙ্গবন্ধু কথাটি লুফে নিয়ে বললেন, ইহাকা লোক একলা ফস বাংলা নেহি বলসাকতা। হাম লোক উর্দু টুটাফুটা জো জানতা, চালাইয়ে লেতাহে (এখানকার লোকজন বাংলা একদমই জানে না, আমরা উর্দু যৎসামান্য যা জানি তাতে কাজ চালিয়ে নিতে পারি)। এ কথা বলেই তিনি আবার ফিরে আসেন সরিষার তেল প্রসঙ্গে। এ পর্যায়ে বলেন, ‘ইহাপর দাই রুপেয়া, হামারা মুল্লুক মে সাড়ে তিন রুপেয়া, কায়কো? একই পাকিস্তান (এখানে সরিষার তেল দু’ টাকা, আমাদের দেশে সাড়ে তিন টাকা, কেন? অথচ একই পাকিস্তান)।’ দুই দেশের অর্থনীতিতে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে, বঙ্গবন্ধু এসব কথাই ওখানে দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন। এ বৈষম্যের কথা বলে বলেই তিনি গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। সে মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মৌলিক চাহিদা চালের কথা তিনি বিস্মৃত হননি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ইহাপর চাউল কা কিম্মাত চার আনা ছে আনা, হামারা মুল্লুক মে দশ আনা, কায়কো? একই পাকিস্তান হ্যায়। (এখানে চালের সের চার আনা ছয় আনা, আমাদের দেশে দশ আনা, কেন? একই পাকিস্তান যে)।’

এরপর বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তায় ও দক্ষতায় অনর্গল বলে যেতে থাকেন। সব কথা নূরুন্নবীর মনে নেই। তবে তিনি যে পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের বৈরী সম্পর্ক, ১৯৬৫ সালে সংঘটিত যুদ্ধের স্মৃতি এবং বর্তমান টানাপোড়েনের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তা স্পষ্ট মনে করতে পারেন। এ পর্যায়ে নেতা বললেন, ‘হামারা মুল্লুক মে হাওয়াইয়া জাহাজ নেহি হ্যায়... আউর এক পোস্টকার্ড ভি নেহি হ্যায়, কেয়া সে ইন্ডিয়া কি সাথ লড়েঙ্গা। সব কুস পশ্চিম পাকিস্তান মে হ্যায় (আমাদের দেশে উড়োজাহাজ নেই...এমনকি একটি পোস্টকার্ডও নেই, কীভাবে ভারতের সঙ্গে লড়া যায়? সব তো পশ্চিম পাকিস্তানে)।’

৬ দফা ঘোষণার পর থেকে বঙ্গবন্ধু যে কেবল বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাঙালির অধিকারের কথা বলে বেড়াতেন তাই নয়, খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেও তিনি একই সুরে কথা বলে সেদিনকার জনসভার মানুষদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন।

ওদিকে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়তে থাকে। নিস্তার পার্কে উপস্থিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিরা আবার স্লোগানে ফেটে পড়ল: নুহ্নে লায়াহে কিস্তি ওসমে সওয়ার হোকে আয়াহে শেখ মুজিব। শেখ মুজিব কী, জিন্দাবাদ! জনসভা শেষ করে তিনি যেন নুহের কিস্তিতে চড়েই আবার অন্তর্হিত হন। এখন ভাবছি সত্তরের নির্বাচনে আমরা যুব-কিশোররা কতই না শ্রবণ-মনোহর স্লোগানে স্লোগানে ফেটে পড়তাম। কিন্তু এমনতর অভিনব স্লোগান শুনিনি।

নুহ্ নবীর নৌকার স্মৃতি সকল মুসলমানেরই পবিত্র উত্তরাধিকার। সেদিন এ ঐতিহাসিক স্মৃতিকে নির্বাচনি মার্কার সঙ্গে মিলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এটিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করেছিল।

অতঃপর নূরুন্নবীকে জিজ্ঞেস করি, বঙ্গবন্ধু আর কোথায় গেলেন? শুনেছি আরও অনেক স্থানে সভা করেছিলেন লাহোর, কোহাট, ফ্রন্টিয়ারের বেশ কিছু স্থান, হয়তো আরওি কত… কিন্তু নিস্তার পার্কের সেই স্মৃতি আজও আমাকে অনাবিল সুখ সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ‘নুহ্নে লায়াহে কিস্তি ওসমে সওয়ার হোকে’...

লেখক: এনডিসি, কবি-নাট্যকার, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

এ বিভাগের আরো খবর