বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হোক

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২৪ আগস্ট, ২০২১ ১৫:৪৫

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল-সমাজ এবং রাষ্ট্রে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা না গেলে ওদের অনুসারীরা হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করতে পারে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমাদের আছে, সেটাও নষ্ট করতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এর পরের অধ্যায় হচ্ছে, নেপথ্যে কারা ছিল, এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে কারা জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করা।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। নানা বাধা-বিপত্তি, দীর্ঘসূত্রতা অতিক্রম করে বিচারিক আদালতে অবশেষে বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচারের রায় হয়। রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কজনকে ফাঁসি দেয়া হয়।

প্রশ্ন হলো দণ্ডপ্রাপ্ত এই বারোজন সেনা-সদস্যই কি কেবল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল? মোটেও তা নয়। এর পেছনে অনেক বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। যাদের সাজা হয়েছে, তারা কেবল সম্মুখভাগে থেকে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। আদালতের রায়েও হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিল। সেই ষড়যন্ত্রকারী কারা? কারা নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছিল? রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে কারা এই ঘৃণ্য চক্রান্তে জড়িত ছিল?

না, তাদের চিহ্নিত করে জনসম্মুখে নাম প্রকাশের বিষয়টি এই দীর্ঘ ৪৬ বছরেও করা হয়নি। এমনকি সামরিক বাহিনীর প্রত্যেকের ভূমিকারও যথাযথ মূল্যায়ন করে দেখা হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সেনাকর্তাদের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধানও হওয়া দরকার। কেবল ফারুক-রশীদ-ডালিম-হুদা-নূর-মুসলেহউদ্দীনসহ দশ-বারোজন মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের সেনাকর্মকর্তার দায় নয় ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড। যারা ১৫ আগস্টে ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেনা শৃঙ্খলা ও নির্দেশের বাইরে গিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কেন ঊর্ধ্বতনরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? মেজর ডালিম, নূররা কীভাবে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকেছিল? সব কিছু জেনেও শফিউল্লাহ-জিয়া-খালেদ মোশাররফ কেন চুপ ছিল? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া দরকার।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল মূলত একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ। যারা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে, তাদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফল হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং পাকিস্তানের ভুট্টো বঙ্গবন্ধুহত্যা ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের প্রতি তার (কিসিঞ্জার) ঘৃণার কথা স্বীকার করেছেন। মরিস জানিয়েছেন-

“শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর।” (বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন, লরেঞ্জ লিফসুলজ পৃ. ১৩৬-১৩৮)।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হন পাকিস্তানের ভুট্টো। ১৫ আগস্ট মুজিব হত্যার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বাংলাদেশের খুনি সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় খুশিতে ডগমগ ভুট্টো তাৎক্ষণিকভাবে খুনি মোশতাক সরকারকে ২ কোটি ডলার মূল্যের ৫০ হাজার টন চাল ও দেড় কোটি গজ কাপড় দেয়ার কথা ঘোষণা করে।

আমেরিকা-পাকিস্তানের দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্ব কিসিঞ্জার-ভুট্টো বাংলাদেশের ক্ষমতালোভী কিছু নরপিশাচকে দিয়ে খুব সহজেই ইতিহাসের নির্মমতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে বরখাস্ত করে খুনি চক্র জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন মাসের মাথায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। অনেকেই মনে করেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানই মূল নায়ক। অতি চালাক, উচ্চাভিলাষী, অতি ধুরন্ধর এই ব্যক্তিটি কেবলই সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা’র বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত এই জেনারেল ধাপে ধাপে পৌঁছেছেন ক্ষমতার শীর্ষে। তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, তিনি কোনো অপকর্মেরই প্রমাণ রাখেননি।

বিবিসির সৈয়দ মাহমুদ আলী তার ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ’ বইয়ের ১১১ পৃষ্ঠায় বলেছেন- মূল ষড়যন্ত্রকারী মেজর ফারুক জিয়াউর রহমানের কাছে ২০ মার্চ, ১৯৭৫ অভিযানের নেতৃত্ব কামনা করেন। তিনি তাতে অসম্মত হন কিন্তু মেজরদের থামানোর চেষ্টা তিনি করেননি। ‘এনাটমি অব আ ক্যু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ জানিয়েছেন- বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের অনেক আগে থেকেই জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। জিয়া তাদের বলেছিলেন- “একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে এতে আমার যোগ দেওয়া সম্ভব নয়, তবে তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চাও, করো। আমি বাধা দেবো না।” এই যে সবুজ সংকেত, এটাই ছিল ফারুক-রশীদদের জন্য আশীর্বাদ। অর্থাৎ জিয়া পুরো পরিকল্পনা জানতেন। কিন্তু এতে সরাসরি জড়াতে চাননি। বরং নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর ওপর ক্ষুব্ধ অফিসারদের সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ভূমিকাও রহস্যময়। সে সময় সেনাবাহিনীর তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যে ট্যাঙ্ক ১৫ আগস্ট ব্যবহার করা হয়, সেই ট্যাঙ্কে কোনো গোলা-বারুদ ছিল না। ওই সব গোলার চাবি ছিল সিজিএস খালেদ মোশাররফের কাছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ১৫ আগস্ট ১২টার মধ্যেই খুনিচক্রকে ট্যাঙ্কের গোলা সরবরাহ করেন।

১৫ আগস্ট ব্রিগেডিয়ার খালেদ ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলের অফিসিয়াল চেয়ারে বসে সারাদিন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। শাফায়াত জামিল বলেছেন, ১৫ আগস্ট তার চেয়ারে তিনি এক মিনিটের জন্যও বসতে পারেননি। শাফায়াত জামিল তার লেখা ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ শীর্ষক গ্রন্থে দাবি করেছেন, সেনাপ্রধানের নির্দেশেই খালেদ ৪৬ ব্রিগেড নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যদিও শফিউল্লাহ বলছেন, তিনি এমন কোনো নির্দেশ দেননি।

এ সময় এরশাদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান ও উপসেনাপ্রধান বানিয়ে এটাই জানান দেয়া হয় যে, প্রথমে জিয়া এবং এরপর এরশাদকে ক্ষমতায় আনা হবে। জে. জিয়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ দখলের পর এরশাদকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন।

১৯৮১ সালে জিয়া-মঞ্জুরকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন এরশাদ। আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল লক্ষ্য ছিল একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তানে’ পরিণত করা। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া তাদের ২৫ বছরের শাসনামলে এই কাজটিই করে গেছেন।

যদি ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা সেদিন চেইন অব কমান্ড রক্ষার মাধ্যমে সংবিধান সমুন্নত রাখতেন, তাহলে মোশতাক, সায়েম, জিয়া, এরশাদ চক্র ১৫ বছর অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখতে পারত না। বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার বিচারক ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, কর্নেল শাফায়াত জামিলসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। রায়ে বলা হয়-

“এই ঘটনা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলংক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে” (বঙ্গবন্ধু হত্যা-সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার দালিলিক প্রমাণ : জাহিদ নেওয়াজ খান)।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পৈশাচিক ভূমিকা পালনকারী হিসেবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কথাই বার বার সামনে চলে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যামামলায় যাদের শাস্তি হয়েছে, তারা মূলত আত্মস্বীকৃত খুনি। তবে এ ঘটনার ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে তদন্ত কিংবা বিচার হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল-সমাজ এবং রাষ্ট্রে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা না গেলে ওদের অনুসারীরা হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করতে পারে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমাদের আছে, সেটাও নষ্ট করতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে।

এর পরের অধ্যায় হচ্ছে, নেপথ্যে কারা ছিল, এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে কারা জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করা। ইতিহাসের স্বার্থে নেপথ্যের শক্তিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আর শুধু ১৫ আগস্ট নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ৩ নভেম্বর জেলহত্যা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের শক্তিশালী তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। সে সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ভূমিকা কী ছিল, সেসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করে সমন্বিতভাবে একটা প্রতিবেদন তৈরি করা দরকার।

ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে কবর দেয়ার স্বার্থে, জাতির পিতার রক্তঋণ শোধ করার তাগিদেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন হওয়া দরকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক-সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর