বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জাতির পিতার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়  

  • রণেশ মৈত্র   
  • ২৩ আগস্ট, ২০২১ ১৪:২৯

বেতার টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেরকে ‘সূর্য সন্তান’ বলে অভিহিত করলেন। আর শেখ মুজিব ইসলাম ধ্বংস করতে উদ্যত হওয়ায় তাকে হত্যা করা ব্যতীত ইসলাম রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলে উল্লেখ করলেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকারীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না এমন বিধান রেখে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেন এবং খুনিদেরকে বিদেশে বাংলাদেশের নানা দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতও করেন এই মোশতাক।

একটি জাতির পিতা গোটা জাতির সর্বাধিক অমূল্য সম্পদ। পিতার প্রতি শ্রদ্ধা, তার আদর্শ অন্তরে ধারণ করা এবং তা সযতনে লালন ও বাস্তবায়ন করা যেকোনো জাতির জীবনের এক অপরিহার্য। পৃথিবীর নানা দেশের দিকে তাকালে আমরা এর বেশ কিছু নজির দেখতে পাই। আবার বিপরীত সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।

বঙ্গবন্ধু তর্কাতীতভাবে বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ। তার ধারাবাহিক অবদান আমাদের মহামূল্যবান স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সীমাহীন প্রেরণা। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় দেশ-বিদেশে তা স্বীকৃত পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ অবশ্য নানাভাবে ঐতিহাসিক এই সত্যটিকে বার বার বিকৃত করতে চেয়েছে, নানাভাবে দীর্ঘদিন যাবত সে অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। তারা বলতে চেয়েছে, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন এবং তার উপস্থিতি ব্যতিরেকেই যেহেতু নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তাদের অবর্তমানেই ওই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেই হেতু তিনি বাঙালি জাতির পিতা হতে পারেন না।

এ বক্তব্য যে উদ্দেশ্যমূলক এবং পাকিস্তান ফিরে পাবার আশায় উন্মাদ নানা মহলের উদ্দেশ্যমূলক ভাবনার প্রকাশ মাত্র-তা বুঝতে কারো বেশি একটা সময় লাগেনি। ক্ষমতায় এসে এমন প্রচার করায় কিছু সংখ্যক মানুষ সাময়িকভঅবে বিভ্রান্ত হলেও ইতিহাস তার নিজের শক্তিতেই সে বিভ্রান্তি দূর করেছে।

যারা এ জাতীয় অপপ্রচার বা বিভ্রান্তির শিকারে কোনোদিনই সামান্যতম প্রভাবিত হননি, জাতির পিতার অকাল এবং নির্মম হত্যাকাণ্ড বা ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে- তা ভাববার সময় নিশ্চয়ই এসেছে।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। আগস্ট শোকের মাস। এই মাসে ৪৬ বছর আগে একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাৎক্ষণিক আমরা কতটা কী করেছি-তাও অপরিহার্যভাবে ভাবার বিষয়। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবার বিষয়টি হলো- এই মৃত্যু কি অবধারিত ছিল বা অপ্রতিরোধ্য ছিল? এর উত্তরে এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা সম্ভব হলেও তা অনুচিত। কারণ তাতে পূর্ণাঙ্গ সত্য মানুষের সামনে অনুপস্থিত থেকে যাবে।

এই আলোচানায় এটা উল্লেখ করা অপরিহার্য যে মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে, বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের লালিত আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করে দিতে ষড়যন্ত্র বেশ জোরেসোরেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মুজিবনগর থেকে। তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার বিদেশ বিষয়কমন্ত্রী আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি খোন্দকার মোশতাক এই ষড়যন্ত্রের হোতা। কলকাতার মার্কিন দূতাবাসে তিনি গোপনে যাতায়াত করতেন এবং আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা করে একটি হালকা কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত থেকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবেই থাকতে বাংলাদেশ সরকারকে রাজি করানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। এই ষড়যন্ত্র ভারত সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী উদ্ধার করে তাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করলে তিনি তৎক্ষণাৎ বিষয়টি তাজউদ্দিন আহমেদকে অবহিত করলে তিনি খোন্দকার মোশতাককে বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ না করে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ওই দায়িত্ব অর্পণ করেন। ভারত সরকার খোন্দকার মোশতাককে গৃহবন্দি করে রাখেন যাতে তিনি কোনো বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারেন। এভাবেই সে ষড়যন্ত্র শুরুতেই বানচাল করে দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়।

খোন্দকার মোশতাকের যুক্তি ছিল- একমাত্র কনফেডারেশনের প্রস্তাব মেনে নেয়ার মাধ্যমেই পাকিস্তানের আটক শেখ মুজিবকে বাঁচানো সম্ভব। এই কথাও যে ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ তা বুঝতে ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কোনো কষ্ট হয়নি। তাই প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধ সফল করে তুলে তার মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

অতীতের এ ইতিহাসের বয়ানকে সামনে রেখে সফল মুক্তিযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা হয় এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ড. কামাল হোসেনসহ লন্ডন, দিল্লি হয়ে ঢাকা এসে পৌঁছান। সমগ্র জাতির দুশ্চিন্তার অবসান হয়।

বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে আবেগাপ্লুত লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাসভবনে ফিরলেন। পরদিনই রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, ওই মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে স্থান পেলেন সেই কনফেডারেশন-প্রত্যাশী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। ততধিক বিস্ময়ের, মুজিবনগর থেকে ঢাকা ফিরে তাজউদ্দিন যে সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতেও স্থান পেয়েছিলেন ওই ষড়যন্ত্রকারী নেতা।

বছর আড়াই যেতে না যেতেই মুক্তিযুদ্ধের সফলতম পরিচালনাকরী, মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে অনুযায়ী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো। বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসেবে দিব্যি থেকে গেলেন খোন্দকার মুশতাক। ফলে বিষয়টা দাঁড়াল- পাকিস্তান-আমেরিকা-চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূলহোতা মন্ত্রিসভায় থাকার সুবাদে সরকারের সব সিদ্ধান্ত অবহিত করার সুযোগ পেলেন। পক্ষান্তরে ওই ষড়যন্ত্র বানচালকারী বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বাধিক শ্রদ্ধা ও অনুগত তাজউদ্দিন চলে গেলেন বিচ্ছিন্ন হয়ে।

সবারই জানা, ১৯৭১-এ ব্যর্থ হলেও মুক্তিযুদ্ধে বা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল সেই দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো পরাজয় মেনে নেয়নি- বরং নতুন উদ্যমে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।

এই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বন্ধুসুলভ দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থা খবর পাওয়ামাত্রই তাদের নিজ নিজ সরকারকে অবহিত করে। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি, ভারতের ‘র’ বুলগেরিয়ার তৎকালীন ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত খবর পেয়ে যায়, বাংলাদেশের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে শিগগিরই হত্যা করবে- এমন ষড়যন্ত্র এটেছে। সেখবর নানা সূত্রের মাধ্যমে যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করলে তিনি বলেন, কোনো বাঙালি সন্তান আমার গায়ে হাত তুলবে না। তোমরা বরং সাবধানে থেকো। এমনকি, বঙ্গবন্ধুকে যখন তার আপন ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি অনুরোধ করেন, “এই মুহূর্তে খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রিসভা থেকে পদচ্যুত করে তাকে এবং অপরাপর ষড়যন্ত্রকারী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকেও পদচ্যুত করে গ্রেপ্তার করে জেলে না পাঠালে দেশটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। শেখ মণিকেও তিনি পাত্তা দেননি এবং একই কথা বলে বিদায় দেন।

আমেরিকা তার আগে ওই মন্ত্রীদের এবং সামরিক বাহিনীর কিছু তরুণ কর্মকর্তার সঙ্গে ঢাকাস্থ দূতাবাসে ঘন ঘন বৈঠক করার খবরও জানা গেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু থাকলেন তার সিদ্ধান্তে অটল।

অপরদিকে ক্যান্টমেন্টও হয়ে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের অন্যতম নিরাপদ কেন্দ্র। পরবর্তীকালে আত্মস্বীকৃত খুনিরা যেমন মেজর ডালিম প্রকাশ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা স্বীকার করে।

১৫ আগস্ট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনা-উত্তর প্রথম সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়েল চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি তাতে যোগ দেবেন ফলে এই প্রস্তুতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের স্বাভাবিক ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু যাবেন সে কারণে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে বলে সামরিক বাহিনীর গাড়ি এমনকি ট্যাঙ্ক চালানো হলেও মানুষ সাদাচোখে দেখে, সন্দেহের কিছু পায়নি।

কিন্তু পেল রাইফেলের আওয়াজ অতি প্রত্যুষে যখন ভেসে এলো-তখন সবার মনে সন্দেহ উদ্রেক করল। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বঙ্গবন্ধু নেই- তাকে হত্যা করা হয়েছে। পৃথিবী বিস্মিত, বাংলাদেশ স্তব্ধ। ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে যাবার সব পথ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ব্যারিকেড করে রাখায় কেউ চাইলেও সেদিকে যেতে পারেননি।

সন্ধ্যায় সব কিছু আরও স্পষ্ট হলো। বেতার টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেরকে ‘সূর্য সন্তান’ বলে অভিহিত করলেন। আর শেখ মুজিব ইসলাম ধ্বংস করতে উদ্যত হওয়ায় তাকে হত্যা করা ব্যতীত ইসলাম রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলে উল্লেখ করলেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকারীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না এমন বিধান রেখে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেন এবং খুনিদেরকে বিদেশে বাংলাদেশের নানা দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতও করেন এই মোশতাক।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, তিন বাহিনীপ্রধান ও পুলিশ প্রধান ওই ১৫ আগস্টেই মোশতাক সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আস্থা ব্যক্ত করেন।

মুহূর্তেই সরকারি রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্ব পর্দার অন্তরালে চলে গেল। কোনো প্রতিরোধ হলো না। আবার বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অল্প কজন মন্ত্রী বাদে সবাই মোশতাকের নতুন মন্ত্রিসভা যোগ দিলেন। ষোলকলা পূর্ণ হলো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ হারাল তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। পৃথিবী হারাল একজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতাকে। জনগণ হারাল মুক্তিযুদ্ধের সুমহান আর্দশকে। সে শূন্যতা অপূরণীয়।

লেখক: সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর