তাকে নিয়ে কত উচ্ছ্বাস, কত আলোচনা, কত সভা সমাবেশ, আরও কত কী! অথচ হত্যা পরবর্তী সময়ে তার নামটিও উচ্চারণ করা যেত না, ইতিহাসের সব থেকে কালো আইন দ্বারা রুদ্ধ করা হয়েছিল তার হত্যাকাণ্ডের বিচারের সমস্ত পথ।হ্যাঁ, আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যে সময়ে প্রিয়তম মানুষটিকে ছিনিয়ে নিয়ে ঝাঁজরা করে দেয়া হলো বুকের সবকটি পাঁজর। এক অর্থে বাঙালি তার নিজের পাঁজরই হারালো। তবে এই পাঁজর হারানোর কথা, হত্যাকাণ্ডের কথা, বীভৎসতার কথা বলা যায়নি বহু বহু বছর। কী বর্বর, কী অকৃতজ্ঞ এ জাতি!স্বাধীনতা এনে এ জাতি যেমন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং আইন করে হত্যার বিচার বন্ধ করে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ে লিখিত নামটিও বাংলাদেশ।তখন আমি ছিলাম নিতান্তই শিশু। কত বড় অঘটন ঘটে গেছে বুঝতেই পারিনি সেদিন। গভীর অন্ধকার নেমে এসেছিল এ ভূখণ্ডে, যে অন্ধকার ভেদ করে এখনও পুরোপুরি আলো আসেনি। দিনটি ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সেদিনই হত্যা করা হয় এ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে, জাতির পিতাকে।আমাদের বেড়ে ওঠার কালটা ছিল অন্যরকম। তথ্য গোপনের কাল, সত্য ইতিহাস মুছে দেয়ার কাল। পাগলা হাওয়া বইয়ে দিয়ে কীর্তি-ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেবার অপচেষ্টার কাল। চলছিল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার সব ধরনের অপকৌশল। কিন্তু ইতিহাস পথ হারায় না, মানুষকে সাময়িক বিভ্রান্ত করে মাত্র। ইতিহাসই উন্মোচন করে দেয় প্রকৃত সত্য। কারণ একটা সময় পর্যন্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করা গেলেও চিরদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লিতে বেড়ে ওঠা দুরন্ত কৈশোরের সেই বালকটি কালের পরিক্রমায় ইতিহাস সৃষ্টি করে নিজেই হয়ে ওঠেন ইতিহাস। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, সংবেদনশীলতা, ভালোবাসা তার চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই তো মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন সেই স্কুল-জীবনেই। জেলও খেটেছেন বালক বেলাতেই। রাজনীতি তার মননেই ছিল। রাজনীতির জন্যই তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন, রাজনীতির কাছেই ছিল তার আত্মসমর্পণ।
১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সংগঠক হিসেবে এবং নেতৃত্বে। বন্ধুর পথে চড়াইউৎরাই অতিক্রম করেই তিনি পেয়েছিলেন বাঙালি জাতির অকৃত্রিম ভালোবাসা। জেল-জুলুম ছিল তার জীবনের নিত্যসঙ্গী। জীবনের তেরোটি বসন্ত কেটেছে কারাভ্যন্তরে।জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রমাগত নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন, করেছেন অতিক্রম। যাদের কাছ থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন অতিক্রম করেছেন তাদের। কারো তৈরি করা পথ দিয়ে নয়, বরং নিজেই পথ তৈরি করে ধীরে ধীরে এগিয়েছেন ক্রমাগত সামনে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির ইমারত গড়ে তুলেছিলেন বলে তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। আর তাই বঙ্গবন্ধুর সরলতা যেমন মানুষকে ভালোবাসা, দুর্বলতাও মানুষকে ভালোবাসা। পুথিগতবিদ্যায়, বুদ্ধিমত্তায়, সৃজনশীলতায় সেরা বাঙালি হয়তোবা আরও পাওয়া যাবে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো অসম সাহসী, দূরদর্শী এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী রাজনৈতিক নেতা খুব বেশি নেই।
তাই তো রাজনীতি-সাহিত্য-শিল্প, অর্থনীতি-বিজ্ঞান, সমাজ-সংস্কৃতি, শিক্ষা-সংস্কারের শত শত বছরের ইতিহাসে সব বাঙালিকে পেছনে ফেলে শেখ মুজিব মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি জাতির ভাষা, সাহিত্য এবং সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছেন অনেক দূর কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই জাতিকেই সৃষ্টি করেছেন। সেজন্যই কবিগুরুকে ছাপিয়ে তিনিই হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।প্রতিটি মানুষের জীবনের পরতে পরতে যেমন উপলব্ধি আসে, বঙ্গবন্ধুরও তাই হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক থাকলেও ৪৭-এ দেশভাগের অব্যবহিত পরই তিনি যখন বুঝতে পারলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা ছিল ঐতিহাসিক ভুল, তখন থেকেই শুরু হয় তার জীবনের বাঁক বদলের লড়াই। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।তিনি সবসময় শোষিতের কথা বলতেন, বঞ্চিতের কথা বলতেন, নিপীড়িতের কথা বলতেন। তাই তো সমাজের শোষক শ্রেণির চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এক নেতার আকাশ ফুঁড়ে মহাকাশ ছোঁয়াকে পৃথিবীর বড় দেশের বড় নেতারা সহজভাবে নিতে পারেনি। তার খ্যাতি, তার জনপ্রিয়তা তাদের সহ্য হলো না। তাই তো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাকে হত্যায় সক্রিয় হয়ে উঠলো ঘাতক চক্র।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল দেশের মানুষের তার প্রতি প্রবল আবেগ। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে কঠোরভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর এই আবেগের কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনায় কঠোর হতে পারেননি, শক্ত হাতে দমন করেননি; এমনকি মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদেরও। আর ছিল মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তাই তো তার জীবনশঙ্কার কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেও বিষয়টি তিনি একেবারেই আমলে নেননি। সেই সুযোগেই ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকের দল হত্যা করল স্বাধীন বাংলার স্থপতি, মহানায়ক, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে।সারাজীবন সংগ্রাম করে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিলেন যে মহানায়ক তাকে আমরা বাঁচতে দিলাম না, এ দেশ, তাকে ধারণ করতে পারল না। কী অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা! পরিবারের শেষ সন্তানটিকে পর্যন্ত বাঁচতে দিলাম না!তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মহাকালের মহানায়ক। এ দেশের মানচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার জীবন। এ জাতির ভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে তার জীবন। শত চেষ্টা করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি তার নাম, তার অর্জন। মহাকালের পরিক্রমায় যতদিন এ ভূখণ্ড থাকবে, ততদিনই প্রতিটি হৃদয়বান বাঙালির হৃদয়ের গভীরে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকবে একটি নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক।