চেম্বারে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে টিভির খবরের চোখ বুলিয়ে নেয়ার একটা অদ্ভুত নেশা ও দক্ষতা আমার আছে। আমার এই অর্জনটি চলমান করোনা মহামারির সময়ে। যেহেতু মাঝে মাঝেই এই চ্যানেল তো সেই ফেসবুক পেইজে টকশোতে ডাক পড়ে, কাজেই পরবর্তী টকশোটির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখাটা আমার জন্য নিউ নরমাল বাস্তবতা। এভাবেই হঠাৎই নজরে পড়ল আইনমন্ত্রীর নিজ বাসভবনের লনে বসে করা সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনটি। মৃত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় না আনতে পারার আইনগত বাধ্যবাধকতার কথা স্বীকার করে মন্ত্রী জানিয়েছেন শিগগিরই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করার জন্য সরকার একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছে।
দুই.
২০১৮-তে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী। জাতীয় শোক দিবস স্মরণে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়ে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে। ওই অনুষ্ঠানটিতে প্রথমবারের মতো এই কমিশনটি গঠনের কথা জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। অনেকেই আশ্বস্ত হয়েছিলেন সেদিন মন্ত্রীর এই ঘোষণায়। তারপর পৃথিবীটা হঠাৎ করেই এক অদৃশ্য ভাইরাসের ধাক্কায় খোলনলচে পালটে গেল। কাজেই আশায় বুক বেঁধেই আরও দুটি ১৫ আগস্ট পার করেছি আমরা। এবারের আগস্টের ১৫-কে সামনে রেখে আইনমন্ত্রীর এই ঘোষণাটা তাই এতটা স্বস্তির।
তিন.
আওয়ামী লীগ সরকারের গত তেরো বছরে অর্জিত সাফল্যের যে লম্বা তালিকাটি আছে তাতে অন্যতম সাফল্যটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী আর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারাটা। বলাবাহুল্য এ কাজটি আদৌ সহজ ছিল না। বোমা হামলা, আগুন সন্ত্রাস, টানা অবরোধ এমনি অনেক কিছু মোকাবিলা করে তবেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল এমন অবিশ্বাস্য অর্জন।
এখনও এ দেশের এমন অনেক মানুষ আছেন যারা মনে করেন আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে বলেই এসব অপরাধীর বিচারের আওতায় নিয়ে আসায় তাদের এতটা আগ্রহ। যারা এমনটা ভাবেন তারা হয় বুঝেও বুঝতে চান না অথবা পাকিস্তানের বটিকা গিলেছেন খুব ভালোভাবে।
বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন আইনের শাসন বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশকে নিয়মনীতির বাংলাদেশে রূপান্তরিত করা আর পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে এই দুটো বিচার করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে তা তিনি যতই ক্ষমতাধর হন না কেন, কেউ যেন অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার দিবাস্বপ্নে বিভোর না থাকেন সেটি নিশ্চিত হয়েছে এই বিচারিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্য দিয়ে।
চার.
আজ থেকে এক, দুই বা তিনযুগ পরে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে, সবই ঠিক আছে, তিনি মেনেও নিচ্ছেন সব কিছুই, কিন্তু যেহেতু দণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় জেনারেল জিয়া বা খন্দকার মোশতাকের নাম নেই, তাহলে কোন নৈতিক অধিকারে আমরা তাদের বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করি, তখন কিন্তু আমাদের কৈফিয়ত দেয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না। কাজেই বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে সঠিকভাবে তুলে আর ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দেয়ার তাগিদ থেকেই এই কমিশন গঠন করাটা অত্যন্ত জরুরি।
পাঁচ.
জেনারেল জিয়াকে আমরা অনেকে অনেক পরিচয়ে চিনি। তার অনেক পরিচয় জানা থাকলেও যে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি আমরা অনেকেই জানি না, তাহলো- তিনি ছিলেন পাকিস্তান মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স আইএসআইয়ের কর্মকর্তা। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধকালে নয়টি মাস আর তার পর থেকে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার কর্মকাণ্ডগুলো একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে তিনি কখনই তার মূল জায়গা থেকে সরেননি। বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তান’-এ পরিণত করার জন্য তিনি অবশ্যই পাকিস্তানে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন।
ছয়.
বরাবরই আগস্টে সক্রিয় থাকে পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র আর সঙ্গে তাদের এদেশীয় সহযোগী আর সিমপেথাইজাররা। তবে এই আগস্টে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নাকি তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন। ভিডিওটিতে এমনকি পাক-বাংলা যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে একটি পতাকারও ছবি দেখানো হয়েছে। অপরদিকে ১৪ তারিখে পাকিস্তান দিবসে ঘুম থেকে উঠে নিউ নরমাল স্বভাববশত স্মার্টফোন ঘাটতে বসে রীতিমতো ভিমড়ি খাবার জোগাড়। পাকিস্তান দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে সাতসকালে ফ্লায়ার শেয়ার করছেন কেউ কেউ!
সাত.
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বাস্তবতার এই অন্য প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবারের আগস্টে আমরা তাই প্রত্যাশা রাখছি যে, সরকার সামনে দ্রুতই বহুল আকাঙ্ক্ষিত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই স্বাধীন কমিশনটি গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের দেশি-বিদেশি কুশীলবদের জাতির সামনে উন্মোচন করে আরও একবার বাঙালি জাতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করবেন। নইলে আমাদের ভবিষ্যৎই যে শুধু কলঙ্কিত হবে তাই নয়, আরও কত ঔদ্ধত্য যে আমাদের হজম করতে হবে তা ভবিতব্যই ভালো জানে।
লেখক: চিকিৎসক, অধ্যাপক। বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ