একুশে আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও একটি কালো অধ্যায়। যে অধ্যায়টি রচনার সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নেতৃত্বের যোগ ছিল। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল, এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন করে দেয়ার এক নৃশংস ঘটনার দিন এই একুশে আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয় জাতির পিতার কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী, আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন।
একুশে আগস্টের ঘটনা ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্টের ঘটনারই ধারাবাহিকতা। ৭৫-এ যা সম্পূর্ণ হয়নি, তা-ই করতে চেয়েছিল ঘাতকরা একুশে আগস্টে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টায় গ্রেনেড হামলা, হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া, তদন্তের নামে জজ মিয়া আবিষ্কার, বিচার বিভাগীয় তদন্ত রসিকতা, ‘আওয়ামী লীগই করেছে, শেখ হাসিনা আঁচলের তলে করে গ্রেনেড নিয়ে গেছে’ বলে প্রচারণা চালানো, টেলিভিশন চ্যানেল থেকে জোর করে ফুটেজ নিয়ে যাওয়া এবং ধ্বংস করে ফেলা, এসবই করেছিল বিএনপির মন্ত্রী ও নেতারা। তখন বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল বিএনপি সংসদে পর্যন্ত কথা বলতে দেয়নি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সেদিন পরিকল্পিতভাবে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছিল, তা কেবল একা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার লক্ষ্যেই নয়, সমগ্র জাতির স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে অন্ধকারে নিক্ষেপের এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। এই মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত যথার্থই বলেছেন, ‘রাজনীতি মানে কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? এই রাজনীতি দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে?’
উল্লিখিত প্রশ্নটি দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষের কাছে তোলা রয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যারা হত্যার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং আছে, তারা এখনও সগর্বে রাজনীতি করে যাচ্ছে। তাদের জনসমর্থনে এতটুকু ঘাটতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
একুশে আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এমন হামলার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বলা হয়েছে, তারেক রহমান হাওয়া ভবনে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। হামলার আগে পিন্টুর বাসভবনে দফায় দফায় হামলার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হয়। হামলার ব্যাপারে আর্থিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন তারেক, বাবর ও পিন্টু। আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে আদালত এ রায় দেন।
এই মামলায় খালেদা জিয়া রেহাই পেলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল। আমরা অপরাধীকে চিহ্নিত করেছি। মূল আসামি জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ ২০০৫ সালের ১১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই বক্তব্য যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নির্ভেজাল মিথ্যাচার, তা আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়েছে।
‘প্রথম আলো’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে সে সময়ে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করতে বলেছিলেন। তাহলে এই মামলা থেকে খালেদা জিয়া বাদ পড়লেন কীভাবে? খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বয়ং এই ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন। অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। তারপরও কি খালেদা জিয়া এই ঘটনায় মাফ পেয়ে যাবেন?
আমরা দেখেছি, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়।
২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের এমপিরা একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছে। তখন বিএনপি ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশবাসীকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনায় ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকার ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন। জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছিলেন, প্রচার করেছিলেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর, সশস্ত্র বাহিনীসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দেড় বছরে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার নেপথ্যের অনেক তথ্যই বেরিয়ে এসছে। সর্বশেষ আদালতের রায়ের মাধ্যমে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার জেনেশুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী ও প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল।
বিএনপির নেতারা এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে মায়াকান্না কাঁদেন। কিন্তু একুশে আগস্টের এই কলঙ্ক থেকে কীভাবে মুক্ত হবেন? সভ্যজগতে কোনো সরকার বা দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য এমন বর্বর পন্থাকে মদদ জোগাতে পারে তার উদাহরণ বিরল ! বাংলাদেশে যারা সমঝোতার রাজনীতির কথা বলেন তারা কীভাবে একুশে আগস্ট ও পনেরো আগস্টকে আড়াল করবেন? কারণ এই দুটি কলঙ্কিত ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরস্থায়ীভাবে বিভক্ত করে দিয়েছে, যেখান থেকে আর বের হওয়ার পথ নেই, নেই কোনো ধরনের সমঝোতার পথও।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সঙ্গে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ঠতা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টায় বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ভূমিকা বিএনপিকে আওয়ামী লীগের এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের নামে মামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগকে প্রধান শত্রু মনে করে বিএনপি! এমন একে অপরের প্রতি বৈরী দুটি দলের মধ্যে সদ্ভাব কীভাবে সম্ভব?
এ ব্যাপারে একটি প্রাচীন গল্প মনে করা যেতে পারে।
কোনো এক পাড়াগাঁয়ে ছেলেকে নিয়ে এক বাবা থাকতেন। বাড়ির পাশে একটি গর্তের মধ্যে একটি সাপও থাকত। একদিন লোকটির ছেলেকে ওই সাপটি কামড়াল। ফলে ছেলেটি মারা গেল। ছেলেটির বাবা তখন রাগের বশে একটি কুড়াল হাতে বসল সেই সাপের গর্তের ধারে। বেরুলেই সাপটাকে খতম করে দেবে। কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করার পর লোকটি দেখতে পেল সাপটা মাথা বের করছে। লোকটি অমনি জোরে একটা কোপ মারল। কিন্তু কোপটা সাপের মাথায় না লেগে লাগল একটা পাথরের ওপর। আর পাথরটা গেল ফেটে। এবার লোকটি মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেল। সে সাপটাকে মারতে গিয়েছিল, কিন্তু সাপ মরেনি। ফলে সাপটি নিশ্চয়ই তার ওপর রেগে রয়েছে। যেকোনো সময় সাপটি তাকেও কামড়াতে পারে। এসব ভেবে লোকটি সাপের সঙ্গে ভাব করতে গেল। বুদ্ধিমান সাপ তাতে রাজি হলো না। সে বলল, আমাদের দু’জনের ভাব হওয়া অসম্ভব। পাথরের ওই ফাটা জায়গাটা দেখলেই আমার মনে পড়বে তুমি আমায় কী করতে চেয়েছিলে? আর তোমার ছেলের কবরের দিকে নজর পড়লেই তোমার মনে পড়বে আমি তোমার কী করেছি। এমন দু’জনের কি ভাব হতে পারে?
যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সব বিরোধ মিটিয়ে ফেলে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তারা এই অমোচনীয় ‘ক্ষত’ সারাবেন কীভাবে?
লেখক: কলাম লেখক, সাবেক ছাত্রনেতা।