১৩ গ্রেনেড, ১০ গুলি। টার্গেট আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। পরিকল্পনায় দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী ষড়যন্ত্রকারী। পরিকল্পনার মনিটরিং সেল বনানীর একটি বিশেষ ভবন। নেপথ্যে নেতৃত্ব রাষ্ট্রযন্ত্র ও এর বিশেষ বাহিনী। সময় ২১ আগস্ট, ২০০৪। এটি একটি হত্যাচেষ্টার পরিসংখ্যান। দিনটি ছিল সারা দেশে বোমা হামলা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মিছিলপূর্ব সমাবেশ। বোমা হামলার প্রতিবাদ সমাবেশেই গ্রেনেড হামলা! ক্ষমতায় জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট। যারা এ হামলার বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের কাছে এই ভয়াবহ স্মৃতি আজও এক আতঙ্ক।
বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতির ইতিহাসে বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত একটি দিন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সুস্পষ্ট মদদে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত দলের মিছিলপূর্ব সমাবেশে ঘটানো হয়েছিল ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম নারকীয় গ্রেনেড হামলা। সৌভাগ্যের সারথিরূপে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কর্ণধার ও বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনা।
ই হামলার গ্রেনেডে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন কালো বিদঘুটে পরিবেশ আজও আহত ও নিহত স্বজনদের চমকে দেয়। তাড়িয়ে বেড়ায় বিকট শব্দে বিস্ফোরিত গ্রেনেডের ভয়ংকর দৃশ্য। তারপরই গুলির পর গুলি। যেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পুনরাবৃত্তি। নৃশংস সেই হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এতে দলটির প্রায় পাঁচশ’ নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হন। এই হামলার শিকার অনেকে এখনও শরীরে ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তার শ্রবণেন্দ্রীয় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন ভোররাতে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, ছোট ভাই শেখ নাসের, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূসহ কেউই রক্ষা পাননি সেই রাতের নির্মম-বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড থেকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে অবস্থান করায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেদিন কড়া নিরাপত্তায় হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর নিজ গ্রামে লাশ পৌঁছায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লাশও সবাইকে দেখতে দেয়া হয়নি। লাশ দাফনের পর কবর পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োগ করা হয় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেখানকার মসজিদে মিলাদও আয়োজন করতে দেয়া হয়নি।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে টানা ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতেও দেয়া হয়নি। সেদিনকার খবরের কাগজগুলোতেও গুরুত্ব পায়নি এই মহানায়কের নির্মমভাবে প্রস্থানের সংবাদ। বিশ্বাসঘাতকার ফলে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয় বাংলার মীরজাফর কুখ্যাত খোন্দকার মোশতাক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ। তারপর বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম, শুরু হয় সামরিক শাসন। চলে টানা ১৫ বছর। বিচারপতি আবু সাদাত মো. সায়েম দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টাকালে ১৯৭৭ সালে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা দখল করেন মেজর জিয়া। তিনিই সেই মেজর জিয়া, যিনি আজকের বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা।
মেজর জিয়া ক্ষমতার লোভ ও হত্যাযজ্ঞের ওপর ভিত্তি করে যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই দলটি আজও ক্ষমতা দখল ও নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে রয়েছে। দলটি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় শক্তিকে ধ্বংস করে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অপকৌশল প্রয়োগের সময় হিসেবে বার বার বেছে নিয়েছে আগস্ট মাসকে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তেমনি একটি দিন। এদেশে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করার জন্য নোংরা রাজনীতির জন্ম দেয় কালো অধ্যায়।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভিন্ন আদর্শ ও ভিন্নমত থাকবে। সেই মত জনমুখী করতে রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তা তুলে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো দলকে নিশ্চিহ্ন করা বা দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্র কোনো সভ্যসমাজে কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া যে এ ধরনের হামলা সম্ভব নয়, তা-ও এখন স্পষ্ট। পরবর্তী সময়ে এই মামলায় দেয়া সাক্ষ্যই তা দৃশ্যমান।
তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার এ ঘটনার পর তদন্তে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়নি। বরং ঘটনার পর পরই সরকারের প্রভাবশালী মহল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ ভবনের সম্পৃক্ততার কথা, ঘটনার পর আলামত নষ্ট করা, এফবিআই-এর তদন্ত দলকে সহযোগিতা না করার মতো অন্যায় কাজ করেছিল সরকার। এমনকি পরে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ‘জজ মিয়া’ নাটকের অবতারণা করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এমনটা বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন সংসদেও অনুরূপ মিথ্যাচার করে সরকারি দলের সিনিয়র কিছু সদস্য।
পরবর্তীকালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ঘটনার তদন্ত করে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে দুটি পৃথক মামলা করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আদালত এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১১ সালের তিন জুলাই মূল ষড়যন্ত্রকারী আরও কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে একটি সম্পূরক চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়। এতে অভিযুক্ত হিসেবে আরও অন্তর্ভুক্ত হয় বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিবসহ ত্রিশজন। ফলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২জনে।
২০১১ সালের আগস্টে পলাতকদের বিরুদ্ধে আদালত দেশের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে। তারই ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর, দীর্ঘ ১৪ বছর পরে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। উল্লেখ্য, ২১ আগস্টসহ বঙ্গবন্ধুকন্যাকে অসংখ্যবার হত্যার চেষ্টা করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। বার বার আঘাত পেয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন, তাদের উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে দ্রুত এই ধরনের বর্বরোচিত সব হামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করতে সহায়তা দেয়া। এই হামলার নেপথ্যে কারা ছিল, হামলার উদ্দেশ্য কী ছিল, হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড কোথা থেকে এসেছে এবং এই ঘটনায় তৎকালীন সরকারের সম্পৃক্ততার তথ্য আদালতের রায়ে এখন অনেকটাই স্পষ্ট এবং দেশবাসীও তা অবহিত। এখন অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। এ ধরনের বর্বর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এটা প্রত্যাশা সবার। দেশে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন।
বোমা বা গ্রেনেড দিয়ে কাউকে নিশ্চিহ্ন করায় চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা নয়। এ ধরনের অপরাজনীতিতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে কলুষিত করেছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা অচিরেই গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। পলাতকদের আইনি প্রক্রিয়ায় দেশে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
পালিয়ে যাওয়া নয়; বিপদে জনগণের পাশে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ানোর নামই আওয়ামী লীগ- এটা বার বার প্রমাণিত। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার ওপর যতবারই হামলা হয়েছে, হত্যার চেষ্টা হয়েছে ততবারই আরও সুসংগঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের কর্মীরা ত্যাগের প্রমাণ দিয়েছে দল এবং নেত্রীর জন্য। সময়ের প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন অসংখ্য কর্মী। আজ প্রতিহিংসার নৃশংসতম সেই ভয়াল দিন একুশে আগস্ট। নেত্রীর জীবন বাঁচাতে যারা এদিন জীবন দিয়েছেন, যারা মানববর্ম তৈরি করে নেত্রীকে বাঁচিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে মারা গেছেন- তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: সাংবাদিক