বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তালেবান ও দুর্নীতি

  •    
  • ২১ আগস্ট, ২০২১ ১৪:১১

অস্ত্র হাতে মাত্র দশ দিনে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে ইসলামিক মৌলবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ তালেবান। তারা যে ক্ষমতা দখল করবে, তা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কারণ আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ন্যাটো সৈন্য উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তের আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দোহাতে এই তালেবানদের সঙ্গেই বৈঠক করেছিলেন। এর অর্থ তখনই ধরে নেয়া হয়েছিল আফগানিস্তানের ওই মূহূর্তে ক্ষমতা দখল করতে পারে এমন একটি শক্তি তালেবান। আর বাইডেন যেহেতু ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন; তাই ধরে নেয়া যায়, আমেরিকা তালেবানকে মাথায় রেখেই তাদের সৈন্য উইথড্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ অবশ্য নানাভাবে বলানোর চেষ্টা করছে, তারা মনে করেছিল কাবুলের গানি সরকার অন্তত দুই বছর তালেবানদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। সেখানে তারা দশ দিনও পারেনি; এবং কোথাও কোনো বাধা দেয়নি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখানে তাদের তথ্য যাচাইয়ে ভুল ছিল। আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ যে এ কথাটি সত্য বলছে, তা মানার পক্ষে খুব বেশি কারণ নেই। কারণ, ব্যক্তিগত আলোচনায় আফগানিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিকরা শুধু নন, একেবারে তরুণ সাংবাদিকরা সব সময়ই এ কথা বলেছেন, আমেরিকার সৈন্য চলে গেলেই কাবুলের পতন ঘটবে। কারণ, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক বা সরকারের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা কোনোমতেই তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধের রিস্ক নেবে না। তা ছাড়া তারা কাদের নিয়ে রিস্ক নেবে? কারণ, সেনাবাহিনী ও সিভিল প্রশাসন দুর্নীতিতে ভরা। তারাও যুদ্ধের দায় নেবে না। তারা কেউই যুদ্ধ করবে না। যাদের সুযোগ আছে তারা পালিয়ে যাবে। অন্যরা তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করবে। ভরসা কেবল আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ। তবে তা তো সঙ্গে সঙ্গে সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের তরুণ সাংবাদিকরাও যেখানে এ কথা জানতেন সেখানে আমেরিকার গোয়েন্দা দপ্তর এ বাস্তবতা জানবে না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। আমেরিকার এখন আফগানিস্তানকে ছেড়ে দিতেই হবে। আফগানিস্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়ও তার নেই। তা ছাড়া পাকিস্তান, চায়না ও ইরানের পাশে একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান রাখার জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলয়ন ডলার খরচ করারও আর এখন কোনো প্রয়োজন নেই। বিশ বছর আগে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে ঢুকেছিল, সে সময় আর বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। কারণ, আফগানিস্তানে যখন ঢুকেছিল, তখন একক বিশ্ব। তার সবটুকুর রাজা তখন আমেরিকা। এখন সময় ভিন্ন। এখন আবার পৃথিবী দুই পরাশক্তিতে প্রবেশ করতে চলেছে। চায়না প্রতিদিন এগিয়ে আসছে। চায়না ইন্দো-প্যাসিফিকে তাদের গলা প্রতিদিন উঁচু করছে। তাই এখন আর আফগানিস্তান নিয়ে আমেরিকার ব্যস্ত থাকার ভেতর কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং একটি বাড়তি বোঝা। তার থেকে আমেরিকার অনেক বেশি দরকার, এশিয়া প্যাসিফিকের দেশগুলোতে চায়নার যে প্রভাব বাড়ছে, সেখানে তাদের পুরোনো অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা।

আর সে কারণে আফগানিস্তানে পতনের এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট কামলা হারিস সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম সফরে আসছেন। সিঙ্গাপুরে কমলা হারিস তাদের পোর্টহাব ও নৌঘাঁটি পরিদর্শন করবেন। আর ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় গুরুত্ব থাকবে বেশি। ভিয়েতনাম তার রপ্তানি পণ্যের ত্রিশ ভাগ রপ্তানি করে আমেরিকায়। এ ছাড়া কামলা হারিস ভার্চুয়াল মিটিংয়ে যোগ দেবেন আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে। অর্থাৎ আমেরিকা তার স্বার্থ নিয়েই এগোচ্ছে।

এদিকে আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে পাকিস্তান ও চায়না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তার এক ভাষণে বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের জনগণ মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হলো।’ কিন্তু ১৫ আগস্ট তালেবানদের বিজয়ের পরে ১৬ আগস্ট পাকিস্তান জরুরি মিটিং ডাকে তাদের সিকিউরিটি কাউন্সিলের। আর ওই মিটিং থেকে তারা তালেবানদের জানিয়ে দেয়, ‘তালেবানরা যেন কোনোমতেই আফগানের মাটি অন্য কোনো সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহার করতে না দেয়।’ কিন্তু পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ মুহূর্তে কথা দিলেও শেষ অবধি তালেবানরা সেটা পারবে না।

কারণ, পাকিস্তানের বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে টিটিপির নীতি ও উদ্দেশ্য এবং আফগান তালেবানদের নীতি ও উদ্দেশ্য এক। তাই যাদের উদ্দেশ্য ও নীতি এক, তারা শেষ অবধি একই কাপড়ের নিচে থাকবে। আবার ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করছেন, তালেবানদের মূল নেতা এখনও পাকিস্তানের জেলে। তাই তাকে নিয়ে পাকিস্তান কী করবে, সেটাও এখন দেখার বিষয়।

আফগানে তালেবানদের বিজয়ের আগে তালেবান নেতারা চায়নার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কথা দেয়, তারা ক্ষমতায় গেলে উইঘুরে কোনো মুসলিম সন্ত্রাসবাদীকে সহায়তা করবে না। বরং তারা চায়নার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলবে। বিশ্ব রাজনীতিতে ও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে নিয়ে খেলায় চায়না নতুন প্লেয়ার। তাই তারা খুব সহজে তালেবানদের বিশ্বাস করেছে। কিন্তু তারা ভেবে দেখেনি, তাদের উইঘুরে সন্ত্রাসী কাজ চালানোর জন্য উইঘুরের অনেক সন্ত্রাসী ট্রেনিং নেয় তাদের সব থেকে বিশ্বস্ত পাকিস্তানের বিভিন্ন ইসলামিক মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছ থেকে। যা হোক, তারপরেও তালেবান মুখপাত্ররা এখনও চায়নার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছে। তারা চায়না সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, আফগানিস্তানকে গড়ে তোলার জন্য সেখানে চায়নিজ বিনিয়োগ করতে।

চায়নার অবশ্য আফগানিস্তানের কপার মাইনিংয়ে, পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে বিনিয়োগ আছে। এতদিন তাদের বিনিয়োগকে বিনা মূল্যে পাহারা দিয়েছে আমেরিকা। এখন এগুলো তাদের নিজেদের পাহারা দিতে হবে। তা ছাড়া সৈন্য উঠিয়ে নিয়ে আফগানিস্তানের ওপর থেকে প্রত্যক্ষ চাপ প্রত্যাহার করেছে আমেরিকা। কিন্তু অর্থনৈতিক চাপ যে প্রয়োগ করতে যাচ্ছে তার প্রমাণ ইতোমধ্যে দেখা গেছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রত্যক্ষ চাপে আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে, এ মুহূর্তে আফগানিস্তানকে তাদের যে হাফ মিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা ছিল সেটা তারা বাতিল করেছে। তা ছাড়া আরো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে আগামী চার বছরে ৬০টি দেশের পক্ষ থেকে যে ১২ বিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানকে ধাপে ধাপে দেয়ার কথা ছিল, তাও বন্ধ হতে যাচ্ছে। আমেরিকা সেভাবেই তার মিত্রদেরকে কাজে লাগাচ্ছে। আইএমএফের অর্থ বাতিল থেকে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর অর্থ আর আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পাবে না। অপরদিকে আমেরকার মিত্র দেশগুলোও আফগানকে সাহায্য করবে না। তাহলে তালেবান সরকারকে সাহায্য করতে পারে এমন সরকার থাকে চায়না, ইরান ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের নিজের অর্থনীতিই চায়নানির্ভর। বাস্তবে একটা দেউলিয়া দেশ।

ইরান এতদিন আমেরিকার বিরুদ্ধে তালেবানকে সমর্থন দিলেও, এখন তারা আর তালেবানকে শক্তিশালী করবে না। কারণ, ইরানে ক্ষমতাসীনরা শিয়া সম্প্রদায়ের, অপরদিকে তালেবানরা সুন্নি। তাই সুন্নিদের উত্থানের পথে ইরান যাবে না। আগে এক সময়ে সুন্নি হিসেবে তালেবানরা সৌদির সাহায্য কিছুটা পেয়েছে। তবে সৌদির ক্রাউন প্রিন্স যেভাবে দেশকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে তালেবানদের সাহায্য করে সে তার দেশের আধুনিকতার পথে বাধা হয় এমন গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করবে না। তাই সত্যিকার অর্থে তালেবানদের অর্থের জোগানের দুটি মাত্র পথ খোলা থাকে। এক, চায়নার সাহায্য। দুই, পপি, হাসিস প্রভৃতি মাদক চোরাচালানের অর্থ। আফগানিস্তানের মাদক চোরাচালানের অর্থ বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে এই অর্থের বড় অংশ পাকিস্তানি চোরাচালানি, তাদের সামরিক বাহিনীর চোরাচালানি ও তালেবান নেতাদের পকেটেই যাবে।

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে যোগ হবে খুবই কম অংশ। অপরদিকে চায়নার সাহায্যের সুদ চড়া। তা নিয়ে কতটুকু কী করতে পারবে তালেবানরা তা অনেক বড় প্রশ্ন!

আর এর থেকে বড় হলো- তালেবানরা রাষ্ট্র চালাতে কতটুকু সমর্থ হবে। অস্ত্র হাতে ক্ষমতা দখল করা অনেক সহজ। কিন্তু চেয়ার টেবিলে বসে রাষ্ট্র পরিচালনা অনেক কঠিন কাজ। তারপরে আফগানিস্তানের মতো একটি জটিল দেশের। যে দেশে ১৪টি শক্তিশালী এথনিক গ্রুপ। অথচ তালেবানরা মাত্র একটি এথনিক গ্রুপকে প্রতিনিধিত্ব করে। তারা শুধু পাস্তুন সুন্নিদেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

বাকি তেরোটি তাদের বাইরে। এর পাশাপাশি তাদের জনসংখ্যায় আরও একটি পরিবর্তন এসেছে। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বয়স ২৫-এর নিচে। অর্থাৎ এই ৭০ শতাংশের তালেবান সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আবার এর শহরের অংশ আধুনিক শিক্ষায় ও আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা অভ্যস্ত হয়েছে, বিদ্যুৎ, পরিশোধিত পানি ও উন্নত সেনিটেশনে। আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা, দাতা সংস্থাদের অর্থ যেহেতু আমেরিকার চাপে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে এই বিদ্যুৎ, পানি, সেনিটেশনের ব্যবস্থা কি তালেবানরা সঠিকভাবে চালু রাখতে পারবে? পারবে কি মানুষকে ক্ষুব্ধ না করে তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে? তাছাড়া যে ৮৩ হাজার তালেবান পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে এতদিন ছিল তারাই বিনাযুদ্ধে আফগান দখল করেছে।

এই ৮৩ হাজারের আফগান গত বিশ বছরের আধুনিক জীবনযাত্রা ও যে ৭০ ভাগ নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে তাদের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই। তারা তাদের জীবনাচরণ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা সীমান্তে অনেকটা শিবির জীবন যাপন করে এসে একটি পরিবর্তিত জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা আসলে কি শেষ অবধি করতে পারবে? না, আবার তাদের মুখোমুখি হতে হবে বাদবাকি ১৩টি এথনিক গ্রুপ ও আধুনিক আফগান নাগরিকদের? এটাই এখন অনেক বড় প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে বলা যায়, আফগানিস্তানে কোনো স্থিতিশীল সরকার হবে না সহজে। বরং তাদের আগামী দিনে আরও বেশি অস্থিতিশীলতার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। তবে আফগানের এই ঘটনার ভেতর দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, যেকোনো দেশে রাজনীতিকরা ও প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গেলে তখন কোনো সুযোগ পেলেই মৌলবাদীরা তাদেরকে সবক্ষেত্রে না হোক কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরাজিত করতে পারে। তার একটি উদাহরণ আফগানের এই বর্তমান অবস্থা।

আর এর থেকে যেসব দেশে বড় মৌলবাদী গ্রুপ আছে এবং তার বিপরীতে সরকারি দলের রাজনীতিক ও সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতির বাতাস চলছে তাদেরকে সজাগ হতে হবে যেকোনো হঠাৎ বিপর্যয়ের থেকে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত নয়। তাই এই ঘটনার পরে বাংলাদেশকেও সজাগ হতে হবে মৌলবাদকে দমন করতে, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনকে ব্যবহার নয়। মৌলবাদকে স্তব্ধ করতে নিজস্ব রাজনীতিক ও প্রশাসনের দুর্নীতিও দূর করা।

এ বিভাগের আরো খবর