২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীরের নিহত হওয়ার পরে এ নিয়ে সারা দেশে যে তোলপাড় শুরু হয়েছিল এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসচালকের বিচার চেয়ে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তা পাঠকের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ঘটনার দশ বছর পরে গত ১৩ আগস্ট নিউজবাংলার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মাইক্রোবাসকে চাপা দেয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক জামির হোসেনকে দায়ী করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলেও আসলে তিনি নিরপরাধ।
নিউজবাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক দাবি করেছেন, যে ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হয়েছেন, সেই ঘটনার জন্য দায়ী মূলত তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস চালক; অথচ শাস্তি পেয়েছেন বাসচালক। অধ্যাপক শামসুল হক সরেজমিন অনুসন্ধান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলছেন, সেদিন রাস্তায় সঠিক লেনেই ছিল জামিরের বাস।
একটি বাঁকের মুখে তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি আকস্মিকভাবে ভুল লেনে যাওয়ার কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা জামিরের বাসটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। প্রসঙ্গত, যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া বাসচালক জামির হোসেন গত বছরের পয়লা আগস্ট ঈদের দিন কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আইনের শাসনের একটি বড় শর্তই হলো- দশজন অপরাধীও যদি শাস্তি না পায়, তারপরও একজন নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পাবে না। কিন্তু বাসচালক জামির যদি সত্যিই নিরপরাধ হয়ে থাকেন; যদি তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের নিহত হওয়ার ঘটনায় সত্যিই তার কোনো দায় না থাকে, তাহলে তার প্রতি যে অবিচার করা হলো, তার ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্র কীভাবে দেবে বা আদৌ দেবে কি না? জামিরের পরিবারকে রাষ্ট্র কী জবাব দেবে?
প্রশ্ন হলো, আদালত নিশ্চয়ই সাক্ষ্য প্রমাণ বিবেচনা করেই রায় দিয়েছেন। তাহলে ভুলটা ছিল কোথায়? আইনের দুর্বলতা? গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্র এই ঘটনার বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা জনমত কি বিচারকে প্রভাবিক করেছে বা এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে কি জনমতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে? রাষ্ট্রের কোনো একটি বড় অংশ যদি কোনো অন্যায্য দাবি তোলে বা কোনো একজন নিরপরাধ মানুষের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি জনমতের কথা বিবেচনা করে তাদের প্রতিবেদন দেবে?
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনটি কি সঠিক নিয়মে, সঠিক ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এবং দুর্ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল? আদালতে যারা এই ঘটনায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তারা কতটা নিরপেক্ষ ও নির্মোহ ছিলেন? সাক্ষী নির্বাচন কি সঠিক ছিল? প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যাদের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে, তাদের সবাই কি আসলেই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং ঘটনার সঠিক বর্ণনা দিতে সক্ষম হয়েছেন? তাদের মাথায়ও জনমতের চাপ ছিল? জনমত আর ন্যায়বিচার কি অভিন্ন?
সড়কে প্রাণহানি ঠেকাতে যে আইন রয়েছে, সেই আইন কি দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম নাকি আইনে ত্রুটি রয়েছে? ত্রুটি যে রয়েছে, সেটি এই ঘটনায় স্পষ্ট— যদি বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হকের দাবি সঠিক হয়। তিনি বলছেন, ওই দুর্ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়ায় বেশ কিছু ত্রুটি ঘটেছিল। এ কারণে তিনি হাইকোর্টে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদনের ত্রুটি, সঠিক ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করতে না পারা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে অনেক সময় নিরীহ লোককেও বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে হয়—জাহালম যার বড় উদাহরণ; ভুল আসামি হয়ে দুদকের ২৬ মামলায় তিন বছর কারাগারে থাকার পর হাইকোর্টের আদেশে গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান জাহালম।
তার মতো আরও অনেকে বিনা বিচারে বছরের পর কারাগারে থেকেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাদের অনেকে কারামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই যে বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে থাকলেন, তাদের জীবন থেকে যে অমূল্য সময় চলে গেল, মামলা লড়তে গিয়ে সহায় সম্পদ সব শেষ হলো, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? কেউ দিয়েছে?
দুই.
সারা বিশ্বের মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করেছে, তার লক্ষ্য ১৬-খ এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈষম্যহীন আইন ও নীতি প্রণয়ন।’ এই ইস্যুতে সবচেয়ে বড় কাজটি হাতে নিয়েছে সরকারের আইন মন্ত্রণালয়। তারা বৈষম্য বা তারতম্যমূলক আইন ও নীতি চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার করতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
১৭৯৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রণীত ১২৮৬টি আইনে কোনো বৈষম্যমূলক বিধান রয়েছে কি না, তা চিহ্নিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ ও বিভাগকে গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেছে। গবেষকরা বিভিন্ন আইনের বৈষম্যমূলক বিধান, বৈষম্যের বিভিন্ন রূপ, যেমন- লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে বৈষম্য, প্রয়োগের মাধ্যমে বৈষম্য ইত্যাদির স্বরূপ উদ্ঘাটন করে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। আইন মন্ত্রণালয় এসব সুপারিশ বিশ্লেষণ করবে যাতে সংশ্লিষ্ট আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা যায়। এছাড়া সরকার বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে এসব সুপারিশ বিবেচনা করা হবে।
বস্তুত, একটি সমাজ ও দেশ কতটা অগ্রসর, তার বড় মানদণ্ড সে দেশে ন্যায়বিচার আছে কি না। রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হলেও কার্যত বিচার চাইতে গিয়ে সমাজের একজন অতি দরিদ্র বা ক্ষমতাহীন এবং বিরোধীমতের কোনো লোকও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হলে বুঝতে হবে সে দেশ আইনের শাসন থেকে ঢের দূরে রয়েছে। অতএব টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত যে ন্যায়বিচার, সেটি শুধু সংবিধান বা আইনের ধারায় লিখে দেয়ার বিষয় নয়, বরং এটি দৃশ্যমান করতে হয়। যেকোনো বিচার ন্যায়বিচার হলো কি না, তার একটি বড় মানদণ্ড বিচারটি দৃশ্যমান করা। রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষটিও যে ন্যায়বিচার পেয়েছে, সেটি দৃশ্যমান করা। বিচার যে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকেছে, তদন্ত রিপোর্ট যে পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে, সেটি যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি বলার সুযোগ নেই যে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সব প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হতে সেসব আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। (২) রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের কোনো বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা বাতিল হয়ে যাবে।
সাংবিধানিক এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অনুসমর্থন জানিয়েছে এবং দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে আইন প্রণয়নসহ নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু তারপরও নানা ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়—যার জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নানা নীতিকে। অর্থাৎ একই অপরাধে সমাজের ক্ষমতাহীন কেউ যে শাস্তির মুখোমুখি হয়, অনেক সময় সেই একই অপরাধ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানরা করলে তারা আইনের নানা ফাঁক-ফোকর ও প্রভাব বিস্তার করে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। অনেক সময় পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নিরপরাধ লোকও শাস্তি পেয়ে যান—যার উদাহরণ বাসচালক জামির।
শুধু সড়ক দুর্ঘটনা আইন নয়; কালো টাকা সাদা করা বা আর্থিক খাতের এরকম অনেক আইন ও নীতি রয়েছে, যেগুলো বস্তুত রাষ্ট্রে অবৈধ পথে টাকা উপার্জনকে বৈধতা দেয় এবং সৎভাবে জীবন-যাপনকারী মানুষকে প্রতি একধরনের উপহাস তৈরি করে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা সন্ত্রাস দমন আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ দমনের বিরাট অস্ত্র এই আইন। হালের সবচেয়ে বিতর্কিত আইনের নাম ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’। সাংবাদিক-শিক্ষকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এই আইনের ভিকটিম।
বিরোধী শিবিরে থাকা সবচেয়ে বড় দল বিএনপির তরফে অবশ্য বলা হয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে এই আইন বাতিল করবে। আসলেই বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এই আইন বাতিল করবে নাকি তারাও আইনটিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ভিন্নমত দমনের কাজে ব্যবহার করবে— তা এখনই বলা মুশকিল। অথচ শুরু থেকেই নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, এই আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বৈষম্যমূলক আইনগুলো চিহ্নিত করার যে উদ্যোগ আইন মন্ত্রণালয় নিয়েছে, সেটি নিঃসন্দেকে একটি বড় কাজ। সত্যিই এই আইনগুলো চিহ্নিত করে এগুলোয় পর্যাপ্ত সংশোধনী আনা গেলে অনেক ধরনের অপরাধ যেমন কমবে, তেমনি অপরাধের বিচার নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইনগুলোকে হালনাগাদ করা এবং জনবান্ধব করা না গেলে এর ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে যাবে, অপরদিকে নিরীহ লোকজন ভিকটিম হতে থাকবে— যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।