বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শোককে শক্তিতে পরিণত করার আগস্ট

  •    
  • ১৮ আগস্ট, ২০২১ ১৫:৪৯

সেই আফগান আবারো রক্তে রঞ্জিত। পত্রিকার পাতায়, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়া আর মাল্টিমিডিয়ায় আমরা খবর দেখছি বিমানে ওঠার জন্য, দেশ ত্যাগের জন্য মানুষের হুড়াহুড়ি। নারীদের কান্না, শিশুদের আর্তচিৎকার, নাগরিকের উর্ধ্বশ্বাসে দিগ্বিদিক ছোটা আর সেখানে কর্মরত দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর আকুতি। বিশ বছর ধরে বহুজাতিক বাহিনীর তাবেদার সরকার আর সেনাবাহিনী অনেকটা বিনাপ্রতিরোধেই তালেবানদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিল। তাদের শাসক তো আরও এককাঠি সরেস! মিডিয়ায় খবর- আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। পালানোর সময় তিনি চার গাড়ি এবং একটি হেলিকপ্টার ভরে নগদ অর্থ নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয় গাড়ি-হেলিকপ্টারে জায়গা ছিল না বলে বাধ্য হয়ে কিছু অর্থ ফেলেও যেতে হয়েছে তাকে।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতির জীবনে যে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে সেই দাগ পুরোপুরি মুছে ফেলতে আরও কত বছরের সংগ্রাম ও ত্যাগ তীতিক্ষা প্রয়োজন তা একমাত্র ইতিহাসই বলতে পারে! শুধু ৭৫ নয় বরং আগস্ট আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং সেসময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সহ প্রায় ৩০০ নেতা-কর্মী আহত হওয়ার ঘটনা।

আগস্ট আমাদের আরও মনে করিয়ে দেয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) কর্তৃক একযোগে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা। ওইদিন সকাল বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার প্রেসক্লাব, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টি সহ সাড়ে ৪০০ স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা।

এমনকি হয়তো বিচ্ছিন্ন নয়, ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট সুদূর জার্মানীর মিউনিখের একটি এপার্টমেন্টে বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের রহস্যময় মৃত্যু, কিংবা ১৯৯২ সালের ১৭ আগস্ট তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি কার্যালয়ের সামনে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হওয়া। কাজেই আগস্টের ক্ষত একবারেই শুকানোর নয়। বরং এই আগস্টকেই কেন দুস্কৃতিকারী চক্র বার বার আঘাত হানার জন্য বেছে নিয়েছে সেই ইতিহাস এখনও অজানা।

তাই সংগত কারণেই এবার এই আগস্টেই আমাদের অনতিদূরের সার্কভূক্ত দেশ আফগানিস্তানে যখন আবার তালেবান শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসে তখন আমাদের মানসপটেও তা এক সতর্কতাবোধের ইংগিত দেয়।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই তবে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। মাধ্যমিকে পড়ার সময় আমাদের স্কুলে যিনি ইসলাম ধর্ম পড়াতেন তাকে আমরা হুজুর বলে ডাকতাম। ক্লাসে এসে উনি আমাদের বই থেকে রিডিং পড়তে বলতেন। আর যদি কেউ সেই সময়ে কোনো দুষ্টুমি করে উঠতো তবে কে দায়ী তা না খুঁজে বরং সমতার ভিত্তিতে উনি পুরো ক্লাসের সবাইকে বেত মারতেন। আর কেউ যদি বলে উঠত হুজুর আমি না, আমি না (অর্থ্যাৎ আমি কিছু করি নাই) তবে ওনার বেত মারার জোশ আরও বেড়ে যেত। কেননা আমাদের ক্লাসে দুষ্ট ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ জানতো হুজুরের স্ত্রীর নাম আমিনা। তাই হুজুর যখন জিজ্ঞেস করতেন এই কাজ কে করেছে? তখন তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই জোরে জোরে বলত হুজুর ’আমি না’। যাই হোক বলতে দ্বিধা নেই কেনো যেন হুজুরের ক্লাসেই যাবতীয় বাঁদরামি দুষ্ট ছেলেদের মাথায় এসে ভর করতো, এ হয়তো শয়তানেরই কারসাজি! কিংবা হয়তো বলা যায় স্কুলের যাবতীয় নিরানন্দময় পরিবেশের মধ্যেই সেই ক্লাসটাই সকলের দম নেয়ার জায়গা হয়ে দাঁড়াত।

এমনি করে একটা সময় আসলো যখন আমাদের মধ্য থেকে হুজুরের বিশেষ ভক্ত দুই-চারজন নিজেদের ক্লাসসহ আরও বিভিন্ন ক্লাসে টাকা তোলা শুরু করল। ১০ টাকা করে দিতে হবে। আমাদের কাছে সেই সময় ১০ টাকা মানেতো বিশাল ব্যাপার- কেননা এই টাকায় তখন পাওয়া যেত ২০ টা সিঙ্গারা, মানে আমাদের একেকজনের ২০ দিনের টিফিন। ঘটনার হেতু জানা গেল যখন ধর্ম ক্লাস শুরু হলো তখন। আশির দশকের শেষে আমাদের মতো সদ্য মাধ্যমিকে ওঠা মোটামুটি ধর্মভীরু কমবয়সীদের সামনে হুজুর গল্প বলা শুরু করলেন।

আফগানিস্তানে ইহুদি নাসারা তথা ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সেই দেশের দেশপ্রেমিক মুজাহেদিনরা নাস্তিক-মুরতাদদের দ্বারা পরিচালিত বিধ্বংসী ট্যাঙ্কের সামনে হাতের মুঠোয় বালু নিয়ে দোয়া কালাম পড়ে ফুঁ দিয়ে সেই বালু যখন ট্যাঙ্কের দিকে ছুড়ে মারে তখন সেই ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কী রোমাঞ্চকর সেই বর্ণনা! সেই বর্ণনা সম্বলিত চটি বই আমাদের কিনতে হবে। বইয়ের নাম ’আফগানিস্তানে আমি আল্লাহ্কে দেখেছি’। বইয়ের হাদিয়া ১০টাকা।

হুজুরের বর্ণনায় সেই বয়সে রোমাঞ্চিত- আমাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো কত দ্রুত ১০টাকা জোগাড় করে হুজুরকে দিয়ে সেই বই পাওয়া যায়। যদিও আমরা অনেকেই টাকা জমা দিলেও কেন যেন হুজুর সেই বই আর আমাদের দিতে পারেননি। আমরাও অনেক দিন রোমাঞ্চ নিয়ে স্কুলে যেতাম বই পাওয়ার আশায়। তারপর আস্তে আস্তে কীভাবে যেন আমাদের সেই রোমাঞ্চ শেষ হয়ে যায়। আমরা আর জানতে পারিনি আমাদের সেই টাকা কোন খাতে খরচ হয়, কিংবা কোনো মুজাহেদিনের আফগান যাওয়া আসার খরচ বাবদ সেই টাকা ব্যায় হয়েছে কিনা!

এই ঘটনা অবতারণার কারণ হলো, পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম আফগানিস্তানের সেই সকল যুদ্ধের আসল ইতিহাস। যুদ্ধের পক্ষে বিপক্ষে সকল ক্রীড়ানকের কীর্তি। তবে উপরে উল্লিখিত ঘটনার ফলে এইটুকু সহজেই বুঝা যায় যে, মফস্বলের মধ্যম মানের একটি স্কুলে হুজুরের সেই গল্প বলা, হাড়ির একটি ভাত টেপার মতো আমাদের মনে করিয়ে দেয় নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আরো অনেক স্কুলে প্রশাসনের অগোচরে সেই রোমাঞ্চকর গল্প অনেক কাচা বয়সের শিশু-কিশোরের মনে গেঁথে গিয়েছিল। মাদ্রাসার কথা না হয় বাদই দিলাম। তারই পরিণতি হয়তো একসময় স্লোগান ওঠে – ‘আমরা হবো তালেবান-বাংলা হবে আফগান।’ বা আরো পরে যখন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায় আমাদের দেশ থেকে অনেকেই নাকি যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব সমর্থিত সেই আফগান মুজাহেদিনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবং যুদ্ধ শেষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একটি অংশ নাকি দেশে ফিরেও এসেছিলো!

সেই আফগান আবারো রক্তে রঞ্জিত। পত্রিকার পাতায়, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়া আর মাল্টিমিডিয়ায় আমরা খবর দেখছি বিমানে ওঠার জন্য, দেশ ত্যাগের জন্য মানুষের হুড়াহুড়ি। নারীদের কান্না, শিশুদের আর্তচিৎকার, নাগরিকের উর্ধ্বশ্বাসে দিগ্বিদিক ছোটা আর সেখানে কর্মরত দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর আকুতি। বিশ বছর ধরে বহুজাতিক বাহিনীর তাবেদার সরকার আর সেনাবাহিনী অনেকটা বিনাপ্রতিরোধেই তালেবানদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিল।

তাদের শাসক তো আরও এককাঠি সরেস! মিডিয়ায় খবর- আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। পালানোর সময় তিনি চার গাড়ি এবং একটি হেলিকপ্টার ভরে নগদ অর্থ নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয় গাড়ি-হেলিকপ্টারে জায়গা ছিল না বলে বাধ্য হয়ে কিছু অর্থ ফেলেও যেতে হয়েছে তাকে। ক্ষমতার মৌরুসী পাট্টা ভক্ষণ আর সুযোগ বুঝে পলায়ন-এই তো বিশ বছরের বহুজাতিক শাসনের অবদান!

একসময় মার্কিন শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় মুজাহেদিনদের একাংশের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তালেবান নামের মৌলবাদী দল ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে। তাদের শাসনব্যবস্থা নৃশংস ও বর্বরতম শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। ২০০১-এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় উত্তরাঞ্চলীয় জোট তালেবানদের পতন ঘটায়।

এখানে একটি কথা বলতেই হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান বিশ্বমোড়ল আমেরিকার হাত ধরে। সেই আমেরিকার নেতৃত্বেই গত বিশ বছর সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে বহুজাতিক সরকার গঠন ও আফগান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দেশটিকে পুনর্গঠিত করার তৎপরতা পরিচালিত হয় । সর্বশেষ নবনির্বাচিত জো বাইডেন সরকার অবশিষ্ট মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে আরেকবার তালেবান শাসনেরই পৃষ্ঠপোষকতা দিলো কিনা তা খতিয়ে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

ভূ-রাজনীতি পাল্টেছে। পাল্টেছে বৈশ্বিক রাজনীতি। বিশ্ব মোকাবিলা করছে করোনা মহামারির বাস্তবতা। আর তাইতো আগেরবারে একলা চলো নীতি অনুসরণকারী তালেবানরা এখন অন্যান্য শক্তি-পরাশক্তির সমর্থন লাভে কূটনৈতিক দৌড়ঝাপ অব্যাহত রেখেছেন। এখন শোনা যাচ্ছে রথি-মহারথি পরাশক্তিদের অনেকেই নাকি নিজেদের লাভ লোকসানের নানা হিসাব নিকাশের মাপকাঠিতে তামা, সোনা, কয়লা, লোহার আকরিক সহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, লিথিয়াম ধাতু, নীলকান্তমণি, পান্না ও চুনিসহ বিভিন্ন মূল্যবান পাথর সমৃদ্ধ আফগানিস্তানে তালেবানদের সমর্থন দিতে যাচ্ছে।

কেউ কেউ বলে থাকেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইজেন হাওয়ার, পদমর্যাদায় যিনি নিজে ছিলেন ফিল্ড মার্শাল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার, মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রি কমপ্লেক্স (military-industry complex) সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন ‘যুদ্ধ কারো কারো জন্য ধ্বংস নয় বরং এমন ব্যবসা যাতে মুনাফা সর্বোচ্চ’।

আমেরিকান করদাতাদের আফগানিস্তানে ট্রিলিয়ন ডলার খরচের হিসাবের আড়ালে যে কথা চেপে যাওয়া হচ্ছে, এ টাকা যুদ্ধে অস্ত্র, লজিস্টিকস ও প্রযুক্তি সরবরাহকারী আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারদের ব্যাংক হিসাবে ফেরত গিয়েছে। যুদ্ধ শুধু ধ্বংস নয়, বাণিজ্যও বটে যাকে বলে ’টাকার খেলা’ বা ‘money game’। হয়তোবা নতুন কৌশলে আমেরিকা অন্য কোন বাণিজ্যের সন্ধানে অন্য কোন ‘money game’ শুরু করবে, যে নাটকের শেষ অঙ্ক দেখতে হলে আমাদের আপাতত অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

পরিশেষে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রচিত লড়াই সংগ্রামের গৌরবগাঁথাকেই আমাদের প্রতিনিয়ত চলার পাথেয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সেই পাথেয়র আলোকে একসময়ের কাবুলিওয়ালার দেশে সাম্প্রতিক এই পরিবর্তনকে ঘিরে বৈশ্বিক ক্ষমতাধরদের যে শক্তি সমাবেশ আর পক্ষ-বিপক্ষ নেয়া তার উপর আমাদের সজাগ দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি! শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আজীবন সংগ্রামী স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর আত্মদান হতে প্রাপ্ত প্রকৃত শিক্ষাই হতে পারে একমাত্র আমাদের ভবিষ্যতের দিশারী। কাজেই যেকোন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে এই আগস্টে শোককে শক্তিকে পরিণত করার সেই অমোঘ শক্তিতেই অবিচল থেকে আমাদের চলার পথ রচনা করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর