বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দেশে কি জঙ্গি বিলুপ্ত?

  •    
  • ১৭ আগস্ট, ২০২১ ১৮:৫২

বাংলাদেশ কি জঙ্গিদের তরফে বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে? এ প্রশ্ন এখনও উঠছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করছে, ধর্মান্ধ চরমপন্থিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে তারা একই সঙ্গে বলছে, আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। এ শক্তি বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতি পছন্দ করে না। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তাদের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। আফগানিস্তানে তালেবানি শক্তির ‘সাফল্য’ তাদের উৎসাহিত করে।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায়। এ দিন দুপুরে বাংলাদেশ চমকে ওঠে, বিশ্বও। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার একটি বাদে সবগুলোর অন্তত পাঁচশতাধিক স্থানে বোমা হামলা ঘটে। কারা করল এ ভয়ংকর হামলা?

ওই দিন বিকেলে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জামায়াতে ইসলামী একটি সমাবেশের আয়োজন করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সহযোগী কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত এ দলের নেতারা ৬৩ জেলায় বোমা হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বলেন, যারা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের ঘাঁটি হিসেবে প্রমাণ করতে চায়, অকার্যকর রাষ্ট্র বানাতে চায়; তারা সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী নেতারা বলেন, যারা ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর বলেছিল চারদলীয় জোটকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেব না, তারাই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালিয়েছে। সমাবেশে বক্তৃতা করেন আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, এটিএম আজহারুল ইসলাম প্রমুখ। [প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট, ২০০৫]

একইদিনে বিএনপি নেতারা মুক্তাঙ্গনের সমাবেশে বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলের সারা দেশে হামলা চালানোর মতো লোকবল নেই। শেখ হাসিনা, আবদুল জলিল এবং সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করলেই এই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হবে।’ [প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট, ২০০৫]

ওই সময়ে রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকটি স্থানে ধর্মান্ধ চরমপন্থিরা সংগঠিত হচ্ছে, এমন খবর সংবাদপত্রে আসছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার সে সব আমলে নেয়নি। তারা তোতা পাখির মতো আউড়েই যাচ্ছিল- আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এ জন্য বিদেশি চররাও তাদের সহায়তা দিচ্ছে।

আগের বছর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কয়েক মাস আগে ১ এপ্রিল আরেকটি উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছিল- চট্টগ্রামে একটি সরকার পরিচালিত ইউরিয়া সার কারখানার জেটিতে চোরাইপথে বিদেশ থেকে আনা দশ ট্রাক অস্ত্র খালাস করতে চেয়েছিল একটি মহল। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই সময় শিল্পমন্ত্রী ছিলেন একাত্তরের আলবদর বাহিনীর প্রধান এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য মতিউর রহমান নিজামী। পরবর্তী সময়ে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ সময় যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয়েছিল তা দিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব ছিল।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নেতারা সে সময়েও এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের দায়ী করে বক্তব্য দিতে থাকে।

১৭ আগস্টের বোমা হামলার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তারের জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর দেশের সব থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধে সাতক্ষীরার ‘এক ছিতাইকারী, এক মওলানা ও এক থানার ওসি’। ঘটনাটি ছিল এমন-

সাতক্ষীরার বোমা হামলা ঘটেছিল আদালতের পাশে। এক মাওলানা বোমাটি একটি পুটলির ভেতর রেখে একটু দূরে সরে যায়। আদালত অঙ্গনে পকেটমার পেশায় নিত্যদিন সক্রিয় থাকা এক তরুণ ওই পুটলাটি দেখে ফেলে। যে মাওলানা সেটি রেখেছিল, সে দূরে সরে যেতেই পকেটমার ভাবে, নিশ্চয়ই এর ভেতরে কিছু মিলবে। সে এগিয়ে যায় পুটলির দিকে, কিন্তু তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় সে মাওলানাকে দ্রুত পালিয়ে যেতে দেখে।ওই পকেটমার ঘটনাটি এক সাংবাদিককে বলে এবং সেই সাংবাদিক তাকে থানার ওসির কাছে নিয়ে যায়। ওসি ঘটনাটি শুনে টেপ রেকর্ড করে এবং অনেকটা জবানবন্দি হিসেবে সাংবাদিকদের জানিয়ে দেয়। ওসি মনে করেছিলেন- এমন ভয়ংকর অপরাধের রহস্য উৎঘাটনের জন্য সরকার থেকে তিনি বাহবা পাবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে বিপরীত। একাধিক সংবাদপত্রে ঘটনাটি প্রকাশিত হলে ঢাকা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে ক্লোজ করে এবং কেন এমন ‘গোপনীয় বিষয় সংবাদপত্রে ফাঁস করে’- সেজন্য শোকজ করে।

‘ইসলামি জঙ্গিবাদের আত্মপ্রকাশ : ৬৩ জেলায় বোমাবাজি’ এমন শিরোনাম ছিল ২০০৫ সালের ১৮ আগস্ট প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে। এটা বিস্ময়ের, কোনো হামলাতেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কোনো সংগঠন এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার তাৎক্ষণিকভাবে করেনি। তবে প্রতিটি বোমা হামলার ঘটনাস্থলের আশপাশে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি সংগঠন জেএমবির লিফলেট পাওয়া গিয়েছিল।

কয়েকদিন পর এ সংগঠনের নেতা পরিচয় দিয়ে কয়েকজন সংবাদপত্রে জানায়, তাদের হাতে ভয়ংকর সব বোমা রয়েছে। ‘সময়মতো আমরা প্রকৃত শক্তির খেলা দেখাব’- এমন দম্ভোক্তিও কেউ কেউ করছিল।

বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তখন ‘হাওয়া ভবন’-এর দোর্ন্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি। তার সঙ্গে জেএমবি এবং এ ধরনের কিছু সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদের ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যাচ্ছিল। তিনি কি এ ঘটনার পেছনে? এমন প্রশ্নের পাশাপাশি আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল এক বছর আগে ২১ আগস্টের ভয়ংকর গ্রেনেড হামলার স্মৃতি। সে দিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে একের পর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়- স্পষ্টতই লক্ষ্য ছিল দলের সভাপতি ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হত্যা করা।

১৭ আগস্টের হামলার পরের কয়েকটি মাস আরও অনেক স্থানে হামলা হয়। ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় দু’জন বিচারক নিহত হন। ২৯ নভেম্বর গাজীপুর ও চট্টগ্রামে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় বোমা হামলায় ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে যাওয়া এক সাইকেলচালক নিহত হওয়ায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর উল্লসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘একজন হিন্দু জঙ্গির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।’ [প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর, ২০০৫]

বোমা হামলায় নিহত সাইকেলচালক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, এটা জানার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এমন উদ্ভট মন্তব্য করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার লক্ষ্য ছিল জেএমবিকে আড়াল করা। তিনি বলতে চেয়েছেন- হিন্দুরাই বোমাবাজি করছে সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য এবং তাদের দিয়ে এ সব করাচ্ছে ভারত।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ধর্মান্ধ জঙ্গিদের বেশিদিন আড়ালে রাখতে পারেনি। জনমত সোচ্চার হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও চাপ আসে। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ জেএমবির অন্যতম শীর্ষনেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই গ্রেপ্তার হন। কিছুদিন পর দলের প্রধান নেতা শায়খ আবদুর রহমানও সিলেট থেকে গ্রেপ্তার হন। বিএনপির রাজনৈতিক ও আদর্শগত মিত্র হলেও এই চরমপন্থি দলের নেতাদের রক্ষা করতে পারেনি। তাদের শাসনামলেই কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর বিচারে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ছয়জন শীর্ষ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ সময় ক্ষমতায় ছিল ড. ফকরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

এ ঘটনায় জঙ্গি অপশক্তি দুর্বল হয়েছিল, সন্দেহ নেই। তবে তারা নতুন করে সংঘটিত হয়। তারা বার বার নাম পালটাতে থাকে, কৌশলে পরিবর্তন আনে। আন্তর্জাতিকভাবে নতুন পৃষ্ঠপোষক খুঁজে পায়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়ংকর জঙ্গি হামলা ঘটে, যাতে জাপান ও ইতালির কজন নাগরিক নিহত হন।

বাংলাদেশ কি জঙ্গিদের তরফে বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে? এ প্রশ্ন এখনও উঠছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করছে, ধর্মান্ধ চরমপন্থিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে তারা একই সঙ্গে বলছে, আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। এ শক্তি বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতি পছন্দ করে না। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তাদের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। আফগানিস্তানে তালেবানি শক্তির ‘সাফল্য’ তাদের উৎসাহিত করে।

সংগত কারণেই জঙ্গিবাদী অপশক্তির প্রতি নজরদারি বাড়ানো সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে সক্রিয় রয়েছে এ ধরনের চরমপন্থি গোষ্ঠী। বাংলাদেশকে তাদের চারণভূমিতে যেন পরিণত করতে না পারে, এটা নিশ্চিত করতেই হবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর