বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিকতা

  • সাজ্জাদ আলী জহির   
  • ১৬ আগস্ট, ২০২১ ১৭:৩৮

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি তার প্রচণ্ড মমত্ববোধ ও ভালোবাসা ছিল উল্লেখ করার মতো। এরই ধারাবাহিকতায় মানবতার কল্যাণে তিনি এমন একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে, আর এর মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও কালের বিচারে সেই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর শুভলগ্নে বাংলাদেশিরা এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, মানবপ্রেম, মেধা, মনন ও দূরদর্শী দিকনির্দেশনার জন্যই নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত বাঙালিরা ১৯৭১ সালে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি তার প্রচণ্ড মমত্ববোধ ও ভালোবাসা ছিল উল্লেখ করার মতো। এরই ধারাবাহিকতায় মানবতার কল্যাণে তিনি এমন একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে, আর এর মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও কালের বিচারে সেই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর শনিবার বেলা ২টার ঠিক পরেই শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ২৫ অক্টোবর এই যুদ্ধ ‘১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ’, ‘রমজান যুদ্ধ’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামেও পরিচিত। নিপীড়িত ন্যায়সংগত কারণেই এই যুদ্ধে আরব দেশসমূহকে সমর্থন জানানো হয়। শুধু নৈতিক সমর্থন নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য সেখানে সামরিক চিকিৎসক দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি। তার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল সাহসী ও সুদূরপ্রসারী।

যদিও তখন পর্যন্ত অনেক আরব দেশ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি, তদুপরি মানবিক দিক বিবেচনা করে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু সাহায্য প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য যে, এ যুদ্ধে ক্ষমতাশীল আমেরিকা, ইউরোপ ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে খুবই অল্পসংখ্যক মুসলিম দেশ এ ধরনের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ও উপসচিব মোহাম্মদ জমিরকে তলব করে শান্তিরক্ষা মিশনে প্রেরণের বিষয়ে প্রশাসনিক সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও টিমের সঙ্গে যাওয়ার জন্য তাকে নির্দেশ দেন।

সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ ও ডাইরেক্টর মেডিক্যাল সার্ভিস কর্নেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বলেন- “মধ্যপ্রাচ্যে আরব ও মুসলমান দেশগুলো আজ বিশাল বিপদের সম্মুখীন, এই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের মানবিক কর্তব্য। যদিও আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে তবুও অত্যাচারিত ভাইদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য।”

তিনি খুরশিদের দিকে তাকিয়ে স্নেহভরে বললেন: “খুরশিদ, তোমাকে আমি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এই দুরূহ কাজে পাঠাচ্ছি।” কর্নেল খুরশিদ বঙ্গবন্ধুর কথায় আবেগতাড়িত হন এবং বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়ে বলেন: “স্যার, আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও আপনার প্রদত্ত এই মিশন সফলভাবে বাস্তবায়ন করব।”

উল্লেখ্য যে, কর্নেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন ও তার আসামি নম্বর ছিল ৩৪। মামলার শুনানিকালে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাকে নির্মম নির্যাতন করে। সেই সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু খুরশিদ উদ্দিনকে খুব স্নেহ করতেন।

পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক চিকিৎসক দল প্রেরণের বিষয়ে সেনাসদরের ৭জন অফিসার ও ২১জন সৈনিককে নিয়োজিত করে দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন।

মিশনে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ২৮জনের দলকে তার অফিসে আমন্ত্রণ করে তাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন: “আপনাদের সফল কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করছে অত্যাচারিত মানুষের কল্যাণ এবং বাংলাদেশের সম্মান ও ভবিষ্যতের অনেক সিদ্ধান্ত।” জাতির পিতার এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয় । চিকিৎসক দলের সঙ্গে মিসর ও সিরিয়ার জন্য ৪ টন চা-পাতা প্রেরণ করা হয়।

১৯৭৩ সালের ১৯ অক্টোবর সকাল ১০টায় ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বোয়িং ৭০৭ বিমানে করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দলটি প্রথম কোনো বৈদেশিক অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে সিরিয়ার পথে যাত্রা করে । দলে ছিলেন কর্নেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ও উপসচিব ইসলাম, ক্যাপ্টেন মফিদুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন শাহজাহান প্রমুখ ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী দলটির প্রথমে বাগদাদে অবতরণ করার কথা থাকলেও সেখানে ইসরায়েলিদের বিমান আক্রমণ অব্যাহত ছিল। তাই ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর দুবাই থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি সিরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে। দামেস্ক ও বৈরুত বিমানবন্দরেও ইসরায়েলি আক্রমণের কারণে অবতরণ করা সম্ভব হয়নি বলে লিবিয়ায় নামায় অনুমতি না থাকলেও ব্রিটিশ পাইলট ক্যাপ্টেন ম্যাকিনটশ বিমানটি নিয়ে ককেশাস পর্বত, মাল্টা দ্বীপ, ইসরায়েল আর সিরিয়া পেরিয়ে বিমানটিকে রাতে লিবিয়ার বেনগাজিতেই অবতরণ করান। কেননা মাত্র আধা ঘণ্টা চলতে পারে এই পরিমাণ জ্বালানি ছিল বিমানে।

বাংলাদেশি সেনাদল বহনকারী বিমানটির লিবিয়ায় অবতরণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা হলেও ঘটনার গভীরতা অবগত হওয়ার পর লিবিয়া কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। লিবিয়া কর্তৃপক্ষের সহায়তায় দলটি পরদিন দুপুরে মিডলইস্ট এয়ারলাইনসের বিমানে করে বৈরুত বিমানবন্দরে পৌঁছার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দলটিকে অভ্যর্থনা জানান।

রাত ১০টায় নির্ধারিত বাসে করে দলটি লেবানন-সিরিয়া বর্ডার চেকপোস্ট পেরিয়ে দামেস্কের দিকে যাত্রা করে এবং ২১ অক্টোবর ভোরে দামেস্ক নগরীর কাছে পৌঁছে। চারদিকে তখন ছিল যুদ্ধ অবস্থা। নগরীতে প্রবেশের কিছুক্ষণ পরই সাইরেন বেজে ওঠে এবং ইসরায়েলের ৫-৬টি যুদ্ধবিমান দামেস্কে আক্রমণ চালায় । সিরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. মাদানী আল খিয়ামী সেদিন দামেস্কে বাংলাদেশ দলকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানান।

সিরিয়ার ৯ ডিভিশনের পেছনে দামেস্ক থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে দারেস সালামে বাংলাদেশ দলকে মোতায়েন করা হয়, যেখানে দ্বিতল একটি বালিকা বিদ্যালয়ে বাংলাদেশ দল অস্ত্রোপচার সুবিধাসংবলিত একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে। বাংলাদেশ দল ২২ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। ৩০ দিনে কয়েক হাজার সেনাসদস্য, মুজাহিদ, আহত গ্রামবাসীকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। চিকিৎসক দলের সদস্যরা নিরলসভাবে যুদ্ধাহতদের সেবা করেছেন।

সিরিয়ার রণাঙ্গনে বাংলাদেশ দল অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বলে দলটি সিরিয়ায় বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ দলের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে আরব বিশ্বের বেশ কিছু পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। যুদ্ধ শেষে দামেস্কের উমায়েদ মসজিদের গ্র্যান্ড মুফতি খুতবার সময় বাংলাদেশিদের এই অবদানের কথা স্মরণ করে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে নিরাপদে দেশে ফেরার বিষয়ে মোনাজাত করেন। বাংলাদেশকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য তিনি অন্যান্য মুসলিম দেশের প্রতি আবেদন জানান। বাংলাদেশের জন্য এই অভিযানের তাৎপর্য ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।

যুদ্ধের ময়দান থেকে বাংলাদেশ কনটিনজেন্ট ২২ নভেম্বর বৈরুতে আসে। ২৪ নভেম্বর বৈরুত বিমানবন্দরে সিরিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশ দলকে আন্তরিক বিদায় জানান। আরবদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন ও দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সালের শেষে বাংলাদেশ আরবদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের ১৫টি দেশ ১৯৭৩ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে এক রেজিমেন্ট ট্যাঙ্ক উপহার দেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭৩ সালে মাত্র ২৮জন শান্তিরক্ষীর মাধ্যমে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করার যাত্রা শুরু হয়েছিল । জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের যোগদান ও অবদান আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনগুলো পরিচিতি ও সুখ্যাতি লাভ করেছে।

বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত আছে। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী সব সময়ই প্রতিটি দুর্যোগে দেশ ও বিদেশে নিজেদের মানবিকতা, দক্ষতা, নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

শান্তিরক্ষা মিশনসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১৯৯০ সালে অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন (ওকেপি), ২০০৪ সালে অপারেশন সার্ক বন্ধন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের (সুনামি), ২০০৮ সালে মায়ানমারে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্প ইত্যাদি। তা ছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহ যেমন: ইউনিমগ, আনগোম্যাপ, আনট্যাগ, মিনারসো, ইউনিকম, ইউএনজিসিআই, ইউনামিক, আনপ্রোফর, আনট্যাক, ইউনোসোম, অনুমোজ, ইউনোমগ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ বিশেষ অবদান রাখেন। ২০১০ সাল থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নারীরাও অংশগ্রহণ করছেন।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, দূরদর্শী রাজনীতিক, অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতা, কূটনৈতিক পরিকল্পনা, অগ্রগামী চিন্তাধারা, সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্ত ও অনুপম দক্ষতার সঙ্গে সুযোগ্য নেতৃত্ব প্রদানের ফলেই বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছে এবং সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ও পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত।

এ বিভাগের আরো খবর