বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার কলংকময় স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৫ আগস্ট বছর ঘুরে পার হলো গতকাল। জাতীয় শোকের এ দিনটি কালপরিক্রমার অমোঘ নিয়মে গত ৪৬ বছর এসেছে এবং অনাগত ভবিষ্যতেও আসবে। যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্যে বাংলার মানুষ শোকাবহ এই দিন পালন করেছে এবং করবে। বিশেষ করে অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে যারা বিশ্বাস করে, নিজেদের বাঙালি বলে মনে করে এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আজও হৃদয়ে ধারণ করে। কিন্তু পঁচাত্তর সালের এই দিনে যে ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে জাতির অস্তিত্বে, সেই ক্ষত কোনোদিন শুকাবে না। আর সে কারণেই এই দিনটি বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকবে অনাগত কাল।
বিভাজনের যে কালো রেখা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ অস্তিত্বের মর্মমূলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এঁকে দেয়া হয়েছে, সেই কলঙ্ক থেকে যতদিন বাঙালির মুক্তি না ঘটবে, ততদিন ১৫ আগস্ট অবিস্মরণীয় বেদনাবহ স্মৃতির পাশাপাশি প্রতিরোধের দুর্জয় শক্তি নিয়ে জাগ্রত থাকবে বাঙালির জাতিসত্তায়। অনেকে বলবেন ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারের মধ্য দিয়ে কলঙ্ক মুছে গেছে, তা আংশিক সত্য, পূর্ণ সত্য নয়। কারণ পনেরো আগস্টের পরে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির যে পুনরুত্থান ঘটেছে তা থেকে দেশ আজও মুক্ত নয়। আর সে কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার অভিঘাত ভয়াবহ ক্ষতের সৃষ্টি করেছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের মর্মমূলে।
হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে যে মহান নেতা তারা জীবনব্যাপী সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার সাধনায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিসত্তা হিসেবে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের গর্বিত অধিকারী করে তুললেন, সেই মহান নেতাকে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তার স্বপ্নের স্বাধীন মাটিতে সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হতে হবে, এ কথা তিনি তো কোনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, সমগ্র জাতির কাছেই তা ছিল এক অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় ঘটনা।
সেই অকল্পনীয় নৃশংসতার শিকারই হয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরের আলো ফোটার আগেই বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী কিছু বিশ্বাসঘাতক।
তার সঙ্গে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেরণাদায়ী স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল এবং জাতির পিতার রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়সহ ১৬জন মানুষ।
সেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা কিংবা আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্তে অর্জিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রগতিশীল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই।
১৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পূর্বপরিকল্পিত ওই হত্যাকাণ্ড আসলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রগতিশীলতার অস্তিত্বকেই পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলার পরিকল্পনাজাত। তারা পরাজিত পাকিস্তানিদেরই এ দেশীয় দোসর এবং মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যারা এই যুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট বলে হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করেছে, সেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী।
যে কারণে ১৫ আগস্ট ভোরেই ঘাতকরা বাংলাদেশ বেতার দখল করে মুহূর্তের মধ্যে নাম পাল্টে দিয়ে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ এবং ‘জয়বাংলা’র জায়গায় পাকিস্তানি ভাবধারার ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশকে নাম বদল করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেছিল। যদিও তারা শেষ পর্যন্ত টিকেনি।
পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এদেশীয় এজেন্ট এবং আন্তর্জাতিক পরাশক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদতে সেদিন যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল এবং যারা এই হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত, তারা একটি ক্যামোফ্লাজ তৈরি করেছিল। তা হলো- তাদের মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কিছু লোকও ছিল। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যে তাকে হত্যা করেছে, এ নিয়েও বিভ্রান্তির কুয়াশা সৃষ্টিরও একটা অপচেষ্টা ১৯৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে।
এর কারণ এই হত্যা-পরিকল্পনায় জড়িত এবং হত্যার সরাসরি বেনিফিশিয়ারি খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সরকারের একজন প্রবীণ মন্ত্রী। হত্যাচক্রান্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানও। তাই ঘাতকরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিল।
খন্দকার মোশতাক যে পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ দালাল ছিল, সেটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই কলকাতায় ধরা পড়েছিল। তারপরও বঙ্গবন্ধুর সরল বিশ্বাসেই মন্ত্রিপরিষদেও সে ঠাঁই পেয়েছিল। মোশতাক যেমন মুজিব নগর সরকারের অংশী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, তেমনি একসময়ের পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য জিয়াউর রহমানও মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার। তারা দুজনই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষক এবং সমর্থক।
জিয়া-মোশতাকের কার্যকলাপ থেকেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায দৃশ্যমান। ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের তারা সমর্থন করেছেন, ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পর প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে এসব ঘাতককে পুনর্বাসিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে অল্প সময় খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। জিয়া সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান।
১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচার বন্ধ করতে জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংবিধানে লিপিবদ্ধও করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
জিয়ার প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তার মতো অনেকেরই স্খলন পরবর্তীকালে আমরা লক্ষ করেছি। যে কারণে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক মুক্তিযোদ্ধা (!)দের সমাবেশ-সম্মেলনও আমরা ঢাকায় দেখেছি।
অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত শুধু বিরোধিতাই করেনি, পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র সহায়ক শক্তি হয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করে তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে বাংলার মাটি সিক্ত করেছে। সুতরাং তাদের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধারা কেমন মুক্তিযোদ্ধা(!) সেটা সচেতন দেশবাসীমাত্রই বিবেচনা করবেন।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস, আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানের সমর্থক তৎকালীন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ বহু বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশ যে ছিল, তা বহু গোপন নথিপত্রের প্রকাশ্যে এবং বিভিন্ন ব্যাক্তির স্মৃতিচারণমূলক প্রকাশনার মধ্য দিয়ে গত ৪০ বছরে প্রমাণিত হয়েছে।
দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় মূলত সেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই জড়িত ছিল যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমন বিরোধী ছিল, তেমনই বাংলাদেশ রাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি, আজও পারছে না। শহিদের সংখ্যা নিয়ে তাদের সংশয়, সন্দেহ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যাবে ঘাতকচক্র তাকে তখনই হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছে, যখন তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সমাজকাঠামোয় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে শুরু করেন, অর্থাৎ কৃষক এবং শ্রমিকের রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে প্রশাসন এবং অর্থনীতি নতুন বিন্যাসে পুনর্গঠন করছিলেন।
পুঁজিপতি, ভূস্বামী, সামরিক-বেসামরিক আমলা থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের দর্শনে বিশ্বাসীরা বঙ্গবন্ধুর এই কৃষক-শ্রমিকের ক্ষমতায়ন বা রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেননি। আর মার্কিন পরাশক্তি তো আগে থেকেই বিরূপ ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপরে, কারণ সোভিয়েত এবং ভারতের সমর্থনপুষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত বাংলার সংগ্রামী জনতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও সোভিয়েত ইউনিয়নের নানামুখী সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকার। এমনকি বঙ্গবন্ধু সরকার সংবিধানে চারনীতির স্তম্ভে অন্যতম স্তম্ভ করেছিলেন সমাজতন্ত্র।
যে কারণে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যেমন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের চোখের বালি ছিল, নেতা হিসেবে বিশ্বের দুজন মানুষকে তিনি চরম শত্রু বিবেচনা করতেন,একজন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবং এই দুই নেতা খুব কাছাকাছি সময়ে আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল। মাত্র তিনটি বছর। এরই মধ্যে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন দেশে নতুন অর্থ ব্যবস্থা তথা নতুন
প্রশাসনিক কাঠামো বিনির্মাণ করবেন। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোতে দরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব নয়, তাই তিনি নয়া ব্যবস্থা তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সমতার সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তার আগেই তাকেও আলেন্দের মতোই প্রাণ দিতে হলো ঘাতকের হাতে।
সেই দেশি-বিদেশি চক্রান্তেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বাংলাদেশ উল্টোপথে যাত্রা করল ১৫ আগস্টের পর। এই কলঙ্কিত ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে একেবারে উলটে দিয়েছে। তাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ দীর্ঘদিন ধরে যে গৌরবগাথা রচনা করেছে, তার বিপরীতে অমোচনীয় ক্ষতের মতো জেগে আছে কলঙ্কের একটি দিন ১৫ আগস্ট। আর তারপর থেকেই সংযোজিত হতে থাকে একের পর এক ৩ নভেম্বর জেলে জাতীয় চারনেতা হত্যা, জঙ্গিদের শক্তিমত্তা জানান দেয়া ১৭ আগস্ট ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ধ্বংস করে দেয়ার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ২১ আগস্টসহ কয়েকটি ভয়ংকর দিন।
তারা ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ক্ষান্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক-বাহকদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিল। কারণ তারা কল্পনাও করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ কোনোদিন দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে। কেননা পঁচাত্তর পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনার অধিকারী পাকিস্তানপন্থিরাই দীর্ঘ ২১ বছর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, খন্দকার মোশতাকের মতো গণধিকৃত, সেই একই বেঈমানি তিনিও কি করেননি?
আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক- রশিদের ১৯৭৫ সালে ব্যাংককে বসে বিদেশি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার হয়ে যায় যে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তারা ২০ মার্চ দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে। এরপর বিএনপি বহুবার ক্ষমতায় ছিল কখনও ফারুক-রশিদকে সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের বক্তব্যের কথা অস্বীকারও করেনি, প্রতিবাদও জানায়নি।
সুতরাং ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যায় অংশগ্রহণকারীদের বিচার হলেও বিচারের বাইরেই রয়ে গেল নেপথ্যের চক্রান্তকারীরা। এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত ইতিহাসের স্বার্থেই। প্রয়োজনে ট্রুথ কমিশন গঠন করে প্রকৃত সত্য জাতির কাছে তুলে ধরা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাম্প্রতিক বক্তব্যে আশা করা যায় নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য শিগগিরই দল নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি কমিশন গঠন করা হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক বহুদিন ধরে চলমান। জিয়া যে ক্ষমতার কী তীব্র পিপাসু, সেটা শুরু থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল।
কালুরঘাটে স্থাপিত বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের জন্য ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি যে কাণ্ড করেছিলেন, তাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ঘোষণা দেওয়ার পরও বেতার-সংশ্লিষ্ট সবাই ভাবলেন যে, একজন বাঙালি সেনাকর্মকর্তাকে দিয়ে ঘোষণাটি দেওয়ানো গেলে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা না করে সরাসরি নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে সে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন জিয়া! সঙ্গে সঙ্গেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া! বাধ্য হলেন ‘অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বলে আবার সে ঘোষণা পাঠ করতে।
সেই জিয়ার স্বরূপ যে একদিন উন্মোচিত হবে, তা ছিল অনিবার্য সত্য এবং সময়ের ব্যাপারমাত্র। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে জিয়া কেন যাবেন? তার অন্তরে যে পাকিস্তান! বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের গভীর পাকিস্তানপ্রীতি এবং স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর আর জামায়াতের মতো মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের চেষ্টা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল! সুতরাং ১৫ আগস্টের নেপথ্যে কোন কোন সংঘবদ্ধচক্র সক্রিয় ছিল, তা আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
কর্নেল ফারুক -রশিদ ,ডালিমদের ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা জিয়াউর রহমান জেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪ মাস ১৯ দিন আগে! অথচ রাষ্ট্রের জাতির পিতা এবং সরকারপ্রধানকে হত্যা করা হবে জেনেও তিনি কোনো ব্যবস্থাতো নেনইনি, বরং নীরব সমর্থনই দিয়ে গেলেন। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কর্নেল ফারুক ও রশিদগং প্রথমে ঢাকা থেকে ব্যাংককে যান। সেনাপ্রধান জিয়াই তাদেরকে দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থায় দেশের বাইরে পাঠাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ব্যাংককে বিদেশি গণমাধ্যমে দেয়া ফারুক ও রশিদের সাক্ষাৎকারে তারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুহত্যা নিয়ে আলোচনার জন্য সাক্ষাৎ এবং সাক্ষাতে তার পরোক্ষ সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। আগ্রহী পাঠক ইচ্ছে করলেই টিউব সার্চ দিয়ে ১৯৭৫ সালে দেয়া সাক্ষাৎকার বাংলা অনুবাদসহ দেখতে ও শুনতে পারেন।
বিএনপি-জামায়াত তথা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতিকদের অনেকেই এমন উগ্র এবং বর্বর ভাষায় তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, যা শুনলে ধিক্কার দেয়ার ভাষাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের ভাষায় ‘বাংলাদেশের মানুষ গত ৫০ বছরে তিনবার আনন্দ পেয়েছেন। একবার ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, আরেকবার ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, আরেকবার ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০।’ অবশ্য এরা দেশের বাইরে গিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে এই সমস্ত প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, নেপথ্য থেকে কাজ করেছে, তারা দেশের যে সর্বনাশ করে গেছে, তা কোনোদিন মোচন হবার নয়। ১৫ আগস্ট শুধু কোনো সরকারপ্রধানকে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকেই। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি মর্যাদাবান ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্য আর ধর্মীয় সহিংসতা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্রে থাকবে না ধর্মের নামে রাজনীতি আর শোষণ-বঞ্চনার মতো পাকিস্তানি অভিশাপ। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
সেই কাঙ্ক্ষিত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগও ধরে রাখতে পারছিলেন না। সমাজতন্ত্রের নামে বাম, অতিবাম এবং গণবাহিনী, গলাকাটা বাহিনী, সর্বহারা এবং ‘হক কথা’র নামে নাহক কথার অপপ্রচারের ফুলঝুরি দেশটাকে অস্থির করে তুলেছিল। যার ফলে এত বড় বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে চিলির আলেন্দের মতো করুণ হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হলো স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে!
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেই যে দেশ বিভক্ত হয়েছিল প্রগতি আর মৌলবাদী শিবিরে, সেই মৌলবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধেই প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিকে। আজ এই কালোদিনে আমরা যেন বাংলাদেশের গৌরববিনাশী সেই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন থাকি, আগামী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যেন উন্মোচিত করে দিই ইতিহাসের সেই কালো পৃষ্ঠাগুলো, যাতে তারা সতর্ক পদক্ষেপ ফেলতে পারে আগামী দিনগুলোতে।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।