বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আমার দেখা বঙ্গবন্ধু

  • মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু   
  • ১৫ আগস্ট, ২০২১ ১৯:৫৬

বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপটে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম।

‘চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহ্বানের মধ্যে

উল্লাস করছে অন্ধ জনতা।

ওরা বলে, ‘এখন ভোর’, কিন্ত জীবনপানে তাকিয়ে

আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা’

মীর গুল খান নাসির (ভোর কোথায়?)

প্রকৃতির ঘূর্ণনচক্রে ভরদুপুরে মধ্যগগনের সূর্যে যেমন গ্রহণ লাগে, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় বিশ্বচরাচর; ঠিক তেমনি জনকের মহাপ্রয়াণ ছিল জাতির ভাগ্যাকাশে সবচেয়ে বড় সূর্যগ্রহণ। কয়েক যুগ ধরে চলে আসা শোষণ-বঞ্চনায় পথহারা মানুষকে যিনি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই তার মৃত্যুতে প্রমাণ হলো- জাতি আজও দিশেহারা। হিমালয়সাদৃশ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আর উষ্ণ স্রোতস্বিনীর ধারার মতো হৃদয়কে চিনতে ও জানতে ভুল করেছিল তারই নিজহাতে গড়া এদেশের বিপথগামী সন্তানরা। কিন্তু জাতির পিতা তো কেবলই একজন জাতির কর্ণধার নন, তিনি ধারণ করেন বৈশ্বিক নেতার বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলা এক মহান নেতা। যুগের চেয়েও অগ্রসর দেশনির্মাতা। সর্বোপরি সময়ের সঙ্গে পায়ে পা মেলানো এক ‘ক্যারিশমাটিক লিডার’।

অথচ দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন আর স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু ছিল তার নিত্যসঙ্গী। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েছেন বহুবার। বার বার তৈরি হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ। সেই তিনিই এক সময় দেশকে শোষণমুক্ত করলেন। স্বাধীনতার তৃপ্ত হাসি এনে দিলেন সব থেকেও সব হারানো কয়েক কোটি মানুষের মুখে। বিজয় অর্জনের ২৬ দিন পর ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে গ্রহণ করলেন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বলে রাখা ভালো, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম” শুনে যে বাঙালি সংগ্রাম ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; দেশ স্বাধীনের পর স্বভাবতই সেই বাঙালির স্বপ্ন ও চাওয়া ছিল আকাশচুম্বী। কারণ, যুগ যুগ ধরে অসংখ্য-অগণিত বৈষম্যের সাক্ষী হয়েছে এই বঙ্গভূমি। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য কোনো জাদুর কাঠি বঙ্গবন্ধুর হাতে ছিল না। কিন্তু তাই বলে জাতির পিতা থেমে থাকলেন না। গ্রহণ করলেন বিভিন্ন কর্মসূচি।

এর মধ্যে ছিল- শিল্প জাতীয়করণ, পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন, ত্রাণ পুনর্বাসন ব্যবস্থা, ভারতীয় সেনা প্রত্যাবর্তন, ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী বন্দিবিনিময়, খাদ্যঘাটতি দূরীরকণ, জনস্বাস্থ্যে পদক্ষেপ, শিক্ষায় ৩৬ হাজার ১৬৫ প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১ লাখ ৫৭ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমাদানের নির্দেশ, জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন এবং সর্বপরি জাতীয় ঐক্যের ডাক। স্বল্প সময়ে নির্বাচন ও সংবিধান প্রণয়ন ছিল তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। এভাবেই তিনি মাত্র সাড়ে ৩ বছরে স্বদেশ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল। ছয় দফার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারণায় এদিন পাবনা টাউন হলে আয়োজিত একটি জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। যতদূর দেখেছি ও জেনেছি- ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ি ভাবতেন জাতির পিতা। বলতেন- ‘ছয় দফায় যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই।’

অধিকার আদায়ের এ চিন্তা থেকেই ৬ দফার আন্দোলন দেশব্যাপী প্রচার করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। সেই ধারাবাহিকতায় পাবনায় (টাউন হল) সমাবেশ করতে আসা। তার আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আমার চাচা আব্দুর রব বগা মিয়ার বাসায় দুপুরের খাবার খেলেন। সেখানেই জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলাম। বিশেষ সাক্ষাতের সুযোগ হলো। বগা চাচা বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মী এম মনসুর আলী, এম এইচ কামারুজ্জামানসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আদরের ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। সর্বশেষ বললেন- ‘মাঠে (জনসভার ময়দান) আয়।’ সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনও কলেজের তকমা পাইনি।

রাজনীতির কতটুকুইবা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি র্দীঘদেহী এই মানুষটির স্নেহমাখা ‘মাঠে আয়’ স্বরে কী যেন লুকিয়ে ছিল। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম- কেউ না নিলেও একাই যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না। সবার সঙ্গেই টাউন হলের জনসভায় গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধশ্রোতা থেকে গগণবিদারী স্লোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন তার ছাত্রলীগের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর ‘মাঠে আয়’ নির্দেশের মধ্য দিয়ে ঘটল। মূলত রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভাবটা ওই মুহূর্ত থেকেই। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন; সেটাই যে আমাকে পরবর্তীকালে আমাকে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ জুগিয়েছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পাবনার সেই ৮ এপ্রিল ১৯৬৬’র পর বেশ কয়েকবার নাতিদীর্ঘসময় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ৪৫ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ে স্বৈরশাসন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন এবং ওয়ান ইলেভেন এসেছে। রাজনৈতিক জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কত কিছু শিখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকার সেই মুহূর্তগুলো ভুলতে পারিনি। জীবদ্দশায় পারবও না।

দুই.

ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে কাশিনাথপুর নগরবাড়ীতে ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে আরেকবার পাবনা আসেন জাতির পিতা। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বভাবতই জনসভার স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপটে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির পিতার দিকে। পরে দুই-একটি কথা বলে স্টেজের পাশে গেলাম। পরে এই ভেবে আনন্দিত হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।

বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার-ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামলো পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি। এজন্যই বলি- ১৫ আগস্ট আমার কাছে শোক দিবস তো বটেই, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত এক বিদনাবিধুর হৃদয় ভাঙার দিনও।

তিন.

১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল। দলীয় কোন্দলের জেরে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে কোহিনুরসহ ৭ ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম ছিলেন তখন ঢাকার পুলিশ সুপার। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান নিজে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। বিষয়টি তিনি (মাহবুব উদ্দিন) তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি) ই এ চৌধুরীকে অবহিত করলে তাৎক্ষণিক তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু তখন মস্কোতে চিকিৎসাধীন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এই সহচর (মনসুর আলী) সাহসিকতার সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। সিনিয়র কেবিনেট কলিগের সঙ্গে পরামর্শ করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেন তিনি।

যে পরিকল্পনা, সেই কাজ। হত্যার পরদিনই (৫ এপ্রিল) শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা কলেজের বিপরীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে ‘সীতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ থেকে। পর্যায়ক্রমে অন্য আসামিরাও গ্রেপ্তার হয়। সে সময় পাবনা জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমিই প্রথম বিবৃতি দিয়ে এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। পরে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠান্ডু ও সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিনও আমার পথে হাঁটেন। শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেপ্তারে অভিনন্দন জানানোয় মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ পাবনা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে বিলুপ্ত করে; যা পরদিন ‘দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

চিকিৎসা শেষে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তাকে সব ঘটনা জানানো হয়। পুরো বিষয়টি জানার পর ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীদের সাধুবাদ জানান বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, সে সময় প্রধানের মুক্তি দাবিতে অনশনরত ছাত্রলীগ কর্মীদের আধা ঘণ্টার মধ্যে অনশন ভাঙার নির্দেশ দেন। অনশন না ভাঙলে গ্রেপ্তারের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। বাধ্য হয়ে তারা অনশন ভাঙেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দণ্ডপ্রাপ্ত এই শফিউল আলমকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন তো সবারই জানা।

এদিকে আমার জেলা ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ ও বিধ্বস্ত ছিলাম। বিষয়টি সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় একমাস পর অর্থাৎ চুয়াত্তরের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেলাম। যাতে সহায়তা করলেন শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু সেদিন রমনা পার্কের গেট ও বেইলি রোডের মুখে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় ভবন ‘সুগন্ধা’য় অবস্থান করছিলেন। আমরা সেখানে সকাল ৯টায় পৌঁছি। তোফায়েল আহমেদ ভাই তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব। বলে রাখা ভালো, দেশে তখন মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছিল।

সেই দুর্ভিক্ষকে ঘিরে জাহাজযোগে দেশ-বিদেশ থেকে ত্রাণ আসছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা দুটি জাহাজ ডুবে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। এটা আন্দাজ করতে পেরেই তোফায়েল আহমেদ সেদিন কথা না বলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমরাও চলে আসতে উদ্যত হই। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমাদের ডাক দেন। তিনি তখন বারান্দায় থাকা বেতের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।

যাহোক, আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে এগিয়ে গেলাম। জাহাজ ডুবে যাওয়ার বিষয়টি বেশ কিছু কথা বলার পর আসার মূল কারণ জানতে চাইলেন। পরে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার খবরটি তাকে সবিস্তারে জানাই। বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন- ‘ছাত্রলীগ কার?’ হতবিহ্বল অবস্থায় বললাম, আপনার। তিনি আমাদের বললেন- তোরা পাবনায় ফিরে যা এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম কর। আমি দেখব কে তোদের বিরত করে? বলাবাহুল্য, এরপর আমাদের জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রমে আর কোনো বাধা আসেনি। সে ধারাবাহিকতায় পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতিও হয়েছিলাম আমি।

১৯৭৫ সালের জুনে বাকশাল গঠন হয়। উদ্দেশ্য- দল-মতনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। বলা যায় আর্থসামাজিক মুক্তিই ছিল এর উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে প্রথমে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পরে জেলা গভর্নরসহ জেলা কমিটিগুলো গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হওয়ায় তিনি আমাকেও এর সদস্য করেন। পদায়ন করেন পাবনা জেলা বাকশালের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন এখানকার সাধারণ সম্পাদক।

বঙ্গবন্ধু নিজহাতে প্রণয়ন করেছিলেন এই কমিটির তালিকা, পরে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মুখে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আমার নামটি লেখার গল্প শুনেছিলাম। কমিটি গঠনের পর জেলা বাকশালের সম্পাদক ও ৫ যুগ্ম-সম্পাদক মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায়। জাতির পিতার স্বভাব ড্রেসকোড ‘হাফ-শার্ট’ ও ‘লুঙ্গি’ পরেছিলেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুকে আমার শেষ দেখা। এই সাক্ষাতের দু’মাস পরেই যে তিনি চলে যাবেন, কে জানত সেটা? যাহোক, ভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম। বাকশাল কমিটিতে স্থান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের নানা দিকনির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন- ‘কীরে, আমার সঙ্গে তো ছবি না তুলে কেউ যায় না; তোরা কেন যাস’? তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান ডাকলেন। ফটোবন্দি হলাম রাজনীতির কবির সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে নেয়া সেই ছবি আজও আমি আগলে রাখছি। কারণ, তার কাছ থেকে পাওয়া এটাই আমার সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন!

চার.

আমাদের রাজনৈতিক ধারা বহুদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ পাকিস্তান প্রভাবযুক্ত ছিল। যে কারণে জনগণও হঠাৎ করে নতুন রাজনৈতিক নীতি বা সমাজব্যবস্থা গ্রহণ করার মতো মানসিকতায় ছিলেন না। এ কারণেই হয়তো বঙ্গবন্ধু যখন সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে একদলীয় শাসন বা বাকশাল গঠন করলেন; তখন অনেকেই তা মেনে নিতে পারেনি। অথচ এই কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু একদিনে গ্রহণ করেননি। স্বাধীনতার আগে সমাজতান্ত্রিক চীন সফর (আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থে বিস্তারিত) ও স্বাধীনতার পরে কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মিশরের আনোয়ার সাদাত, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও যুগোস্লোভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বৈশ্বিক নেতাদের সংস্পর্শ বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেছিল নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে; যা ছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে সমবায় পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেন এবং সবাইকে নিয়ে জাতীয় সংসদে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু মূলত সামরিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমবায় রাষ্ট্র চেয়েছিলেন; যা তৎকালীন বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য মেনে নিতে পারেনি। আর এই সবকিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে। শ্রাবণের মেঘ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরকে ঢেকে দেয় অন্ধকারের চাদরে।

পলাশীর প্রান্তরে যে সূর্য একবার অস্তমিত হয়েছিল; তা যেন আরেকবার অস্তমিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই বত্রিশে।

বঙ্গবন্ধু পরিবার শহিদ হলে আমি ও পাবনা আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। বিশাল এক মিছিল নিয়ে জেলা শহর প্রদক্ষিণ করি। আমি, বেবি ইসলাম, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু, আবুল কালাম আযাদ, রেজাউল রহিম লালের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ করে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সকাল ৮টা কি সাড়ে ৮টার দিকে পাবনার জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার পি বি মিত্র আমাদেরকে কোনো অ্যাকশনে যেতে বারণ করলেন। তিনি জানালেন, তিন বাহিনীসহ বিডিআর প্রধান ও রক্ষী বাহিনী ইতোমধ্যে মুশতাক সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। তোমাদের উচিত আত্মগোপনে চলে যাওয়া। বিষয়টি অনুধাবন করলাম। শহর ছেড়েছিলামও, কিন্তু ২০ আগস্ট খুনি মোশতাকের অনুগত বিপথগামী কিছু সেনা ও পুলিশ সদস্যের হাতে গ্রেপ্তার হই। সামরিক আইনের ৭ ধারায় (সন্দেহভাজন) হিসেবে ডিএসপি মো. শামসুদ্দিন আমাকে গ্রেপ্তার করে, গ্রেপ্তারকারী সেই কর্মকর্তা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচ (১৯৭৩) থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত।

গ্রেপ্তারের পর জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে কোনো এক গভীর রাতে জেলখানা থেকে চোখ বেঁধে বালুর ট্র্যাকে করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় নির্যাতন। সেই নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডিএসপি কংশধর তরফদার। ছিলেন পাকিস্তানফেরত সেনা কর্মকর্তা মেজর এএলএম ফজলুর রহমানও। ফজলুর রহমান আমাকে একের পর এক বুটের লাথি মারতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, ‘এই ব্যাটা তোর বঙ্গবল্টু কোথায়?’ এও বলা হয়- তোরা শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেছিলি, মিছিল করেছিলি? তোদের গুলি করে মারা হবে। ভেবেই নিয়েছিলাম, জীবন চলে যাবে। যে দেশে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হন, সে আমি আর এমন কী! কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, আমাদের আবারও গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। পরে সেনা ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

জেল থেকে বের হয়ে পরিবারের সকল সদস্যের আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে আমিও দুর্বল হয়ে যাই। ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবন। কষ্ট হলো তখন, যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে গালি দিয়ে আমাকে নির্যাতন করা সেই ফজলুর রহমানই আওয়ামী লীগের হাতে বিজিবি প্রধান হয়েছিলেন। এর চেয়ে দুঃখজনক কী হতে পারে?

শেষ করব, তার আগে দুটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ফিদেল কাস্ট্রো লিখেছিলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।

মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তোমরা আমারই দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি’। জীবনভর সংগ্রাম করে যে জাতিগোষ্ঠীকে তিনি তিল তিল করে স্বাধীনতা এনে দিলেন; স্বার্থের টানে সেই দেশের মানুষই যখন তাকে হত্যা করে; আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি অর্বাচীন-মূর্খ-অপক্ব- কুলাঙ্গার তো তারাই। কারণ তারা জানে না, বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা শেষে মেজর বজলুল হুদার বলা ‘অল আর ফিনিশড’ বাস্তবায়ন হয়নি। বরং কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে তার (বঙ্গবন্ধু) নীতি-আদর্শ উজ্জীবিত হচ্ছে নতুন মোড়কে, নতুন উদ্যমে। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখে গেছেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা/গৌরী, যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।’ আমিও বলি- বহমান নদীর মতোই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কীর্তি-স্মৃতি রয়ে গেছে সবখানে, সবজুড়ে। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

নির্ভীক এ বিশ্বনেতা ও তার পরিবারসহ ১৫ আগস্টে নিহত সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

এ বিভাগের আরো খবর